ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল ল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৪৯)

সংখ্যা: ১৯০তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গ: স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

(৩) রিয়াজত-মাশাক্কাত

দশটি মাক্বাম হাছিলের অভিলাসী মুরীদের তৃতীয় করণীয় হচ্ছে রিয়াজত-মাশাক্কাত। শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার ছোহবত ইখতিয়ার, যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দিগী সুসম্পন্ন করার জন্য দুঃখ, কষ্ট, তাকলীফ সহ্য করা তথা রিয়াজত-মাশাক্কাত করা আবশ্যক। হযরত হাতেম আসেম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শায়খ-এর ৩৩ বছর ছোহবত ইখতিয়ার করেছিলেন।

যিকির-ফিকির ও রিয়াজত-মাশাক্কাত করেছিলেন। উনার জীবনের সেই ঘটনাটি আগত অনাগত সকল মুরীদের জন্যই উপদেশস্বরূপ। হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ উত্তরকালে সকল মাশায়িখে ইজাম স্ব স্ব মুরীদদেরকে উনার সেই ঘটনাটি বর্ণনা করে শুনাতেন। যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, ম্হুইস সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী, তিনিও নছীহতস্বরূপ উক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। এবং তার অতি সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। যা অত্র নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হলো-

(ধারাবাহিক)

উনি বললেন যে, হুযূর আমি তখন আবার ফিকির করতে লাগলাম, কুরআন শরীফ-এর মধ্যে ফিকির করতে করতে একটা আয়াত শরীফ আমার নজরে আসল।

আল্লাহ পাক বলেছেন-

واما من خاف مقام ربه ونهى النفس عن الهوى فان الجنة هى الماوى.

অর্থাৎ আল্লাহ পাক বলেন, “যে আমার দরবারে দাঁড়ায়ে জাওয়াব দিতে ভয় করে এবং নফসের বিরোধিতা করে, তার স্থান হবে মাওয়া বেহেশত।” (সুবহানাল্লাহ) যে আমার দরবারে দাঁড়ায়ে জাওয়াব দিতে ভয় করে এবং নফসের বিরোধিতা করে তার স্থান হবে মাওয়া বেহেশত। উনি বললেন- আমি যখন এই আয়াত শরীফ পেলাম, তখন আমি আল্লাহ পাক-এর দরবার শরীফে দাঁড়িয়ে জাওয়াব দিতে ভয় করতে লাগলাম এবং নফসের বিরোধিতা করতে লাগলাম।

এই প্রসঙ্গে বলা হয় যে, খলীফা হারুনুর রশীদের একটা ঘটনা। খলীফা হারুনুর রশীদ। মোটামুটি তার ইল্ম কালাম ছিল, কিছু আমলও তার ছিল। আর তার স্ত্রী জোবায়দা বেগম, সেও নেককার মহিলা ছিল। একদিন খলীফা হারুনুর রশীদের সাথে তার স্ত্রীর কিছু কথা কাটাকাটি হয়। স্ত্রী সবসময় চাইত খলীফা হারুনুর রশীদ যেন সৎমত, সৎপথে চলে। কিন্তু হারুনুর রশীদের একজন সভাসদ ছিল। সে তাকে ওয়াস্ওয়াসা দিত। খলীফা হারুনুর রশীদ কোন একটা কাজের কথা বললো। বলার পরে তার স্ত্রী জোবায়দা বেগম বললো যে- আপনি যদি এই কাজ করেন, তাহলে আপনি জাহান্নামী হবেন। এই আমল যদি আপনি করেন, এটা জাহান্নামীর লক্ষণ আপনি জাহান্নামী হবেন। যখন স্ত্রী একথা বললো, হারুনুর রশীদ একটু উত্তেজিত হয়ে গেল। সে বললো- তুমি আমাকে জাহান্নামী বললে কেন? সে বললো, একাজ করলে আপনাকে জাহান্নামে যেতে হবে। তখন সে বললো- আমি যদি জাহান্নামী হই, তাহলে তোমাকে আমি এখনই তালাক দিয়ে দিলাম। যখন একথা বলে ফেললো হারুনুর রশীদ, তখন তার স্ত্রী আলাদা হয়ে গেল, জুদা হয়ে গেল। সে বললো আপনি আমার কাছে আর আসবেন না। কারণ আপনি জাহান্নামী হলে, আমি তালাক হয়ে যাই। এখন আপনি জাহান্নামী না জান্নাতী তার ফায়সালা কে করবে? কে তার ফায়সালা করবে? তখন হারুনুর রশীদ সমস্ত আলিমদের দরবারে দরবারে ঘুরতে লাগলো এই মাসয়ালার জন্য। যে হারুনুর রশীদ! সে জাহান্নামী না জান্নাতী। কিন্তু কোন আলিম সেই ফায়সালা দিলেন না এই হেতু, কারণ জাহান্নামী এবং জান্নাতী কি করে ফায়সালা করা যাবে? শেষ পর্যন্ত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছে গিয়ে পৌঁছালো সেই হারুনুর রশীদ। গিয়ে বললো, হুযূর! এটা আপনাকে যেভাবে হোক ফায়সালা করে দিতেই হবে। উনি বললেন, ঠিক আছে অসুবিধা নেই। আপনাকে  আমি কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো, তার জাওয়াব দিতে হবে। কি প্রশ্ন? প্রশ্ন হলো- আচ্ছা আপনি বলুনতো, আপনার জীবনে কোন সময় কখনও আল্লাহ পাক-এর ভয়ে খারাপ কাজ থেকে বিরত রয়েছেন কিনা? আল্লাহ পাক-এর ভয়ে কোন খারাপ কাজ থেকে বিরত রয়েছ কিনা? হারুনুর রশীদ বললো যেহেতু আমি বাদশাহ আমার এই রকম অনেক সুযোগ ঘটেছে খারাপ কাজ করার জন্য। কিন্তু আমি একমাত্র আল্লাহ পাক-এর ভয়ে পাপ কাজ থেকে বিরত রয়েছি। তখন ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন- যে ঠিক আছে, আপনার স্ত্রী তালাক হয়নি, আপনি তার সাথে ঘর-সংসার করতে পারবেন।

যে আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে বলেছেন-

واما من خاف مقام ربه ونهى النفس عن الهوى فان الجنة هى الماوى.

আল্লাহ পাক বলে দিয়েছেন, “যে আল্লাহ পাক-এর দরবারে দাঁড়ায়ে জাওয়াব দিতে ভয় করে এবং যে নফসের বিরোধিতা করে, তার স্থান হবে মাওয়া বেহেশ্ত।”

যেহেতু হে খলীফা হারুনুর রশীদ আপনি আল্লাহ পাক-এর দরবারে দাঁড়ায়ে জাওয়াব দিতে ভয় করেছেন এবং নফসের বিরোধিতা করেছেন, সেহেতু আপনাকে তো জাহান্নামী বলা যায় না। কাজেই আপনার স্ত্রী তালাক হয়নি, সমস্ত আলিম সম্প্রদায় যখন সেটা শুনলেন, উনারা সেটা মেনে নিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেক কাজেই আল্লাহ পাক-এর দরবারে দাঁড়ায়ে জাওয়াব দেওয়ার ভয় করতে হবে এবং নফসের বিরোধিতা করবে। নফসের তাবেদারী করা যাবে না। কোন ব্যক্তি যদি নফসের তাবেদারী করে, তাহলে তার পক্ষে কখনও কুরআন শরীফ এবং সুন্নাহ শরীফ-এর উপর কায়িম থাকা সম্ভব হবে না। কুরআন শরীফ এবং সুন্নাহ শরীফ-এর প্রতি কায়িম থাকা যাবে না, এজন্যই আর একটা ওয়াকিয়া উল্লেখ করা হয়। হযরত আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহমতুল্লাহি আলাইহি যিনি খুব বড় বুযুর্গ আল্লাহ পাক-এর ওলী ছিলেন, যিনি হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর পিতা শায়খ আব্দুল আহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর পীর ছাহেব ছিলেন। সেই হযরত আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহমতুল্লাহি আলাইহি খুব বড় আল্লাহ পাক-এর ওলী বুযুর্গ ছিলেন। উনি একদিন সফরে যাচ্ছিলেন, এক পাহাড়িয়া এলাকা দিয়ে সফর করে। ভ্রমণ করছিলেন এক পাহাড়ি এলাকায়। গিয়ে দেখলেন, এক পাহাড়ের গুহার কাছে কিছু লোক জমা হয়ে রয়েছে, অর্থাৎ কিছু লোক জমা হয়ে রয়েছে পাহাড়ের কাছে। উনি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- হে ব্যক্তিরা তোমরা যে পাহাড়ের এখানে জমা হয়ে রয়েছ, কি কারণ? লোক নেই জন-মানবহীন এলাকা। এখানে তোমরা কি কর? লোকেরা জবাব দিল যে হুযূর! এই পাহাড়ের এই গুহার ভিতরে একজন লোক থাকে। এক সাধক থাকে সে বৎসরে একদিন বের হয়। বের হয়ে মানুষেরা তেল-পানি ইত্যাদি যা নিয়ে আসে এগুলিতে ফুঁ দেয়। সেগুলি ফুঁ দিলে, যে যে নিয়তে নিয়ে আসে সেই নিয়তটা তার পুরা হয়, হাসিল হয়। আমরা এসেছি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সাধক বের হয়ে আসবে। আসলেই আমরা সেগুলি ফুঁ নেওয়াবো, সেই ব্যক্তি ফুঁ দিলে আমরা এগুলি নিয়ে চলে যাব। উনি বললেন যে, কোথায়? এই পাহাড়ের ভিতর একটা গুহা আছে। গুহার মধ্যে কোন দরজা-জানালা নেই। একটা মাত্র ছিদ্র আছে। হযরত আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, তাহলে এই লোকটা বের হয় কি দিয়ে? তারা বললো যে, হুযূর! এই লোকটা একটি ছিদ্র দিয়ে বের হয়। ছিদ্র দিয়ে আবার প্রবেশ করে। আশ্চর্য ব্যাপার। কোন দরজা নেই কোন জানালা নেই বের হওয়ার মত। কিন্তু একটা মাত্র ছিদ্র, ছোট্ট একটা ছিদ্র। যেটা দিয়ে বের হয় এবং প্রবেশ করে। লোকটা ছিল যুগী।

হযরত আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহমতুল্লাহি আলাইহি চিন্তা করলেন, লোকটা তো মানুষকে গুমরাহ্ করছে। উনি করলেন কি, উনি যেহেতু আল্লাহ পাক-এর ওলী বুযুর্গ ছিলেন, উনি বাতাস  হয়ে গেলেন। বাতাস হয়ে উনি ঠিক ঐ ছিদ্র দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। করে দেখেন, সে যুগী ভিতরে বসা আছে, সে বের হবে। উনি যখন ভিতরে প্রবেশ করলেন উনাকে দেখে সেই যুগী বললো- তুমি কে এখানে প্রবেশ করলে? কার পারমিশনে তুমি এখানে আসলে?

হযরত আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, দেখ আমি অমুক আব্দুল কুদ্দুস। আমি একজন মুসলমান, তোমার এখানে আমি এসেছি। তুমি এখানে কি কর? সে ব্যক্তি বললো যে, আমার এখানে তো কারো আসার পারমিশন নেই। কেন আপনি এখানে প্রবেশ করলেন? উনি বললেন, প্রবেশ করলাম তোমার বুযুর্গী দেখার জন্য। তুমি ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ কর, ছিদ্র দিয়ে বের হও। মানুষ তোমার ভক্ত হচ্ছে। মানুষ গুমরাহ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, সেটা তোমাকে বলার জন্য। সে বললো যে হ্যাঁ, আমি সাধনা করে এটা হাসিল করেছি। এটা আমার হক্ব, আমার প্রাপ্য। তখন হযরত আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাকে বললেন ঠিক আছে, তুমি সাধনা করেছ, আচ্ছা তুমি একটা কাজ করতে পার? অর্থাৎ আমি যা বলবো তুমি সেটা হতে পারবে? তুমি কি পানি হতে পার? সে ব্যক্তি বললো, হ্যাঁ আমি পানি হতে পারি। উনি বললেন- যে তুমি পানি হও তো দেখি। সে পানি হলো। উনি করলেন কি উনার যে রুমাল ছিল, রুমাল দিয়ে অল্প একটু পানি ভিজায়ে রাখলেন। অতঃপর সে আবার যখন স্বাভাবিক মানুষ হয়ে গেল। তখন উনি বললেন- এক কাজ কর, আমি এখন পানি হব, তখন তুমি তোমার একটা কাপড়ের টুকরা দিয়ে সেখান থেকে কিছু পানি রেখে দিও, সে বললো ঠিক আছে। উনি পানি হলেন, সে কিছু পানি রেখে দিল। উনি আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে গেলেন, যখন স্বাভাবিক মানুষ হলেন, তখন বললেন, কোথায় পানিটা রেখেছ সেটা দেখাও তো? সে একটা কাপড় ভিজা দেখাল, সেখানে আতর-গোলাপের ঘ্রাণ। আর তার যে পানি রাখা হয়েছিল সেটা দেখানো হলো। দেখতো এটা কিসের ঘ্রাণ? এখানে দেখা যায় দুর্গন্ধ, মল-মূত্রের গন্ধ। (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৭)

-ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার- মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৮)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১২৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৩১)