ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯৪)

সংখ্যা: ১৪৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

 ৪৬। “পীর ছাহেব ক্বিবলার সাক্ষাতকালে কদমবুছী করবে। বিদায় নেয়ার সময়ও কদমবুছী করে বিদায় নিবে।”

قدم ‘কদম’ শব্দটি আরবী। এর অর্থ ‘পা।’ আর بوسه ‘বুছা’ শব্দটি ফার্সী। অর্থ চুম্বন করা। পায়ে চুম্বন করাকে ‘কদমবুছী’ বলে। কিন্তু প্রচলিত অর্থে কদমবুছী বলতে আমাদের দেশে হাত দিয়ে পা স্পর্শ করে হাতে চুমু খাওয়ার যে প্রচলন তা মূলত: কদমবুছী নয় বরং তা দস্তবুছী। কদমবুছীর প্রাসঙ্গিক আলোচনা অনেক। কদমবুছীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখিয়েছেন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কদম মুবারকে সরাসরি চুম্বন বা বুছা দিতেন তাঁরা। মূলত: তখন থেকেই কদমবুছীর প্রচলন হয়। যদিও একটি মহল কম আক্বল কম বুঝ তথা ইলমী স্বল্পতার কারণে কদমবুছীকে নাজায়িয ও র্শিক মনে করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তা আদৌ সত্য ও দলীলযুক্ত নয়। বরং কদমবুছীর পক্ষে নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লাহ রয়েছে অনেক। হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত যায়েদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যিনি আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন,

لما قدمنا المدينة فجعلنا نتبادر من رواحلنا فنقبل يد رسول الله صلى الله عليه وسلم ورجله.

অর্থঃ- “আমরা যখন মদীনা শরীফে আসলাম তখন তাড়াতাড়ি করে নিজেদের সওয়ারী হতে নামলাম। অত:পর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাত মুবারক এবং পা মুবারকে চুম্বন করলাম।” (আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত) হযরত সাফওয়ান ইবনে আস্সাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,

ان قوما من اليهود قبلوا يد النبى صلى الله عليه وسلم ورجليه.

অর্থঃ- “একবার ইয়াহুদীদের একটি দল এসে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উভয় হাত মুবারক ও পা মুবারকে বুছা (চুম্বন) দিলো।” (আবূ দাউদ শরীফ, নাসাঈ শরীফ, ইবনে মাজাহ, তিরমিযী) হযরত ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি উক্ত হাদীছ শরীফখানাকে হাসান-সহীহ বলেছেন। হযরত বুরাইদাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, গাছের সিজদা দেয়ার ঘটনার পর একদিন আমি আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে আরজ করলাম- ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে আপনার উভয় হাত মুবারক এবং পা মুবারকে বুছা (চুম্বন) দেয়ার অনুমতি দিন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দিলেন, অত:পর তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উভয় হাত মুবারকে এবং পা মুবারক বুছা (চুম্বন) দিলেন।” (নাসীমুর রিয়াজ শরহে শিফা)

হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু  তায়ালা আনহুগণের পরস্পরের   মধ্যেও কদমবুছীর প্রচলন ছিলো

 বিশিষ্ট ছাহাবী, হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা রয়েছে যে,

انه قبل يد انس واخرج ايضا ان عليا قبل يد العباس ورجله.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর হাত মুবারকে বুছা (চুম্বন) দিয়েছেন। তিনি এটাও বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয়ই হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর হাত ও পা মুবারকে বুছা (চুম্বন) দিয়েছেন।” (ফতহুল বারী, তুহফাতুল আহ্ওয়াজি, আল বাইয়্যিনাত)

পিতা-মাতার কদমবুছী করাও

সুন্নত এবং ফযীলতের কারণ

 আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁদের পিতা-মাতার কদমবুছী (পদচুম্বন) করতে। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من قبل رجل امه فكانما قبل عتبة الجنة.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি তার মায়ের কদমবুছী (পদচুম্বন) করলো সে যেন জান্নাতের চৌকাঠে চুম্বন করলো।” (মাবছুত লিস্ সারাখ্সী)

ইমাম-মুজতাহিদ এবং আউলিয়ায়ে কিরামগণের মাঝেও কদমবুছীর প্রচলন রয়েছে

 হযরত ছাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনগণের অনুসরণ-অনুকরণ কল্পে পরবর্তীতে ইমাম-মুজতাহিদ এবং আউলিয়ায়ে কিরামগণও কদমবুছী (পদচুম্বন) করেছেন এবং নিয়েছেন। তাঁদের কাছে যদি কেউ কদমবুছী কিংবা দস্তবুছী করার আবেদন করতেন তাঁরা তাদেরকে তা করার অনুমতি দিতেন। বলতেন, এরূপ অনুমতি প্রদান আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নত। চিশ্তীয়া তরীক্বার মাশায়িখগণের মাঝে কদমবুছীর এতো অধিক প্রচলন ছিলো যে,  তাঁরা স্বীয় পীর ছাহেবের কদমবুছী (পদচুম্বন) করতে পারাকে বিশেষ নিয়ামত প্রাপ্তি মনে করতেন। যখনই কোন সালিক পীর ছাহেবের দরবার শরীফে যেতেন তখনই পীর ছাহেবের কদমবুছী করতেন।  শাইখুল মাশায়িখ, সুলতানুল আউলিয়া হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থাৎ- বুধবার আমার পীর ছাহেব সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কদমবুছীর বরকত নছীব হলো।” (দলীলুল আরিফীন) চিশ্তীয়া তরীক্বার ইমাম, ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত, হাবীবুল্লাহ, সুলতানুল মাশায়িখ, কুতুবুল আকতাব, কুতুবুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি একবার দিল্লীতে আসলেন। তাঁর প্রধান খলীফা শাইখুল মাশায়িখ, সুলতানুল আরিফীন হযরত বখতিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফে হাজির হলেন। কদমবুছী করার জন্য দিল্লীর লোকেরা দলে দলে তাঁর খিদমতে ভিড় জমালো। সুলতান আলতামাশ রহমতুল্লাহি আলাইহিও আসলেন। কিন্তু শাইখুল আলম, বাবা ফরীদুদ্দীন গঞ্জে শকর রহমতুল্লাহি আলাইহি আসলেন না। সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। শাইখুল মাশায়িখ হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, সে রিয়াজত-মুশাক্কাতে রত রয়েছে। এটা শুনে তিনি বললেন, তুমি সত্যি বখ্তিয়ার। এমন ‘শাহ্বায’কে কবলে এনেছ যার বাস ‘সিদরাতুল মুন্তাহার’ এদিকে নয়। এমন লোকের উপর আর কঠোরতা করা সমীচীন নয়। তাঁর রিয়াজত-মুশাক্কাত বন্ধ করে দেয়া উচিত। অত:পর তাঁরা উভয়েই শাইখুল আলম, বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর হুজরা শরীফে গেলেন এবং বাবা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহিকে উভয়ের মাঝে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া করলেন, ‘আল্লাহ পাক! আপনি ফরীদকে কবুল করুন।’ গায়েব হতে আওয়াজ আসলো, ‘আমি ফরীদকে কবুল করলাম।’ তারপর তাঁরা উভয়ে তাঁকে অনেক ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ দান করলেন এবং বললেন, ‘ফরীদ এমন একটি প্রদীপ যা আমাদের সিলসিলাকে আলোকিত করবে এবং যুগের অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হবে। সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহিও তাঁকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন। এই বরকতে আজ পর্যন্ত তাঁকে ‘বাবা’ লক্ববে সম্বোধন করা হয়।  ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ প্রদানের পর শাইখুল মাশায়িখ হযরত বখ্তিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘তোমার দাদা পীর ছাহেব, তাঁর কদমবুছী করো।’ শাইখুল আলম, বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি গিয়ে স্বীয় পীর ছাহেব হযরত বখতিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কদমবুছী করলেন। তিনি আবার আদেশ করলেন, ‘তোমার দাদা পীর ছাহেব সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কদমবুছী করো।’ এবারো তিনি স্বীয় পীর ছাহেব শাইখুল মাশায়িখ হযরত বখতিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কদমবুছী করলেন। হযরত বখতিয়ার ক্বাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবার একটু ধমকের স্বরে বললেন, ‘আমি তোমাকে তোমার দাদা পীর ছাহেব সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কদমবুছী করতে বলছি। আর তুমি করছ আমার কদমবুছী তার কারণ কি?’ বিনিত-বিনম্র স্বরে জাওয়াব দিলেন শাইখুল আলম হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর রহমতুল্লাহি আলাইহি। ‘আমি আপনার কদম মুবারক ব্যতীত আর কোন কদম মুবারক দেখতে পাচ্ছিনা’ শাইখুল আলম, হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এরূপ জাওয়াব শুনে সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, বখতিয়ার! মাসউদ ঠিকই বলেছে। সে মঞ্জিলে মাকছুদে পৌঁছেছে। সেখানে এক ভিন্ন দ্বিতীয়ের কোন অস্তিত্বই নেই। কাজেই সেখানে তুমি ভিন্ন আমি তাঁর দৃষ্টি পথে আসবো কেন?  (তাযকিরাতুল আউলিয়া) (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)