মাহে রবীউল আউয়াল শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা -হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শুয়াইব আহমদ

সংখ্যা: ১৮৫তম সংখ্যা | বিভাগ:

পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দিন বা তারিখ মানবজাতির নিকট স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু ৫৭০ ঈসায়ী সনের ১২ই রবীউল আউয়াল শরীফ-এর পবিত্র সোমবার দিনটি সবার উপরে এক শ্রেষ্ঠত্ব  ও স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দিন। এ দিনটি কেবল মানবজাতির জন্য নয় কিংবা গোটা সৃষ্টির জন্যই নয় বরং কুল-কায়িনাতের সৃষ্টিকারী স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা’র কাছেও ফযীলতপূর্ণ একটি দিন। কারণ এ মহান দিনে আল্লাহ পাক-এর যিনি হাবীব তিনি যমীনে তাশরীফ এনেছেন। সুবহানাল্লাহ! অতএব, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যেরূপ মর্যাদা, অন্যান্য সমস্ত দিন অপেক্ষা ১২ই রবীউল আউয়াল শরীফ দিনটির মর্যাদাও তদ্রুপ।

বর্ণিত রয়েছে, যখন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদত শরীফ-এর পবিত্র দিন অর্থাৎ রাতটি আগমন করলো (শরীয়তে সূর্যাস্তের পর থেকে দিন শুরু হয় অর্থাৎ আগে রাত পরে দিন এসে থাকে) সে পবিত্র রাতটির অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বয়ং হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানিতা আম্মা সাইয়্যিদাতু নিসায়িল আলামীন হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালাম বলেন, ‘এটা ছিল চন্দ্রের আলোয় আলোকিত রাত। চারপাশে কোন প্রকার অন্ধকার ছিল না। সে সময় হযরত আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস্ সালাম তাঁর সন্তানাদিদের নিয়ে হারাম শরীফ-এর দিকে যান বাইতুল্লাহ শরীফ-এর ভাঙা দেয়াল মেরামত করার জন্য। ফলে সে সময় আমার নিকট কোন নারী বা পুরুষ কেউই ছিলেন না। আমার নিঃসঙ্গতার জন্য কান্না পাচ্ছিল। হায়! কোন মহিলাই আমার খিদমতে নেই। আমার জন্য কোন একান্ত সাথীও নেই, যিনি আমাকে সান্ত¡না দিবেন। কোন দাসীও নেই, যে আমার মনোবল অটুট রাখবে।’ অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমি তাকালাম বসত বাড়ির এক কোণায়। সহসাই তা উন্মোচিত হলো এবং চারজন সুউচ্চ মহিলা বের হয়ে এলেন।’

উক্ত চারজন মহীয়ষী এমন উজ্জ্বল ছিলেন যেন তাঁরা চন্দ্র। তাঁদের চারদিকে আলো আর আলো। আবদে মানাফ বংশের সহিত সাদৃশ্য রাখেন তাঁরা। অতঃপর তাঁদের প্রথমজন এগিয়ে এলেন এবং তিনি বললেন, হে হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম! আপনার মত কে আছে? আপনি যে রবীয়া ও মুদ্বার গোত্রের সাইয়্যিদকে রেহেম শরীফে ধারণ করেছেন। অতঃপর তিনি আমার ডান দিকে বসলেন। তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে? তিনি বললেন, ‘আমি হাওয়া আলাইহাস সালাম। মানবজাতির মাতা।’ অতঃপর দ্বিতীয়জন এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, হে হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম! আপনার মত কে আছেন? আপনিতো রেহেম শরীফে ধারণ করেছেন পূতঃপবিত্র জ্ঞান-ভাণ্ডারের রহস্যকে, রত্মরাজির সাগরকে, নূরের ঝলককে, সুস্পষ্ট তত্ত্বজ্ঞানীকে। অতঃপর তিনি বাম দিকে উপবেশন করলেন। তখন আমি তাঁকে বললাম, আপনি কে? তিনি বললেন, ‘আমি সারাহ আলাইহাস সালাম। হযরত ইবরাহীম খলীল আলাইহিস্্ সালাম-এর আহলিয়া।’ অতঃপর তৃতীয়জন এগিয়ে এলেন এবং বললেন, হে হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম! আপনারতো কোন তুলনাই হয় না। আপনি যে চিরপ্রত্যাশার হাবীবে খোদাকে রেহেম শরীফে ধারণ করেছেন। যিনি প্রশংসা ও ছানা-ছিফতের লক্ষ্যস্থল। অতঃপর তিনি আমার পিঠের দিকে বসলেন। আমি বললাম, আপনি কে? তিনি বললেন, ‘আমি আছিয়া বিনতে মুসাহিম আলাইহাস সালাম।’ এরপর চতুর্থজন এগিয়ে এলেন। তিনি অন্যদের তুলনায় বেশি উজ্জ্বলতার অধিকারিণী ছিলেন। তিনি বললেন, হে হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম! আপনার সমকক্ষ কেউই নেই। আপনি রেহেম শরীফে ধারণ করেছেন অকাট্য দলীলের অধিকারী ব্যক্তিত্বকে, যিনি মু’জিযা, আয়াত ও দালায়িলের অধিকারী। যিনি যমীন ও আসমানবাসীদের সাইয়্যিদ। তাঁর উপর আল্লাহ পাক-এর সর্বোত্তম ছলাত এবং পরিপূর্ণ সালাম। তারপর তিনি আমার নিকটে বসলেন আর আমাকে বললেন, হে হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম! আপনি আমার উপর হেলান দিন। আমার উপর পূর্ণ আস্থা রাখুন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। আপনি কে? তিনি বললেন, ‘আমি র্মাইয়াম বিনতে ইমরান আলাইহাস সালাম। আমরা আপনার সেবিকা এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গ্রহণকারিণী।’

হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম বললেন, তাঁদের উপস্থিতিতে আমার একাকীত্ব দূর হলো। আর আমি দেখতে লাগলাম, দীর্ঘ বাহুবিশিষ্ট জনেরা আমার নিকট দলে দলে আসছেন। আমি আমার গৃহের দিকে তাকালাম, এখানে নানান ভাষায় বৈচিত্রপূর্ণ দুর্বোধ্য কথা আমি শুনতে পেলাম। আমি সেসময় লক্ষ্য করলাম, দলে দলে ফেরেশতাগণ আমার ডানে-বামে উড়ছেন। তখন আল্লাহ পাক হযরত জিব্রীল আলাইহিস্্ সালামকে আদেশ করলেন, হে জিব্রীল আলাইহিস সালাম! রূহসমূহকে ‘শারাবান তহুরা’ পাত্রের নিকট শ্রেণীবদ্ধ করো। হে রিদওয়ান! জান্নাতের নবোদ্ভিন্না যুবতীগণকে নতুন সাজে সজ্জিত করো। আর পবিত্র মেশকের সুগন্ধি ছড়িয়ে দাও। সারা মাখলূকাতের যিনি মহান রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আবির্ভাব উপলক্ষে।” হে জিব্রীল আলাইহিস্্ সালাম! বিছিয়ে দাও নৈকট্য ও মিলনের জায়নামায সেই মহান রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য, যিনি অধিকারী নূরের, উচ্চ মর্যাদার এবং মহা মিলনের। হে জিব্রীল আলাইহিস্্ সালাম! দোযখের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশ্তা মালিক আলাইহিস্্ সালামকে আদেশ করো সে যেন দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করে। জান্নাতের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশ্তা রিদওয়ানকে বলো, সে যেন জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে। হে জিব্রীল আলাইহিস্্ সালাম! রিদওয়ানের অনুরূপ পোশাক পরিধান করো এবং যমীনের বুকে গমন করো সুসজ্জিত হয়ে কাছের ও দূরের সকল ফেরেশ্তা সহকারে। অতঃপর আসমান-যমীনের চারপাশে ঘোষণা দাও, সময় ঘনিয়ে এসেছে, মুহিব ও মাহবূবের মিলনের, তালিব ও মাতলূবের সাক্ষাতের। অর্থাৎ আল্লাহ পাক-এর সহিত তাঁর হাবীবে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যে মি’রাজ হবে তার সময় নিকটবর্তী হলো তাঁর বিলাদত শরীফ-এর  মাধ্যমে।”

অতঃপর হযরত জিব্রীল আলাইহিস সালাম হুকুম বাস্তবায়ন করলেন, যেমনটি আল্লাহ জাল্লা শানুহু হুকুম করলেন। এক জামায়াত ফেরেশ্তাকে মক্কা শরীফ-এর পাহাড়ে দায়িত্ব দিলেন। তাঁরা হারাম শরীফ-এর দিকে নজর রাখলেন। তাঁদের পাখাসমূহ যেন সুগন্ধিযুক্ত সাদা মেঘের টুকরা। তখন পাখিসমূহ তাসবীহ পাঠ করতে লাগলো এবং উন্মুক্ত প্রান্তরে বনের পশুগুলো সহানুভূতির ডাক, আশার ডাক দিতে লাগলো। এ সবকিছুই সেই মহান মালিক জলীল জাব্বার আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীনের আদেশ মুতাবিক হলো।

হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম বলেন, অতঃপর আল্লাহ পাক চোখের পর্দা অপসারিত করলেন। আমি দেখতে পেলাম, শাম দেশের বছরা নগরীর প্রাসাদসমূহ। আমি দেখলাম, তিনটি পতাকা। একটি পতাকা পূর্ব প্রান্তে, আরেকটি পতাকা পশ্চিম প্রান্তে এবং তৃতীয়টি কা’বা শরীফ-এর ছাদে। আমি আরো দেখলাম, পাখিদের একটি দল, যে পাখিদের চক্ষুগুলো স্বর্ণাভ, ডানাগুলো বৈচিত্র্যময় রঙ-বেরঙের ফুলের মত। সেগুলো আমার কক্ষে প্রবেশ করল মনিমুক্তার মত। এরপর উক্ত পাখিগুলো আমার চারপাশে আল্লাহ পাক-এর ছানা-ছিফত করতে লাগল। আমি উম্মীলিত রইলাম এ অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর ফেরেশ্তারা আমার নিকট দলে দলে আসতে লাগলেন। আর তাঁদের হাতে ছিল ‘আগরদান’ স্বর্ণাভ ও রৌপ্য নির্মিত। আর তাঁরা সুগন্ধি ধূম্র ছড়াচ্ছিলেন। সেই সাথে তাঁরা উচ্চ কণ্ঠে সম্মানিত ও মর্যাদাবান হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করছিলেন। তাঁদের কণ্ঠে সৌজন্যতার ও মহানুভবতার ভাব স্পষ্ট ছিল।

হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম বলেন, চন্দ্র আমার মাথার উপর চলে এলো, তাঁবু মাথার উপর থাকার মত। আর তারকারাজি আমার মাথার উপর সদৃশ্য মোমবাতির ন্যায়। সে অবস্থায় আমার নিকট ছিল দুধের ন্যায় শুভ্র সুগন্ধিময় পানীয়, যা ছিল মধুর চেয়ে মিষ্ট এবং বরফের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা। তখন আমার খুব পিপাসা লাগছিল। আমি তা গ্রহণ করলাম ও পান করলাম। এর চেয়ে অধিক কোন সুপেয় পানীয় আগে কখনো পান করিনি। অতঃপর আমা হতে প্রকাশিত হলো এক মহিমান্বিত নূর।

উক্ত বর্ণনা থেকে প্রতিভাত হলো, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদত শরীফ কালে স্বয়ং আল্লাহ পাক-এর হুকুম বা নির্দেশে খুশি প্রকাশ করেছিলেন ফেরেশ্তাকুল, খুশি প্রকাশ করেছিলেন জান্নাতের অধিবাসীগণ, এমনকি খুশি প্রকাশ করেছিল বনের পশু-পাখিরাও। খুশি প্রকাশ করে ছানা-ছিফত বর্ণনা করা হয়েছিল এবং পাঠ করা হয়েছিল ছলাত-সালাম ও তাসবীহ তাহলীল।

কাজেই, উম্মতের প্রতিও আল্লাহ পাক-এর সে একই নির্দেশ হলো, তাঁরা যেন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদ শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি উম্মাহকে জানিয়ে দিন, আল্লাহ পাক ফযল-করম হিসেবে তাদেরকে যে দ্বীন ইসলাম দিয়েছেন এবং রহমত হিসেবে উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছেন সেজন্য তারা যেন খুশি প্রকাশ করে।” (সূরা ইউনুস-৫৮)

বুখারী শরীফ-এর হাদীছ পাক-এ বর্ণিত রয়েছে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদত শরীফ-এর সুসংবাদে খুশি হয়ে কাট্টা কাফির আবু লাহাব তার বাঁদী হযরত সুয়াইবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে আযাদ করে দিয়েছিল, যার কারণে আল্লাহ পাক প্রতি সোমবার দিনে তার কবরের আযাব হালকা করে দেন এবং তার ডান হাতের দু’অঙ্গুলি দিয়ে সুমিষ্ট ঠাণ্ডা পানি প্রবাহিত করেন, যা পানে তার বিগত সপ্তাহের আযাব-গযবের কষ্ট দূর হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ!

তাহলে যারা মুসলমান তারা যদি আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিলাদত শরীফ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করে, তারা যে আল্লাহ পাক-এর অফুরন্ত নিয়ামতের অধিকারী হবেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ব সমাদৃত ও সুপ্রসিদ্ধ ‘আন্ নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম’ কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “যে ব্যক্তি মীলাদুন্ নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করলো এবং তাতে সাধ্য-সামর্থ্য অনুযায়ী খুশি প্রকাশ করলো সে অবশ্যই ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে এবং বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” সুবহানাল্লাহ!

মাহে রজব ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে শা’বান ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

সম্মানিত রজবুল হারাম শরীফ, সম্মানিত শা’বান শরীফ ও সম্মানিত রমাদ্বান শরীফ মাস এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে রমাদ্বান শরীফ ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহে শাওওয়াল ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা