-আল্লামা মুফতী সাইয়্যিদ শুয়াইব আহমদ
ঈদ মুবারক! ঈদ মুবারক!! ঈদ মুবারক!!!
কুল-মাখলূক্বাতের নবী ও রসূল, ইমামুল আম্বিয়া ওয়ার রুসুল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যমীনে আগমন তথা বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশের মহিমান্বিত দিনটিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম ঈদের দিন; যে দিনটি সাইয়্যিদুল আ’ইয়াদ শরীফ, সাইয়্যিদুল ঈদিল আ’যম শরীফ ও সাইয়্যিদুল ঈদিল আকবার শরীফ হিসেবে পরিচিত।
স্মরণীয় যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশের মহিমান্বিত দিনটি শুধু মানুষ ও জিন জাতির জন্যেই নয় বরং তামাম সৃষ্টির জন্যেই ঈদ উদযাপন তথা খুশি প্রকাশের দিন। উক্ত খুশি প্রকাশের ইবাদতটি নফল কোন ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং এ ইবাদতটি যত প্রকার ইবাদত রয়েছে- ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল, মুস্তাহাব ইত্যাদি সর্বপ্রকার ইবাদত থেকে শ্রেষ্ঠতম এবং উক্ত শ্রেষ্ঠতম ইবাদতটি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার এবং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দলীল-আদিল্লাহ’র দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!
যেমন এ প্রসঙ্গে প্রথমতঃ সূরা ইউনুস শরীফ উনার ৫৭ ও ৫৮নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
يايها الناس قد جاءتكم موعظة من ربكم وشفاء لـما فى الصدور وهدى ورحمة للمؤمنين. قل بفضل الله وبرحمته فبذالك فليفرحوا هو خير مـما يجمعون.
অর্থ: হে মানুষেরা! তোমাদের রব মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে তোমাদের নিকট এসেছেন যিনি শ্রেষ্ঠতম নছীহতকারী, তোমাদের অন্তরের আরোগ্য বা ইছলাহকারী, হিদায়েত দানকারী এবং মু’মিনদের জন্য (খাছভাবে) রহমত দানকারী। (অতএব হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! স্বীয় উম্মতকে) আপনি বলে দিন, মহান আল্লাহ পাক তিনি স্বীয় ফদ্বল ও রহমত স্বরূপ অর্থাৎ অপার দয়া ও অনুগ্রহ হিসেবে উনার প্রিয়তম রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে যে পাঠিয়েছেন; সেজন্য তাদের কর্তব্য খুশি প্রকাশ করা। এই খুশি প্রকাশের ইবাদতটি তাদের সমস্ত ইবাদত অপেক্ষা উত্তম বা শ্রেষ্ঠ।
জানা আবশ্যক যে, উক্ত সূরা ইউনুস শরীফ উনার ৫৭নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে موعظة-شفاء-هدى-رحمة প্রতিটি শব্দ মুবারকই হচ্ছেন ইসমে মাছদার বা ক্রিয়ামূল। যা ইসমে ফায়িল বা কর্তৃবাচ্য হিসেবে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে পরবর্তী ৫৮নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে بفضل الله وبرحمته উনার মধ্যে فضل الله এবং رحمته অর্থাৎ رحمة الله দ্বারাও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকেই বুঝানো হয়েছে। যা তাফসীরে রূহুল মায়ানী, তাফসীরে মুহাররারুল ওয়াজীয, তাফসীরুল মানার, তাফসীরে বয়ানুল মায়ানী, তাফসীরে যাদুল মাসীর, তাফসীরে কবীর ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থসমূহে উল্লেখ রয়েছে।
অতএব, উক্ত শব্দসমূহ দ্বারা পবিত্র কুরআন শরীফ উনাকে উদ্দেশ্য গ্রহণ করাটা শুদ্ধ নয়। কেননা, পবিত্র কুরআন শরীফ সরাসরি উম্মতের কাছে আসেননি বা নাযিল হননি। বরং পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল হয়েছেন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মাধ্যমে বা তরফ থেকে উম্মত পবিত্র কুরআন শরীফ পেয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ সূরা ইবরাহীম শরীফ উনার ৫নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
وذكرهم بايام الله ان فى ذلك لايات لكل صبار شكور.
অর্থ: (হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি তাদেরকে (উম্মতকে) মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ দিনসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিন। নিশ্চয়ই এতে প্রত্যেক ছবরকারী এবং শোকরগোযার ব্যক্তিদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।
আলোচ্য আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ايام الله ‘আইয়্যামুল্লাহ’ শব্দ মুবারক দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক- বদর, উহুদ, খন্দক, হুনাইন ইত্যাদি জিহাদের ঘটনাবলী অথবা পূর্ববতী উম্মতের উপর শাস্তি নাযিল হওয়ার ঘটনাবলী। এসব ঘটনায় বিরাট জাতির ভাগ্য ওলট-পালট হয়ে গেছে এবং তারা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় ‘আইয়্যামুল্লাহ’ অর্থাৎ উক্ত দিন ও তার মধ্যে সংঘটিত ঘটনাবলী স্মরণ করানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব জাতির কুফরের অশুভ পরিণতির ভয় প্রদর্শন করা এবং হুঁশিয়ার করা। দুই- ‘আইয়্যামুল্লাহ’ উনার অপর অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক উনার নিয়ামত ও রহমত। তা স্মরণ করানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সৎ ব্যক্তিকে যখন কোন অনুগ্রহদাতা উনার অনুগ্রহ স্মরণ করানো হয় তখন সে বিরোধিতা ও অবাধ্যতা করতে লজ্জাবোধ করে উপরন্তু নিয়ামতপ্রাপ্তির জন্য শুকরিয়া আদায় করে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সৃষ্টিকুলের প্রতি মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত ও রহমত তথা অনুগ্রহ হচ্ছেন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। সুবহানাল্লাহ! তাই উনাকে লাভ করার কারণে কায়িনাতের সকলের জন্য খুশি প্রকাশ করা অপরিহার্য কর্তব্য। মহান আল্লাহ পাক তিনি আদেশ মুবারক করেছেন-
واذكروا نعمت الله عليكم
অর্থ: মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে তোমাদের প্রতি যে নিয়ামত রয়েছে উক্ত নিয়ামত উনার স্মরণ করো বা শুকরিয়া আদায় করো। (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৩১)
উল্লেখ্য, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ ও সম্মানিত বিছালী শান মুবারক প্রকাশ একই মাস, তারিখ ও দিনে হওয়ায় উক্ত মাস, তারিখ ও দিনে খুশি প্রকাশ করার ব্যাপারে কেউ কেউ বেশ অনীহা, আপত্তি ও বিরোধিতা করে থাকে। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! এক্ষেত্রে তাদের জিহালতী ও মূর্খতাই চরমভাবে দায়ী। তাদের জানা উচিত যে, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ ও বিছালী শান মুবারক প্রকাশ উভয়দিনই রহমত, বরকত, নিয়ামত, সাকীনাহ নাযিল হওয়ার সর্বোত্তম উপলক্ষ্য। যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম উনার সম্পর্কে পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ ১৫ নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
وسلم عليه يوم ولد ويوم يموت ويوم يبعث حيا
অর্থ: আর সালাম অর্থাৎ সমস্ত খায়ের-বরকত- রহমত-নিয়ামত-শান্তি-সাকীনা-কল্যাণ-কামিয়াবী উনার প্রতি যেদিন তিনি বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ করেন এবং যেদিন তিনি বিছালী শান মুবারক প্রকাশ করেন এবং যেদিন তিনি পুনরায় হায়াতী শান মুবারক প্রকাশ করবেন।
অনুরূপ বর্ণনা হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্পর্কেও উল্লেখ রয়েছে।
অতএব, সম্মানিত ১২ই রবীউল আউওয়াল শরীফ উপলক্ষে কেবল খুশিই প্রকাশ করতে হবে। খুশির বিপরীত কোনকিছু প্রকাশ করা যাবে না। করলে সেটা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার হুকুমের বিরোধিতা করা হবে, যা প্রকাশ্য কুফরী হবে এবং কাফির, মুরতাদ ও জাহান্নামী হওয়ার কারণ হবে। নাউযুবিল্লাহ! স্মরণীয় যে, সম্মানিত ১২ই রবীউল আউওয়াল শরীফ উক্ত খুশি প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত যারা করবে, নিঃসন্দেহে তারা বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুবহানাল্লাহ!
যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা উক্ত বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে উনার নিজ গৃহে ছাহাবীগণ উনাদেরকে সমবেত করে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশের ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছিলেন। এতে শ্রবণকারীগণ আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করছিলেন এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রশংসা তথা তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করছিলেন এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শানে ছলাত-সালাম (দুরূদ শরীফ) পাঠ করছিলেন। এমন সময় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন (তখন সমবেত ছাহাবীগণ দাঁড়িয়ে উনাকে সালাম পেশ করতঃ অভ্যর্থনা জানিয়ে আসনে বসালেন।) তিনি বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে মাহফিল করতে দেখে উনাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
حلت لكم شفاعتى
অর্থাৎ- আপনাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব।” সুবহানাল্লাহ! (কিতাবুত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর)
অপর এক হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, “হযরত আবূ দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত যে, একদা তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে হযরত আমির আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন যে, তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে উনার সন্তান-সন্ততি এবং আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে সমবেত করে বিলাদত শরীফ উনার ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছেন এবং বলছেন, এই দিবস, এই দিবস অর্র্থাৎ এই দিবসে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যমীনে তাশরীফ মুবারক এনেছেন। এমন সময় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন। (তখন সমবেত ছাহাবীগণ দাঁড়িয়ে উনাকে সালাম পেশ করতঃ অভ্যর্থনা জানিয়ে আসনে বসালেন।)
তিনি বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে মাহফিল করতে দেখে উনাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
ان الله فتح لك ابواب الرحمة والـملائكة كلهم يستغفرون لك ومن فعل فعلك نجا نجتك
অর্থ: “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ আপনাদের জন্য রহমতের দরজা উš§ুক্ত করে দিয়েছেন এবং সমস্ত হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা আপনাদের জন্য মাগফিরাত তথা ক্ষমা প্রার্থনা করছেন এবং যে কেউ আপনাদের মতো এরূপ কাজ করবে, আপনাদের মতো তারাও রহমত, মাগফিরাত এবং নাজাত লাভ করবে।” সুবহানাল্লাহ! (সুবুলুল হুদা ফী মাওলিদিল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
মাহে যিলক্বদ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মাহে যিলহজ্জ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মাহে মুহররমুল হারাম ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা