–হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
শায়খ বা মুর্শিদের সাথে যেরূপ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক- এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে সেরূপ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। কাজেই কোন সময় যেন নিজের শায়খ-এর সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে না পারে তার প্রতি সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। এপথ অত্যন্ত সূক্ষ্ম। চোখ যেমন সামান্য ও ক্ষুদ্র জিনিসের ওজন সহ্য করতে পারে না মারিফাত -মুহব্বতের পথ ও তেমনি সামান্যতম ত্রুটি-বিচ্যুতি বরদাশ্ত করে না।
একদিন আফজালুল আওলিয়া, সুলতানুল আরেফীন, ইমামে রব্বানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি একজন মুরীদকে লিখলেন, “পার্থিব নানারূপ চিন্তা যেন ইল্মে তাসাউফের ছবক আদায় এবং আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের ত্বরীকার উপর ইস্তিকামত (অটল) থাকতে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে না পারে।”
ঘটনাক্রমে যদি অন্তঃকরণে কখনো কোন তমসার সৃষ্টি হয়, তাহলে আল্লাহ পাক-এর পাক দরবারে অনুনয়-বিনয় করে কান্নাকাটি করবে। স্বীয় শায়খ-এর দিকে পূর্ণরূপে রুজু হবে। ইহাই তার উৎকৃষ্ট চিকিৎসা। কারণ তিনিই হচ্ছেন নিয়ামত পাওয়ার উসিলা। যার মাধমে এই সৌভাগ্য লাভ হয়েছে তাঁর আদব-সম্মান ভালভাবে রক্ষা করবে। তাঁর সন্তুষ্টিকেই আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টির অবলম্বন মনে করবে। ইহাই নাজাতের পথ। (মাকতুবাত শরীফ)
নিজের শায়খ বা মুর্শিদের সাথে সম্পর্ক অটুট রাখতে নিন্মোক্ত বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী হতে হবে।
৫৩। মুরীদ কখনো নিজের কাশ্ফ বা আত্মিক বিকাশের উপর নির্ভর করবে না। অন্যথায় গোমরাহ বা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। (মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী)
كشف (কাশ্ফ) শব্দের অর্থ উন্মুক্তকরণ, প্রকাশ করা, পরিদর্শন করা, আত্মিক দর্শন ইত্যাদি। পারিভাষিক বা ব্যবহারিক অর্থ প্রসঙ্গে- ইরশাতুত্ ত্বলেবীন কিতাবে উল্লেখ আছে যে, জাগ্রত বা নিদ্রিতাবস্থায় নেককার লোকগণের হৃদয় পটে কোন বস্তুর প্রতিচ্ছায়া অঙ্কিত হওয়াকে কাশ্ফ বলে। (তরিকত দর্পন/৪৬)
তালিমুদ্দীন/ ১৮২ পৃষ্ঠাতে উল্লেখ আছে, কোন কোন সময় কোন অদৃশ্য বিষয় সালিকের চোখের সামনে ভেসে উঠে, ইহাকে কাশ্ফ বলে।
উল্লেখ্য যে, আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ বলেছেন- আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বত এবং নৈকট্য পাওয়ার পথে সালিক বা মুরীদকে সত্তর হাজার পর্দা অতিক্রম করতে হয়। আবার কেহ কেহ তারও অধিক বলেছেন। কাফির মুশরিকরা একটা পর্দাও অতিক্রম করতে পারে না। ফলে তাদের পক্ষে ঈমান আনা সম্ভব হয় না। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেছেন-
ان الذ ين كفروا صواء عليهم ءا نذر تهم ام لم تنذر هم لا يؤ منون. ختم الله على قلوبهم وعلى سمعهم وعلى ابصار هم غشا وة ولهم عذاب عظيم.
অর্থঃ নিশ্চয়ই যারা কুফুরী করেছে তারা সেই কুফুরীর উপরই অনড় রয়েছে। তাদেরকে ভয় দেখান আর না দেখান তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ পাক তাদের কল্বে এবং কানের উপর মোহর মেরে দিয়েছেন। আর চোখের মধ্যে পর্দা এঁটে দিয়েছেন। কাজেই তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব (অর্থাৎ তারা তাদের কুফরীর উপর দৃঢ় থাকার কারণে তাদের ক্বলবে ও কানের উপর মহর পড়েছে। আর চোখের উপর পর্দা পড়েছে)। (সুরা বাক্বারা-৬,৭)
ঈমান আনার কারণে কিছু পর্দা বিদুরিত হয়। আমলে ছলিহ করলে আরো কিছু পর্দা বিদুরিত হয়। যার দৃষ্টি পথ হতে যত বেশি পর্দা উম্মোচিত হয় সে আল্লাহ পাক ও আল্লাহ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তত বেশী মা’রিফাত-মুহব্বত ও নৈকট্য পান। কাজেই যারা আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত-মুহব্বত হাছিলের প্রত্যাশী। যারা নৈকট্য পাওয়ার আশায় কঠোর-রিয়াজত মুশাক্কাতে আত্মনিয়োগ করে তাদের দৃষ্টিপথ হতে এক পর্যায়ে সমস্ত পর্দা উন্মোচিত হয়। ফলে দুনিয়াবী ও উখরবী সব বিষয়ই প্রকাশিত হয়।
মুরীদকে তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাবে না। তার কাঙ্খিত বস্তুকে আরো উপরে, আরো উপরে তালাশ করতে হবে। মনে করতে হবে এসব তার কাঙ্খিত বস্তু নয়। আর এটা তার লক্ষ্যবস্তু নয়। বরং-অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে এক প্রকার পরীক্ষা। একজন ওলী আল্লাহ একদিন পানি তোলার জন্য কুপে বালতি ফেললেন। কিন্তু পানির পরিবর্তে বালতি পূর্ণ রৌপ্য মুদ্রা উঠে আসলো। তিনি সেগুলো কুপেই ফেলে দিলেন। আবার বালতি ফেললেন এবার উঠে আসলো স্বর্ণমুদ্রা। সেগুলোকে ফেলে দিলেন। বললেন, হে বারে ইলাহী! আমি আপনাকে চাই। আমি এগুলো চাই না। হে বারে ইলাহী! আপনি এসব দিযে আমাকে কি ভুলিয়ে রাখতে চান? এসব বলে তিনি, পানি পান না করে; আপন পথ ধরলেন। (তাযকিরাতুল আওলিয়া)
কাশ্ফ-এর হাক্বীক্বত
সুলতানুল মুহাক্কিকীন, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত ত্বরীকত, আওলাদে রসূল, মুহিউদ্দিন আবুল আব্বাস হযরত সাইয়্যিদ আহমদ কবীর রিফাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্বখ্যাত কিতাব” আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ এর মধ্যে উল্লেখ করেন, “কাশ্ফ এক প্রকার চুম্বক ধর্মী শক্তি। ইহার বৈশিষ্ট এই যে, অন্তর দৃষ্টির আলোকে অদৃশ্য জগতের দিকে আকর্ষণ করে নেয়া হয়ে থাকে। আলো বিকিরণের সময় ইহার সামনে পরিষ্কার আয়নায় যেমন আলো প্রতিফলিত হয় তদ্রুপ অন্তদৃষ্টির নূর অদৃশ্য জগতে মিলিত হয়। অন্তর্দৃষ্টির আলো অদৃশ্য জগতের আলো গ্রহণ করতঃ হৃদয় পটে প্রতিবিম্বিত হয়ে থাকে। তারপর এই আলো বৃদ্ধি পেয়ে বোধশক্তিতে চমকিতে থাকে এবং অভ্যন্তরেই ইহার সাথে এইরূপে মিলিত হয়ে পড়ে যে, বোধ শক্তির আলো হৃদয় পটে পৌছতে আরম্ভ করে। তার প্রভাবে হৃদয়ে আলো চমকিতে থাকে। তখন সে সেই সকল বস্তু দেখতে থাকে যা প্রকাশ্য দৃষ্টি শক্তি দেখতে পায়না। আর অন্যের পক্ষ্যে তা দেখাও সম্ভব নয়”।
ইমামে রব্বানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “জাহিরী আলিমগণ এবং চরম স্তরের সূফীগণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, আলিমগণ স্বীয় ইল্মের সাহায্যে প্রমাণাদি দ্বারা যা জেনে থাকেন, সূফীগণ তা কাশ্ফ এর দ্বারা উপলদ্ধি করে থাকেন”। (মাকতুবাত শরীফ)
তিনি আরো বলেন, আত্মার অবস্থা ও মাকাম সমূহের বিস্তারিত জ্ঞান, মুশাহাদা (আত্মিক দর্শন) ও তাজাল্লী (আত্মিক আবির্ভাব সমূহের প্রকৃত তত্ত্বের পরিচয়) কাশ্ফ (আত্মিক বিকাশ) ও ইলহাম (ঐশী বিজ্ঞপ্তি) হাছিল হওয়া এবং ম্বপ্নাদির ফলাফল জানা হাদীর জন্য একান্ত আবশ্যকীয় বিষয়। ইহা ব্যতীত খরতুল কাতাদ বা পরিশ্রম বৃথা (মাকতুবাত শরীফ)
খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, সাইয়্যিদুনা, ইমাম, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেন, যাদের রুহানী শক্তি বেশী তারা জাগ্রতাবস্থায় অদৃশ্য জগতের বিষয়াবলী দেখতে পায়। যাদের দূর্বল তারা চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায়। যাদের আরো দূর্বল তারা স্বপ্নে দেখে থাকে।
কাশ্ফ-এর প্রকারভেদঃ
কাশ্ফ দু’প্রকারঃ (এক) কাশ্ফে ইলাহী (দুই) কাশ্ফে কাওনী। কাশ্ফে কাওনী হচ্ছে জাগতিক বস্তু সম্পর্কিত কাশ্ফ। যা কোন জিনিসের অবস্থা অবগত হওয়ার পথে স্থান অথবা সময়ের দূরত্ব অন্তরায় হয় না। আর কাশ্ফে ইলাহী হচ্ছে ইল্ম, গুপ্ত রহস্য, মারিফাত, সুলুক বা ত্বরীকত সম্পৃক্ত। আল্লাহ পাক-এর জাত ও সিফত সম্পৃক্ত। যা অন্তরে উদয় হয়। আলমে মিসাল তথা রূপক জগতের বিষয়গুলো আকৃতি ধারণ করত: কল্বে উদ্ভাসিত হয়। আর্শ্চযজনক বিষয়সমূহ এবং বিশেষ বিশেষ হাল তথা যাওক, শওক, মহব্বত, আকর্ষণ, ভয়-ভীতি, হুকুম-আহকামের গুপ্ত রহস্য উদঘাটিত হয়। আল্লাহ পাক এবং বান্দার মধ্যকার সুন্দর সম্পর্ক মুয়ামালা ইত্যাদি অন্তরে; বিকশিত হয়।, যার স্বাদ ও পুলকের সামনে সারা পৃথিবীর রাজত্ব ধূলিকনা সাদৃশ্য হয়ে উঠে।
কাশ্ফে কাওনী যোগী সন্নুাসীরাও সাধনার দ্বারা হাছিল করতে পারে। কিন্তু কাশ্ফে ইলাহী, ওলী আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেহ লাভ করতে পারে না। (তা’লীমুদ্দীন, তাসাউফ ও সুলুক, শরীয়ত ও ত্বরীকত)।
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১৪)