سُنَّةٌ (সুন্নত) শব্দের অর্থ আদর্শ, তর্জ-তরীক্বা, নিয়ম-কানুন, আমল, কাজ, পদ্ধতি, আদত, বৈশিষ্ট, স্বভাব ইত্যাদি।
মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকেও সুন্নত মুবারক বলে।
পারিভাষিক অর্থে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুপম সর্বোত্তম আদর্শ মুবারক উনাকে সুন্নত মুবারক বলে।
মহাসম্মানিত সুন্নত মুবারক উনার মাক্বাম সর্বোচ্চ। মহাসম্মানিত সুন্নত মুবারক উনার মাধ্যমেই সর্বপ্রকার নেয়ামত মুবারক হাছিল করা সম্ভব। খ্বালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার এবং উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাবীব ও মাহবূব, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহব্বত-মা’রিফত, রেযামন্দি-সন্তুষ্টি মুবারক হাছিলের প্রধান মাধ্যম হচ্ছেন মহাসম্মানিত সুন্নত মুবারক পালন করা।
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-
مَنْ يُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ تَوَلّٰى فَمَاۤ أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظًا
অর্থ: যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুগত্য বা অনুসরণ করলো সে মূলত মহান আল্লাহ পাক উনার আনুগত্য করলো। আর যে অবাধ্য হলো আপনি তাদের জিম্মাদার নন। (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা নিসা শরীফ: সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ৮০)
ইত্তিবায়ে সুন্নত মুবারক উনার অর্থ: মাথার তালু থেকে পায়ের তলা, হায়াত থেকে মউত পর্যন্ত প্রত্যেক ক্ষেত্রে সম্মানিত সুন্নত মুবারক সূক্ষাতিসূক্ষ্ম-পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ-অনুকরণ করা।
সর্বাবস্থায় মহাসম্মানিত সুন্নত মুবারক উনার ইত্তেবা করতে হবে। বর্তমান সময়ে মুসলমানরা কাফির-মুশরিক, বেদ্বীন-বদদ্বীন, নাস্তিক, ফাসিক-ফুজ্জারদের নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে। অথচ পবিত্র সুন্নত মুবারক সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ বেখবর। মুসলমানরা মূল থেকে সরে গিয়েছে। আর এজন্যই আজ সারা বিশ্বে মুসলমানদের করুন অবস্থা। নাউযুবিল্লাহ!
পোশাকের ব্যাপারে তারা কোন গুরুত্বই দেয় না। পোশাক যে অনেক বড় এক নিয়ামত মুবারক যা বলার অপেক্ষা রাখে না। পোশাক-পরিচ্ছদ মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পোশাক যেমন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢেকে রাখা ও সৌন্দর্যের উপকরণ, তেমনি সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার দিক-নির্দেশনা মেনে তা ব্যবহার করা মহান আল্লাহ পাক উনার এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের নৈকট্য মুবারক লাভের মাধ্যম। পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে অন্যান্য বিষয়গুলির মতো লিবাস বা পোশাকের বিষয়েও হুকুম-আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে।
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পোশাক সম্পর্কিত বিধি-বিধান সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক করেছেন। তাই পোশাক-পরিচ্ছদের ভালো মন্দ মানুষের কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, চরিত্র ও নৈতিকতা অর্থাৎ মানবিক জীবনের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে এবং অন্তর ও মন-মানসিকতায় গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কেননা, প্রত্যেকটা বিষয়ের একটা তাছির বা প্রতিক্রিয়া আছে।
যখন কেউ মহাসম্মানিত সুন্নত মুবারক উনার আমল করে তখন তার প্রতি রহমত মুবারক নাযিল হয়। আর যখন কেউ কাফির-মুশরিকদের অনুসরণ করে তার প্রতি লা’নত বর্ষিত হয়। নাউযুবিল্লাহ!
কাজেই, পোশাক-পরিচ্ছদ, লেন-দেন, ব্যবসা-বানিজ্য,আমল-আখলাকসহ যাবতীয় বিষয়ে কাকে অনুসরণ করতে হবে,সেই বিষয়টাও মহান আল্লাহ পাক তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
অর্থ: “নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ মুবারক।” (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা আহযাব শরীফ: সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ২১)
কাজেই উম্মতের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে- সর্বাবস্থায় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইতায়াত বা অনুসরণ-অনুকরণ করা অর্থাৎ সম্মানিত সুন্নত মুবারক অনুযায়ী চলা। আর সেক্ষেত্রে প্রথমতঃ লিবাস বা পোশাকের বিষয়টাকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। পুরুষদের জন্য গুটলীযুক্ত, গোল, কোণাবন্ধ ও নিছফুস সাক্ব ক্বামীছ, ইযার বা লুঙ্গি, সেলোয়ার ইমামাহ বা পাগড়ী, টুপি, রুমাল আর মহিলাদের জন্য সেলোয়ার, ক্বামীছ, ওড়না, বোরকা, হাত মোজা, পা মোজা ইত্যাদি খাছ সুন্নতী পোশাকের অন্তভুর্ক্ত। বিধর্মীদের পোশাক পরিধান করা থেকে বেঁচে থেকে সম্মানিত সুন্নতী পোশাক পরিধান করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয।
কিছু লোক ‘ক্বিল্লতে ইলিম ও ক্বিল্লতে ফাহাম’ অর্থাৎ ‘কম জ্ঞান ও কম বুঝের’ কারণে বলে থাকে যে- ‘সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে লিবাস বা পোশাকের নির্দিষ্ট কোনো বর্ণনা নেই। নাউযুবিল্লাহ! সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মৌসুমের চাহিদা মোতাবেক যখন যে ধরনের পোশাক পেতেন তাই পরিধান করতেন।’ নাঊযুবিল্লাহ! কাট্টা কুফরী বক্তব্য।
যদি তাই হয়ে থাকে, তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- তবে কি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র ওহী মুবারক উনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন না? নাঊযুবিল্লাহ! তবে কি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার পবিত্র আয়াত শরীফ সত্য নয়? নাঊযুবিল্লাহ! মহান আল্লাহ পাক তিনি তো ‘পবিত্র সূরা নজম শরীফ’ উনার ৩-৪ নম্বর পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, “ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র ওহী মুবারক ব্যতীত নিজ থেকে কোনো কথা বলেন না ও কোনো কাজ করেন না এবং কোনো সম্মতিও প্রকাশ করেন না।” সুবহানাল্লাহ!
সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে লিবাস বা পোশাকের বর্ণনাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। যেমন লিবাস বা পোশাক সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
يَا بَنِيْ اٰدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا
অর্থ: “হে বনী আদম! আমি তোমাদের জন্য লিবাস বা পোশাক নাযিল করেছি।” (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা আ’রাফ শরীফ: সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ২৬)
আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “তোমরা ইহুদী-নাছারা অর্থাৎ কাফির-মুশরিকদের লিবাস বা পোশাক থেকে বেঁচে থাকো।” এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের জন্য আলাদা বা নির্দিষ্ট পোশাক রয়েছে।
মূলতঃ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে লিবাস বা পোশাক মুবারক পরিধান করেছেন, তা মুসলমান পুরুষদের জন্য এবং হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনারা যে পোশাক মুবারক পরিধান করেছেন, তা মহিলাদের জন্য। আর সেগুলোই হচ্ছে ইসলামী পোশাক বা সুন্নতী পোশাক মুবারক। আর সেই সুন্নতী পোশাক মুবারক উনার মধ্যে ক্বামীছ হচ্ছে অন্যতম। অর্থাৎ গুটলীযুক্ত, গোল, কোণাবন্ধ, নিছফুস সাক্ব ক্বামীছ বা কোর্তাই খাছ সুন্নতী পোশাক মুবারক। কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় পোশাক মুবারক হচ্ছে ক্বামীছ বা কোর্তা।
ক্বামীছ শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো- কোর্তা, জামা ইত্যাদি। আর ইসলামী শরীয়ত উনার পরিভাষায় ক্বামীছ বা কোর্তা হলো, যার গেরেবান আছে যা বন্ধ করার জন্য কাপড়ের গুটলী লাগানো হয়, যা নিছফুস সাক্ব। অর্থাৎ হাঁটু ও পায়ের গিরার মধ্যবর্তী স্থান পর্যন্ত প্রলম্বিত। গোল যা কোণাফাঁড়া নয়, যার আস্তিন আছে, যা অতি সহজেই মানুষের সতর ও ইজ্জত আবরু ঢাকে। যেমন, ‘আবূ দাউদ শরীফ’ উনার বিশ্ববিখ্যাত শরাহ ‘আইনুল মা’বূদ’ উনার ‘কিতাবুল লিবাস’ অর্থাৎ ‘ক্বামীছ বা কোর্তার আলোচনা’ পর্বে উল্লেখ রয়েছে, “নূরে মুজসাসম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট ক্বামীছ বা কোর্তা সবচেয়ে পছন্দনীয় হওয়ার কারণ হলো- ক্বামীছ দ্বারা ইযার বা লুঙ্গি ও রিদ্বা বা চাদর অপেক্ষা সতরকে পরিপূর্ণভাবে ঢাকা যায়। অথচ ক্বামীছ অল্প খরচে হয়, দেহের জন্য হালকা এবং এটা পরিধানে অধিক বিনয়-নম্রতা প্রকাশ পায়।” (‘জামউল ওয়াসায়িল’ কিতাবেও অনুরূপ বর্ণনা উল্লেখ আছে।)
ক্বামীছের গেরেবান আটকানোর গুটলী কাপড়ের তৈরি হওয়াই খাছ সুন্নত। যাকে আরবীতে বলা হয় যিররুন। এর বহুবচন আযরারুন ও যুরূরুন। যার অর্থ হলো- গুটলী, কাপড়ের তৈরি গুটলী ইত্যাদি। যেমন এ প্রসঙ্গে লুগাত বা অভিধানে উল্লেখ আছে যে, যিররুন হলো “কোর্তার গেরেবান বন্ধ করার জন্য কাপড় অথবা সুতার নির্মিত গোল গুটলী।”
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট ক্বামীছ অধিক পছন্দনীয় ছিল। ক্বামীছ হাঁটুর নিচ ও টাখনুর উপর পর্যন্ত প্রলম্বিত হওয়া চাই। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেই ক্বামীছ বা কোর্তা পরিধান করতেন উনার অনুসরণে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও সেই পোশাক পরিধান করতেন, তা কোণাফাঁড়া ছিল না। তাই গোল, নিছফুস সাক্ব ক্বামীছ বা কোর্তাই খাছ সুন্নতী কোর্তা। কোণাফাঁড়া কোর্তা যতই লম্বা হোক না কেন, তাতে কখনোই সুন্নত আদায় হবে না।”
ক্বামীছ বা কোর্তার ন্যায় মুসলমান পুরুষদের অন্যান্য পোশাক যেমন- ইযার বা লুঙ্গি, সেলোয়ার, ইমামাহ বা পাগড়ী, টুপি, রুমাল এবং মুসলমান মহিলাদের পোশাক যেমন- সেলোয়ার, ক্বামীছ, ওড়না, বোরকা ইত্যাদির বর্ণনাও কিতাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তাই প্রত্যেক মুসলমান পুরুষ ও মহিলাদেরকে উল্লেখিত সেই ইসলামী পোশাক অর্থাৎ সুন্নতী পোশাকই পরিধান করতে হবে। বিধর্মীদের পোশাক- শার্ট, প্যান্ট, টাই, কোট ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকতে হবে। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদেরকে সম্মানিত সুন্নতী পোশাক পরিধান করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
-আহমদ হুসাইন