হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
প্রসঙ্গ: স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাকাম হাছিল করার কোশেশ করবে।
তওবা-এর মাকাম হাছিলের উপায়: তওবা-এর মাকাম হাছিল করার জন্য তিনটি কাজ আবশ্যক। (১) আউলিয়ায়ে কিরাম-এর নিয়মিত ছোহবত ইখতিয়ার করা। (২) আউলিয়ায়ে কিরাম-এর নির্দেশিত যিকির-ফিকির করা। (৩) রিয়াজত-মাশাক্কাত বা মুজাহাদা করা।
উল্লেখ্য যে, দশটি মাকামই হাছিলের ক্ষেত্রে এই তিনটি কাজ আবশ্যক। মূলতঃ এই তিনটি কাজের দ্বারা সমস্ত মাকাম হাছিল করা সহজ ও সম্ভব।
(১) আউলিয়ায়ে কিরাম-এর নিয়মিত ছোহবত ইখতিয়ার: তওবা-এর মাকাম হাক্বীক্বীভাবে হাছিল করার ক্ষেত্রে আউলিয়ায়ে কিরাম তথা শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর নিয়মিত ছোহবত ইখতিয়ার করা আবশ্যক। কারণ, শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার ছোহবতের দ্বারা তাঁর খাছ ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ লাভ হয়। আউলিয়ায়ে কিরাম তথা শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ, তা’লীম-তরবিয়ত ব্যতীত তওবার মাকামে হাক্বীক্বীভাবে পৌঁছা এবং ইস্তিকামত (অবিচল) থাকা সম্ভব নয়। এমনকি কোন মাকামই হাছিল করা সম্ভব নয়। মূলতঃ ঈমান নিয়ে কবরে যাওয়াই কঠিন।
তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে- ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ছিলেন যুগ শ্রেষ্ঠ মুফাস্সির। যিনি ৩০ খ-ের তাফসীরে কবীরসহ অনেক কিতাবাদি রচনা করেছেন। তাঁকে মানতিক শাস্ত্রের ইমাম বলা হয়। তিনি জানতেন যে, মৃত্যুর সময় শয়তান ধোঁকা দিয়ে ঈমানহারা করে। তাই তিনি শয়তানের মুকাবিলা করার জন্য পূর্ব থেকেই একশত থেকে এক হাজার দলীল প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। যখন ইন্তিকালের সময় আসলো তিনি দেখতে পেলেন, সত্যি শয়তান ধোঁকা দেয়ার জন্য তাঁর নিকটবর্তী হয়েছে। শয়তান, ইমাম ছাহেবকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলো। ইমাম ছাহেব তার জাওয়াব দিতে লাগলেন। এক পর্যায়ে প্রশ্ন করলো, ইমাম ছাহেব! আল্লাহ পাক যে এক, তার দলীল কি?
ইমাম ছাহেব কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ থেকে অনেক দলীল পেশ করলেন। কিন্তু তার সমস্ত দলীলই শয়তান খ-ন করলো। ইমাম ছাহেব এখন নির্বাক। তাঁর সমস্ত দলীল শেষ হয়েছে। এখন শুধু ঈমান হারাবার পালা।
এমতাবস্থায় তাঁর শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা হযরত নজিবুদ্দীন কুব্রা রহমতুল্লাহি আলাইহি দূর থেকে অযূর পানি নিক্ষেপ করলেন। মূলতঃ ফয়েজ দান করলেন এবং বললেন, æহে ফখরুদ্দীন রাজী! বল, বিনা দলীলে আল্লাহ পাক এক।”
শায়খ বা মুর্শিদ-এর এ আওয়াজ ইমাম ছাহেবের কানে পৌঁছার সাথে সাথে তিনি বললেন- বিনা দলীলে আল্লাহ পাক এক। এই জাওয়াব শুনার সাথে সাথে শয়তান পালিয়ে গেল। যাওয়ার সময় শয়তান একথাও বলে গেল যে, ইমাম ছাহেব! আজকে আপনার শায়খ-এর কারণে বেঁচে গেলেন। অন্যথায়, ঈমান হারাতে হতো।
উল্লেখ্য যে, ইমাম ছাহেবের শায়খ বা মুর্শিদের নাম মুবারক হযরত নজিবুদ্দীন কুবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি আছরের নামাযের জন্য ক্বিবলামুখী হয়ে অযূ করতে বসেছিলেন। খাদিম অযূর জন্য তাঁর হাত মুবারকে পানি ঢালতে লাগলেন। আর হযরত নজিবুদ্দীন কুব্রা রহমতুল্লাহি আলাইহি ক্বিবলার দিকে তাকিয়ে হাত ধুতেই আছেন। এক বদনা পানি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি সেদিকে তাকিয়ে হাত ধুতেই আছেন। আর কোন অঙ্গই ধুচ্ছেন না। আদবের খিলাফ মনে করে খাদিম কোন কথা বলছেন না। এক পর্যায়ে হযরত নজিবুদ্দীন কুবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি হাতে কিছু পানি নিয়ে খুব জোরে দূরে নিক্ষেপ করতঃ বললেন æহে ফখরুদ্দীন! বল, বিনা দলীলে আল্লাহ পাক এক।”
অযু শেষ হলো। নামাযও শেষ হলো। খাদিম বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন, হুযূর! আজকের ন্যায় অযূ করতে আপনাকে আর কখনো দেখা যায়নি। আর যা বললেন- তাও কখনো বলেননি। তখন হযরত নজিবুদ্দীন কুবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি ঘটনাটি বিস্তারিত খুলে বললেন।
খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী ছোহবতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন- æআউলিয়ায়ে কিরাম তথা শায়খ-এর ছোহবত ইখতিয়ার করা ফরয। যদি শুধু মাত্র যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মাশাক্কাত করলেই দিল ইছলাহ হতো- তাহলে রাস্তার ফকীরদের আগেই দিল ইছলাহ হতো। কারণ, তারা প্রতিদিন- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১৮ ঘণ্টাই যিকির করে। কিন্তু তাদের তো দিল ইছলাহ হয় না।
কাজেই শুধু যিকির-ফিকির করলেই হবে না। যিকির-ফিকিরের সাথে সাথে আউলিয়ায়ে কিরাম তথা শায়খ-এর ছোহবত ইখতিয়ার করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, ফারূকে আ’যম, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যেদিন আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই হাদীছ শরীফ শুনলেন- æতোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিনে কামিল (পরিপূর্ণ মু’মিন) হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে তোমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং দুনিয়ার সমস্ত মানুষ এমনকি তোমাদের নিজের জীবনের চেয়েও বেশি মুহব্বত না করবে।” সেদিন তিনি ছোট সন্তানের মত কাঁদলেন। কারণ স্বরূপ বললেন- æহে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ধন-সম্পদ, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে আপনাকে বেশি মুহব্বত করি। কিন্তু আমার নিজের জীবনের চেয়ে বেশি মুহব্বত করতে পারি না।”
তখন আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে কাছে আসতে বললেন। তিনি কাছে গেলেন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় হাত মুবারক তাঁর সীনাতে রেখে ফয়েজ দান করলেন। আর একটু পরেই তিনি বললেন- æহে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এখন আমি একজন উমর নয় বরং আমার মত হাজার হাজার উমর আপনার জন্য কুরবান হতে পারি।” (সুবহানাল্লাহ)
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আফযালুল আউলিয়া, কাইয়্যুমে আউয়াল, ইমামে রব্বানী, গাউসে সামদানী, মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ্ দ্বীন হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন মুরীদ তাঁকে একদিন বললেন- æহে আমার শায়খ! আমার হালত (অবস্থা) এমন হয়েছে যে, আমি সব সময় (দায়িমীভাবে) আল্লাহ পাক-এ দীদার লাভ করি। এর পরেও কি আমার ছোহবত ইখতিয়ারের প্রয়োজন আছে?
আফযালুল আওলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন- æহে প্রিয় বৎস! তোমার ক্বল্ব লতীফার এক তৃতীয়াংশ হাছিল হয়েছে মাত্র। কাজেই ছোহবতের আরো কত প্রয়োজন রয়েছে সেটা ফিকির কর।”
সাইয়্যিদুল আওলিয়া, গাউসুল আযম, মুহিউদ্দীন মুজাদ্দিদে মিল্লাত্ ওয়াদ্ দ্বীন হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, æহযরত মানছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি যদি সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত আবুল হাসান নূরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর তরবিয়ত এবং ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ লাভ করতে পারতেন তাহলে তাঁকে ফাঁসি কাষ্ঠে জীবন দিতে হতো না।”
তিনি আরো বলেছেন যে, æআমার যামানায় তিনি যদি হতেন কিংবা আমি যদি সেই যামানায় থাকতাম তাহলে ঐ হাল (অবস্থা) থেকে তাঁকে উত্তীর্ণ করে দিতাম। সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন মুরীদ ছোহবত ত্যাগ করার কারণে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। শয়তান সেই মুরীদকে খেলার পাত্র বানিয়ে নিয়েছিল। প্রতিরাতে তাকে ময়লা ও নোংরা স্থানে নিয়ে যেত। আর সেই মুরীদ দেখতো, সে প্রতিরাতে জান্নাতের নাজ-নিয়ামত ভোগ করে। পরবর্তীতে স্বীয় শায়খ সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ইহসানের কারণে সেই অবস্থা হতে পরিত্রাণ লাভ করেছিল।
মূলতঃ শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে তার জীবনের লক্ষ লক্ষ বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষদেরকে গুমরাহ বা পথ ভ্রষ্ট করার কাজে সব সময় লিপ্ত রয়েছে। আউলিয়ায়ে কিরামগণের তা’লীম-তরবিয়ত, ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ ব্যতীত তার হাত হতে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্যই আউলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত ইখতিয়ার করাকে ফরয বলে ফতওয়া দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ করেছেন-
يٰاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ
অর্থঃ- হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ পাককে ভয় কর। আর ছদিক্বীন তথা সত্যবাদীগণের ছোহবত ইখতিয়ার কর।æ (সূরা তওবা-১১৯)
হযরত মুফাস্সিরে কিরামগণ বলেছেন যে, এই আয়াত শরীফ-এ আল্লাহ পাক প্রথমতঃ আল্লাহ পাককে ভয় করতে বলেছেন। দ্বিতীয়তঃ সত্যবাদীগণের ছোহবত ইখতিয়ার করতে বলেছেন। যার মর্মার্থ হচ্ছে- সত্যবাদীগণের ছোহবত ইখতিয়ার করলে আল্লাহ পাক-এর মা’রিফাত-মুহব্বত লাভ করতে পারবে। ফলে আল্লাহ পাককে হাক্বীক্বীভাবে ভয় করতে পারবে। কারণ আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত ও মুহব্বত ব্যতীত আল্লাহ পাককে হাক্বীক্বীভাবে ভয় করা সম্ভব নয়। (অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১২)