-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
প্রসঙ্গ: স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।
পূর্ব প্রকাশিতের পর
সে বললো, হুযূর! এটার কি হাক্বীক্বত? আপনারটা আতর-গোলাপের ঘ্রাণ, আর আমারটার মধ্যে দুর্গন্ধ তার কি হাক্বীক্বত? উনি বললেন- তার হাক্বীক্বত কি জান? তুমি কি করে এটা হাসিল করেছ বলো তো দেখি? সে বললো- আমি সব সময় আমার নফসের বিরোধিতা করি। যার বদৌলতে আমি এটা হাসিল করতে পেরেছি। উনি বললেন- তাই নাকি। আচ্ছা আমি যদি তোমাকে বলি তুমি এখন ঈমান আন। কালিমা শরীফ পড়তো দেখি। কালিমা শরীফ পড়ে তুমি ঈমান আন। সে তখন সমস্যায় পড়ে গেল। কারণ সবসময় সে তার নফসের বিরোধিতা করে। এখন তার নফস চায় না সে কালিমা শরীফ পড়ুক। উনি বললেন- তুমি কালিমা শরীফ পড়, তাহলে তুমি তার হাক্বীক্বত বুঝবে। সে বললো- আমার নফস তো সেটা চায় না। উনি বললেন- দেখ তোমার এত বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট বৎসরের সাধনা তুমি নফসের বিরোধিতা করে এটা হাসিল করেছ, এখন যদি তুমি নফসের বিরোধিতা না কর, তার পক্ষে থাক, তোমার এটা নষ্ট হয়ে যাবে। এখনই তোমার বিরোধিতা করা উচিত। তখন সে উনার কথায় তার এই জিনিসগুলি ঠিক রাখার জন্য সে কালিমা শরীফ পাঠ করলো।
لا اله الا الله محد رسول الله صلى الله عليه وسلم
পাঠ করে সে মুসলমান হয়ে গেল। মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর উনি বললেন- ঠিক আছে এক কাজ কর, এবার তুমি আবার পানি হও, সে আবার পানি হলো উনি একটু পানি আবার রেখে দিলেন, সে যখন আবার স্বাভাবিক মানুষ হলো, তাকে ঘ্রাণ নিতে দিলেন। দেখলো আতর-গোলাপের গন্ধ। সুবহানাল্লাহ! আতর-গোলাপের ঘ্রাণ হয়ে গেছে তোমার মধ্যে, কি ব্যাপার।
انما الـمشركون نجس
নিশ্চয়ই মুশরিক কাফির যারা, তারা নাপাক তাদের থেকে দুর্গন্ধ বের হবে। এখন এটা ফিকিরের বিষয়। যেটা আমার বলার উদ্দেশ্য হলো- এই যুগী ব্যক্তিটা জীবনভর নফসের বিরোধিতা করে সে কিছু হাসিল করেছে এবং ঠিক কালিমা শরীফও নফসের বিরোধিতা করতে গিয়ে সে পাঠ করলো। যার বদৌলতে আল্লাহ পাক তাকে ঈমান দিয়ে দিলেন, সে আল্লাহওয়ালা হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ!
এজন্য বলা হয়েছে-
واما من خاف مقام ربه ونهى النفس عن الهوى فان الجنة هى الماوى.
“যে আল্লাহ পাক-এর দরবারে দাঁড়ায়ে জাওয়াব দিতে ভয় করবে এবং নফসের বিরোধিতা করবে তার স্থান হবে মাওয়া বেহেশ্ত।” হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন বললেন- হুযূর! আমি তখন থেকে সবসময়ই নফসের বিরোধিতা করি। সবসময় নফসের বিরোধিতা করি এবং আল্লাহ পাক-এর দরবারে দাঁড়ায়ে জাওয়াব দিতে ভয় করি। তখন উনার পীর ও মুর্শিদ ছাহেব হযরত শাক্বীক্ব বল্খী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন যে, তুমি উত্তম মাসয়ালা শিক্ষা করেছ।
তোমার তিন নাম্বার মাসয়ালাটা কি? তখন উনি বললেন, হুযূর! আমি আবার ফিকির করতে লাগলাম। কুরআন শরীফ আবার রিসার্চ করতে লাগলাম। রিসার্চ করতে করতে আমি একটা আয়াত শরীফ পেয়ে গেলাম। কি আয়াত শরীফ? আল্লাহ পাক বলেন,
ما عندكم ينفذ وما عند الله باق
“তোমাদের কাছে যেটা রয়েছে, সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমার কাছে যেটা রয়েছে সেটা স্থায়িত্ব লাভ করবে।”
এই প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়। একদিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা ছাগল যবেহ্ করেছিলেন। যবেহ্ করে ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও কোন কাজে গিয়েছিলেন। বাইরে থেকে এসে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-কে জিজ্ঞেস করলেন, “হে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা! আমি যে ছাগলটা যবেহ্ করেছিলাম সেটার কিছু আছে কি?” উনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! সব কিছু দান করে দেয়া হয়েছে, একটা কাঁধ রয়েছে, একটা কাঁধ। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা! আপনি বলুন, কাঁধটাই নেই, বাকী সব রয়েছে।” কাঁধটাই নেই সব রয়েছে। তার অর্থ যেটা দান করে দেয়া হয়, সেটাই থেকে যায়। আর যেটা দান করা হয় না, সেটা মূলতঃ থাকে না।
ما عندكم ينفذ وما عند الله باق
যেটা আমাদের কাছে রয়ে গেলো, দান করা হলোনা, সেটা মূলতঃ থাকলো না। যেটা দান করে দেয়া হলো সেটাই মূলতঃ রয়ে গেল। হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, হে আমার শায়খ! আমি যখন এই আয়াত শরীফ পেলাম, তখন আমার তৌফিক আন্দাজ, আমার সামর্থ্য অনুযায়ী আমার যা ছিল ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা সম্পদ ছিল তা আমি আল্লাহ পাক-এর রাস্তায় দান-খয়রাত করে দিলাম। যেহেতু আল্লাহ পাক-এর নিকট সেটা জমা থাকবে, সেজন্য আমি বেশি বেশি দান-খয়রাত করলাম এবং এখনো আমি আমার তৌফিক আন্দাজ দান-খয়রাত করে থাকি। (সুবহানাল্লাহ) হযরত শাক্বীক্ব বল্খী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, হে হাতেম! তুমি তো উত্তম মাসয়ালা শিক্ষা করেছ।
তোমার চতুর্থ নাম্বার মাসয়ালাটা কি? হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন- হুযূর! আমার চতুর্থ নাম্বার মাসয়ালা হলো- আমি আবার কুরআন শরীফ ফিকির করতে লাগলাম, কুরআন শরীফ রিসার্চ করতে লাগলাম। আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম মানুষের মধ্যে। সেটা হলো- মানুষ সম্মান তালাশ করে, ইজ্জত তালাশ করে, বিশেষ করে মানুষ ধন দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, বাড়ি দিয়ে, গাড়ি দিয়ে, আল-আওলাদ দিয়ে সম্মান তালাশ করে। কিন্তু আল্লাহ পাক বলেন,
ان اكرمكم عند الله اتقكم
“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, যে বেশি মুত্তাক্বী।” যে বেশি পরহিযগার ও মুত্তাক্বী সেই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। মুত্তাক্বী কাকে বলা হয়? সবচেয়ে বড় মুত্তাক্বী হলেন- আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এজন্য আল্লাহ পাক কুরআন শরীফ-এ বলেন-
قل ان كنتم تحبون الله فاتبعونى يحببكم الله ويغفرلكم ذنوبكم والله غفور رحيم.
অর্থ: “আল্লাহ পাক বলেন, “হে আমার হাবীব! আপনি বলে দিন যদি তোমরা আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত চাও, আল্লাহ পাক-এর ভালবাসা চাও, তাহলে আমার ইত্তিবা কর, আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ পাক তোমাদেরকে মুহব্বত করবেন, তোমাদের গুনাহখাতা ক্ষমা করবেন এবং তোমাদের প্রতি দয়ালু হয়ে যাবেন।” কারণ আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সবচেয়ে বড় মুত্তাক্বী। আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ অনুকরণ যে করবে, সেই হাক্বীক্বী সম্মানিত হবে। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুমগণ পৃথিবীতে হযরত নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের পরে শ্রেষ্ঠ মানুষ। হযরত নবী আলাইহিমুস্ সালামগণের পরে উনারা শ্রেষ্ঠ মানুষ কেন? উনারা হুযূর পাক ছলাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ এবং অনুকরণ করেছেন। মেছাল স্বরূপ বলা হয়ে থাকে- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনি সুন্নতের বেশি অনুসরণ করতেন। একদিন উনি উনার ছাত্র হযরত ইমাম নাফে’ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সাথে যাচ্ছিলেন। আরো কিছু ছাত্র ছিল। একস্থানে গিয়ে উনি উনার মাথাটা একটু নোয়ালেন আবার মাথাটা তুললেন। উনার ছাত্ররা বললো, হুযূর! আপনি এখানে কেন মাথা নোয়ালেন? হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, হে আমার সঙ্গী-সাথীরা তোমরা জেনে রাখ, আমরা যখন আল্লাহ পাক-এর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে এই রাস্তা দিয়ে সফর করতাম, এখানে একটা গাছের ডালা ছিল। এখানে যখন আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসতেন, মাথা মুবারক নোয়াতেন এবং মাথা মুবারক তুলতেন। যদিও গাছের ডালাটা আজকে নেই। সেই সুন্নত পালনের জন্যই আমি আমার মাথাটা নোয়ালাম এবং তুললাম। (সুবহানাল্লাহ্) উনারা সুন্নাতের কতটুকু পাবন্দী ছিলেন। এজন্য আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
من تمسك بسنتى عند فساد امتى فله اجر مأة شهيد
“যে আমার উম্মতের ফিতনা-ফ্যাসাদের যুগে একটা সুন্নতকে আঁকড়িয়ে ধরে রাখবে দায়িমীভাবে অর্থাৎ তার মৃত্যু পর্যন্ত একটা সুন্নতকে আঁকড়িয়ে ধরে থাকবে, তাকে আল্লাহ পাক একশ’ শহীদের ফযীলত দান করবেন।” (সুবহানাল্লাহ) একশ’ শহীদ। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! একশ’ শহীদ, কেমন একশ’ শহীদ? আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমাদের মত এক’শ শহীদের ফযীলত দেয়া হবে।” (সুবহানাল্লাহ) একশ’ শহীদের ছওয়াব দেয়া হবে একটা সুন্নতকে আঁকড়িয়ে ধরে থাকার কারণে। হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন- তখন থেকে আমি বেশি বেশি সুন্নতের ইত্তিবা করতে লাগলাম অর্থাৎ তাক্বওয়া বেশি করে অবলম্বন করতে লাগলাম। কারণ সুন্নত ছাড়া হাক্বীক্বী মুত্তাক্বী হওয়া সম্ভব নয়। যে যত বেশি সুন্নতের ইত্তিবা করবে সে ততবড় মুত্তাক্বী, পরহিযগার, আল্লাহওয়ালা হবে। (অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৭)
-ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার- মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩০)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩১)