ভাষান্তর: মাওলানা মুহম্মদ ফযলুল হক
(৮২০-৯০১ হিজরী)
পূর্ব প্রকাশিতের পর
কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-
افرايت من اتخذ الهه هواه.
অর্থ: æআপনি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখেছেন, যে ব্যক্তি তার কৃ-প্রবৃত্তিকে ইলাহ বানায়?” (সূরা জাছিয়াহ) সমস্ত কায়িনাত থেকে দিল উঠিয়ে নিয়ে বা অন্তর বিমুখ করে আন্তরিকতার সাথে মহান আল্লাহ পাক-উনার দিকে মুতাওয়াজ্জুহ হওয়া আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ও আওলিয়ায়ে কিরাম-উনাদের কাজ। এবং দুনিয়াবাসীরা কিছু জায়গা সম্পত্তি ও খানাপিনা তথা দুনিয়াবী সম্পদ কামাইয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কতিপয় চাকচিক্যময় অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হাক্বীক্বত এই পৃথিবী কারো অন্তর লাগানোর জায়গা নয়।
দুনিয়াদাররা ওলীআল্লাহ-উনাদেরকে এমনভাবে ভয় করে যেমনটি ভয় আল্লাহ পাক-উনাকেও করে না। আর দুনিয়াতে সাধারণভাবে এমন কোন লোক নেই যে, দুনিয়াবী সমস্ত কিছু থেকে নিজের ইতিক্বাদকে দূর করে শুধুমাত্র মহান আল্লাহ পাক-উনার প্রতি পরিপূর্ণ ভরসা করবে এবং এক মাস থেকে ছয়মাসে নিজের ইতিক্বাদ (বিশ্বাস) কে দুনিয়া থেকে খালি করবে। যদি কেউ এমনটি করে দেখাতে পারে তবে কাফিরদের ধারণা হবে বা তারা বুঝবে যে, আল্লাহ পাক-উনার উপর ভরসাকারীকে মহান আল্লাহ পাক কখনোই ক্ষতিগ্রস্ত করেন না। অর্থাৎ এমন ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ পাক অবশ্যই সাহায্য করেন। প্রকৃত বাহাদুর ও হাক্বীক্বী যুবকদের উচিত- দুনিয়াদারদের থেকে যুদা থাকা। মহান আল্লাহ পাক-উনার ফযল ও করম- এর প্রতি ভরসা রাখ। তবে মহান আল্লাহ পাক তোমাকে উঁচু মর্যাদা দান করবেন। যেমন তিনি তোমাকে ছোট থেকে বড়, বাল্যকাল থেকে যৌবনে পৌঁছিয়েছেন।
মাকতূব: আল্লাহ পাক-উনার নৈকট্য মাখলূকের সাথে। হে আমার ভাই ও বন্ধুগণ! আমি এই মাকতূবে রুবুবিয়্যত ও উলুহিয়্যাত বর্ণনা করবো। ঐ সকল লোক যারা শায়খুল ইসলাম হযরত শায়খ মুজাফফর রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার তর্জ-তরীকা অনুযায়ী চলবে সে অবশ্যই আল্লাহ পাক-উনার ইবাদত গুজার হবে এবং গোমরাহীর সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা থাকবে না। তিনিই (হযরত শায়খ মুজাফফর রহমতুল্লাহি আলাইহি) রুবুবিয়্যাত ও উলুহিয়্যাত এর গুপ্তভেদ প্রকাশ করেছেন এবং ইলমে মা’রিফাতের ব্যাপারে যিন্দিক-কাফিরদের বাতিল ও কুফরীমূলক বক্তব্যকে দূরীভূত করে দিয়েছেন।
وهو معكم اينما كنتم
তুমি যেখানেই থাকনা কেন আল্লাহ পাক তোমার সাথেই রয়েছেন। (সূরা হাদীদ-৪)
এ আয়াত শরীফ-এর প্রকাশ্য অর্থ হচ্ছে মানুষ যেখানেই থাকুক আল্লাহ পাক বান্দার সাথেই রয়েছেন। একটি জিনিস অন্য কোন জিনিসের সাথে থাকাকেই মায়ি’য়াত বা সঙ্গী হওয়া বলে। এই মায়ি’য়াত বা সঙ্গী হওয়াটা দুভাবে হয়- ১. হাক্বীক্বী বা প্রকৃত অর্থে ২. মাজাযী বা রূপক অর্থে। মুহাক্কীক্বগণের মতে উপরোক্ত আয়াত শরীফ-এর معيت (মাআইয়াত) সঙ্গী হওয়াটা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হবে। কেননা মহান আল্লাহ পাক দুনিয়াবী কোন জিনিসের সাথে জাতে পাকসহ হাজির বা উপস্থিত নন। বরং তিনি ইলম ও কুদরত দ্বারা সমস্ত কিছুর সাথে উপস্থিত। যদিও মুতাকাদ্দিমীনগণও (তর্কশাস্ত্রবিদগণ) উপরোক্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী। কিন্তু ছূফীয়ানে কিরাম-উনারা উক্ত আয়াত শরীফ-এর যাহিরী অর্থের উপর নির্ভরশীল নন। বরং উনারা উহার হাক্বীক্বী অর্থ অনুসন্ধান করতে থাকেন। ছূফীয়ানে কিরাম-উনাদের আক্বীদা এরূপ যে, মহান আল্লাহ পাক-উনার সবকিছুর সাথে জাতে পাকসহই তবে একথা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, মাখলূক্ব যেমন এক শরীর অন্য শরীরের সাথে থাকে আল্লাহ পাক অনুরূপ নন। কারণ তিনি জিসিম থেকে পবিত্র। আবার আল্লাহ পাক-উনার ‘সঙ্গী’ হওয়ার বিষয়টা এমনও নয় যে, জাওহার (যা নিজে নিজেই ক্বায়িম থাকে) এর সাথে জাওহার। কেননা মহান আল্লাহ পাক جوهر জাওহারও নন, আবার আল্লাহ পাক-উনার সবকিছুর সাথে থাকাটা এমনও নয় যে, عروض আরূজ (যা নিজে নিজে ক্বায়িম থাকতে পারেনা) এর সাথে জাওহার। কারণ তিনি যেমন জাওহার নন তেমনি তিনি আরুজও নন। সেজন্যই মুতাকাদ্দিমীন-উনারা আল্লাহ পাক-উনাকে উপরোক্ত তিন প্রকার معيت থেকে আলাদা করেছেন। কিন্তু ছূফীয়ানে কিরাম-উনারা মাখলূক্বাতের সাথে মহান আল্লাহ পাক-উনার সঙ্গী হওয়ার বিষয়টি চতুর্থ এক প্রকারে ছাবিত করেছেন। ছূফীয়ানে কিরাম-উনাদের বক্তব্য হচ্ছে- মহান আল্লাহ পাক-উনার মাখলূক্বাতের সাথে থাকাটা এমন, যেমন নাকি শরীরের সাথে রূহ থাকে। কারণ ‘রূহ’ ক্বলবের ভিতরেও থাকে না আবার ক্বলব থেকে বাইরেও থাকে না। অনুরূপ রূহ ক্বলবের সাথেও থাকে না আবার ক্বলব থেকে জুদাও থাকে না। বরং রূহ ও শরীর উভয়টি আলাদা আলাদা সাধারণভাবে তায়াল্লুক রাখে। যেমন রূহ শরীরের মধ্যে প্রবেশ করা ও বাহির হওয়া, যুক্ত হওয়া ও জুদা হওয়ার ক্ষেত্রে কোন নিছবত নেই।
প্রকৃতপক্ষে মাখলূক্বাতের শরীরের মধ্য হতে কোন একটি সামান্য অংশেও রূহ থাকে না। কিন্তু দুনিয়ার সকলেই জানে যে, শরীরের মধ্যেই রূহ অবস্থান করে। মহান আল্লাহ পাক-উনার মাখলূক্বাতের সাথে থাকাটা হুবহু অনুরূপই। (চলবে)