প্রসঙ্গ : স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-উনার মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।
রিয়াযত-মাশাক্কাত করার
শক্তি হাছিলের উপায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
কান
হুজ্জাতুল ইসলাম, মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার ‘মিনহাজুল আবিদীন’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন, শ্রবণ শক্তি, শ্রবণেন্দ্রিয়কে গান-বাজনা, গীবত ইত্যাদি আজে বাজে ব্যাপার থেকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তার কারণ দুটি। এক. শ্রোতা বা বক্তার সাথে জড়িত হয়। বিভিন্ন পথের ভিতর থেকে মাঝের সোজা পথটি বেছে নিয়ে সংশয়পূর্ণ অলি-গলি থেকে দূরে থাকতে হবে। পথের সীমা কখনো অতিক্রম করা যাবে না। তেমনি নিজের কানকেও খারাপ কথা শোনা থেকে দূরে রাখতে হবে। একইভাবে জিহ্বাকেও খারাপ কথা বলা থেকে বাঁচাতে হবে। কারণ, খারাপ কথা শুনলে তার প্রভাব কিছু না কিছু দেখা দিবেই এবং বক্তার সাথে নিজকেও জড়িয়ে ফেলবে। তাই সতর্ক থাকা চাই।
দ্বিতীয় কারণ হল: কুমন্ত্রণা কানের ভিতর দিয়ে অন্তরে পৌঁছে। যার ফলে কামনা-বাসনা উদ্দীপ্ত হয় এবং বাজে কাজে জড়িয়ে গিয়ে আল্লাহ পাক উনার ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির থেকে মানুষ দূরে সরে যায়।
যেসব কথাবার্তা মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে, তা ঠিক পেটে দেয়া খাদ্যের মত। তাই তা ক্ষতিকরও হতে পারে, কল্যাণকরও হতে পারে। সুখাদ্যের স্থলে বিষ হলে অবশ্যই তা বেশ ক্ষতিকর হবে। খাদ্যের চেয়েও কথার প্রভাব অনেক বেশি। কারণ, খাদ্য পাকস্থলীতে গিয়ে ঘুম ও কাজকর্মের দ্বারা হজম হয়ে যায়। অধিকাংশ সময়ে তার প্রভাব নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্যে থাকে তারপরই শেষ হয়ে যায়। কোনরূপ গোলমাল দেখা দিলে ওষুধ রয়েছে যা সেবন করা মাত্র ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু যে কথা মনের মণিকোঠায় আশ্রয় নেয়, অনেক সময় দেখা যায়, তা তার জীবনভর থেকে যায়। সে কখনো তা ভুলতে পারে না। সুতরাং তা কোন খারাপ ও আজে বাজে কথা হলে, মানুষকে দুর্ভোগ ও হয়রানির ভিতরে ফেলে দেয়। তার ফলে অন্তরে এরূপ কামনা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তা থেকে মুক্ত হওয়া বা অন্তরকে পবিত্র করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন আল্লাহ পাক-উনার কাছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এমন সব বিপদ-আপদ উপস্থিত হয় যা জীবনের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর হয়ে থাকে। কাজেই, নিজের কানকে সে বাজে কথা থেকে বাঁচিয়ে রাখা আবশ্যক। অন্যথায় সে সব দুর্ভোগ আপদ থেকে নিরাপদে থাকা যাবে না। সাইয়্যিদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা তিনি বলেন, গীবত করা ও শুনা, চোগলখোরী করা এবং শুনা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। (রিসালাতুল মুসতারশিদীন/১৭৫)
শাইখুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ, ইমামুল মুত্তাক্বীন, সাইয়্যিদুনা হযরত আবু আব্দুল্লাহ হারিস মুহাসিবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি স্বীয় বিখ্যাত কিতাব ‘রিসালাতুল মুসতারসিদীন’-এর ১৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ইমামুল মুহাদ্দিসীন, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম ওয়াকী ইবনে জাররাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, আমি বিশ বছর পূর্বে একজন বিদয়াতীর কাছে একটি কথা শুনেছি। কিন্তু তা অদ্যাবধি আমার কান থেকে বের করে দিতে পারিনি। অর্থাৎ তার প্রভাব এখনো রয়েছে। সুলতানুল আরিফীন, ইমামুজ জালীল, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম তাউস রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে যখন কোন বিদয়াতী লোক আসতো তখন তিনি উনার কানদ্বয় বন্ধ করে দিতেন যাতে তার কোন কথা উনার কান মুবারকে পৌঁছতে না পারে। কানের সম্পর্কে একই কথা অর্থাৎ সর্বপ্রকার নাফরমানী থেকে হিফাযত করতে হবে।
জিহ্বা
জিহ্বাকে সংযত করা প্রয়োজন। কারণ, জিহ্বা নাফরমানী ও নির্লজ্জতার ব্যাপারে মানুষের চরম শত্রু এবং ফ্যাসাদ সৃষ্টির ব্যাপারে অনন্য।
হযরত সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একদিন আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার জন্য সবচেয়ে ভয় করার বস্তু কি? তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজ জিহ্বা মুবারক স্পর্শ করে বললেন, এটি। হযরত ইউনুস ইবনে আব্দুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন, বসরার প্রচ- গরমেও আমি রোযা রাখার শক্তি রাখি, কিন্তু বাজে কথা থেকে জিহ্বাকে ফিরিয়ে রাখার শক্তি পাই না। সুতরাং এজন্য রিয়াযত-মাশাক্কাত তথা সাধনা প্রয়োজন। এজন্য পাঁচটি নীতি অনুসরণ করা দরকার।
প্রথম নীতি: বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “মানুষ যখন সকালে ঘুম থেকে উঠে, তখন সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জিহ্বার দিকে ফিরে তাকে কসম দিয়ে বলে, যদি তুমি ঠিক থাক তাহলে আমরা ঠিক থাকতে পারবো যদি তুমি গোলমাল কর, তাহলে আমরাও গোলমালে পড়ে যাব।”
মূলত এই জিহ্বাই অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে শক্তি ও প্রেরণা যোগায়। কাজেই, তার উপরে মানুষের ভাল মন্দ নির্ভর করে। হযরত মালিক ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, যখন তুমি নিজের মধ্যে কাঠিন্য, দেহে আলস্য ও রুজিতে সংকীর্ণতা দেখবে তখন বুঝে নিবে, নিশ্চয়ই কোন বাজে কথায় লিপ্ত হয়েছিলে।
দ্বিতীয় নীতি হলো: মানুষ তার সময়ের মূল্য দেবে। কারণ, অধিকাংশ সময় মানুষ আল্লাহ পাক উনার কথা ভুলে আজে বাজে কথায় কাটিয়ে থাকে। ফলে, সময়ের অপচয় হয়। বর্ণিত আছে, হযরত হাসান ইবনে আবু সিনান রহমতুল্লাহি আলাইহি একটি নবনির্মিত কক্ষের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ কক্ষটি কবে তৈরি করলো? এ প্রশ্ন করেই তিনি নিজের মনকে থামিয়ে বললেন, হে দাম্ভিক, এ সব বাজে ব্যাপার নিয়ে কেন মাথা ঘামাচ্ছিস? তারপর তিনি মনকে শায়েস্তা করার জন্য এক বছর রোযা রাখলেন।
সুতরাং নিজ প্রবৃত্তির সংস্কার কামনা যারা করে তারাই ভাগ্যবান। পক্ষান্তরে যারা নিজ প্রবৃত্তিকে লাগামহীনভাবে রেখে দিয়েছে, তারা দুর্ভাগা বৈ নয়।
হযরত আকিল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি যথার্থই বলেছেন, আঁধার রাতে যখন তুমি একাকী অবকাশ নিতে যাবে, তখন দুরাকাত নফল নামায পড়াকে তুমি সৌভাগ্যের আলামত মনে করবে এবং বাজে কথা ও কাজে লিপ্ত হওয়ার বদলে তাছবীহ পড়বে ও চুপ থাকাকে অপরিহার্য করে নেবে। কথা বলার চেয়ে এটা অনেক উত্তম, যদিও তুমি খুব পা-িত্যপূর্ণ কথাও বল।
তৃতীয় নীতি হলো: পুণ্য কাজে লেগে থাকা। কারণ, যে ব্যক্তি কথা বেশি বলবে, সে অবশ্যই মানুষের গীবতে জড়িয়ে যাবে। তাই বলা হয়, কথা বেশি বললে ভুলও বেশি হয়। গীবত তো ইবাদত বরবাদ করে দেয়। বর্ণিত আছে, গীবতকারী যেন কামান দাগিয়ে তার ডান বামের ও আগে পিছের সব পুর্ণ উড়িয়ে দেয়।
ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত্ ত্বরীক্বত হযরত হাসান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জীবনীতে দেখা যায়, উনাকে বলা হলো, হে আবু সাঈদ! অমুক ব্যক্তি তোমার গীবত করছে। এ কথা শুনেই তিনি গীবতকারীর জন্যে একপাত্র খেজুর পাঠিয়ে দিলেন এবং তাকে এ কথা বলে পাঠালেন, তুমি আমাকে তোমার পুণ্য থেকে বেশকিছু অংশ উপহার দিয়েছ এবং আমি এ খেজুর দিয়ে তার বিনিময় আদায় করলাম।
ইমামুল মুহাদ্দিসীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে গীবত নিয়ে আলোচনা করা হলে, তিনি বললেন, আমি গীবত করলে নিজ মায়ের গীবত করব। কারণ, আমার পুর্ণের উপরে বেশি দাবি উনারই।
বর্ণিত আছে, হযরত হাতেম আছেম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার এক রাতের ইবাদত বাদ পড়ে গেলে, উনার স্ত্রী উনাকে মন্দ বলছিল। তখন তিনি বললেন, একদল মানুষ গত রাতে নামায পড়ে সকালে এসে আমার সাথে মিলিত হয়েছে। সুতরাং তাদের সব নামায কিয়ামতের দিন আমার পাল্লায় তোলা হবে।
হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
(অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৪)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৫) –
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৬)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)