-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শুয়াইব আহমদ
আরবী বছরের দশম মাস শাওওয়াল। শাওওয়াল মাসের বহু মর্তবার মধ্যে একটি বিশেষ মর্তবা হচ্ছে এই যে, এ মাসের পহেলা তারিখে সারা মুসলিম জাহানে আনন্দের অনুষ্ঠান ‘ঈদুল ফিতর’ উদযাপিত হয়। মাহে রমাদ্বান শরীফ-এর এক মাস রোযা রাখার পর মুসলমানগণ ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে আনন্দ উদযাপন করেন।
ঈদুল ফিতরের রাত ও দিন উভয়টি অতিশয় ফযীলত ও মর্যাদাপূর্ণ। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, ঈদুল ফিতরের রাতে একদল ফেরেশতা আসমান হতে যমীনে আগমন করে উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে থাকেন, হে আল্লাহ পাক উনার প্রিয় বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহ পাক উনার রিযামন্দীর জন্য এক মাস রোযা রেখেছো, বিনিময়ে আল্লাহ পাক তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি তোমাদের জন্য জান্নাতে এমন সব বালাখানা তৈরি করে দিবেন, যা অন্য কারো পক্ষে লাভ করা সম্ভব হবেনা। শুধুমাত্র যারা তোমাদের মতো নেক আমল করবে তারাই সে মর্যাদা লাভে সক্ষম হবে। সুবহানাল্লাহ!
হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, ঈদুল ফিতরের দিন যখন মুছল্লীগণ ঈদের নামায আদায় করার জন্য ঈদগাহে জমায়েত হন তখন আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, “হে আমার বান্দারা! তোমরা আমারই রিযামন্দী লাভের আশায় এক মাস রোযা রেখেছো এবং আজ আমার সন্তুষ্টি লাভের আশায় ময়দানে সমবেত হয়েছো। কাজেই, আমি আজ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। যাও, তোমরা আজ চিরমুক্ত ও নির্মল।”
শাওওয়াল মাসের অপর একটি মর্তবার বিষয় হচ্ছে, এ মাসে ছয়টি রোযা পালন করা। এ রোযা সুন্নত। এ রোযার ফযীলত সম্পর্কে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি রমাদ্বান মাসের রোযা রাখার পর শাওওয়াল মাসের ছয়টি রোযা রাখলো সে যেনো পূর্ণ বছরই রোযা রাখলো।” (মুসলিম শরীফ)
বুখারী ও মুসলিম শরীফ-এ বর্ণিত হাদীছ শরীফ- এ রয়েছে, বান্দার প্রত্যেক নেক আমল দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ বান্দার প্রত্যেক নেক আমল কমপক্ষে দশগুণ বৃদ্ধি করা হয়, সে হিসেবে মাহে রমাদ্বান শরীফ-এর একমাস অর্থাৎ ৩০টি রোযার হিসাব হলো ৩০x১০=৩০০ দিন। আর মাহে শাওওয়াল-এর ৬টি রোযার হিসাব হলো ৬x১০=৬০ দিন। মোট হলো ৩৬০ দিন অর্থাৎ পূর্ণ এক বৎসর। আর তাই হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, যে মাহে রমাদ্বান শরীফ-এর রোযা রাখার পর মাহে শাওওয়ালের ছয়টি রোযা রাখলো সে যেনো পূর্ণ বছরই রোযার রাখলো।
বান্দার প্রতিটি নেক আমল দশগুণ বৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি কালামুল্লাহ শরীফ-এও উল্লেখ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
من جاء بالحسنة فله عشر امثالها
অর্থ: যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করবে সে তার দশগুণ পাবে। (সূরা আনয়াম: আয়াত শরীফ-১৬০)
আয়াত শরীফ-এর তাফসীরে বর্ণিত রয়েছে, আফদ্বালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, সাইয়্যিদুনা হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার খিলাফতকালে একবার মদীনা শরীফ-এ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ওই সময় হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার খাদ্য বোঝাই এক বাণিজ্য কাফেলা মদীনা শরীফ এসে পৌঁছেছে। এদিকে যারা ব্যবসায়ী ছিলেন উনারা সকলেই হযরত যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে এসে পণ্য সামগ্রীর দরদাম করতে থাকেন। কেউ দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ পর্যন্ত লাভ দেয়ার কথা বললেন। তবুও তিনি উনাদের নিকট মাল বিক্রি করতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, আপনাদের আগে একজনের সাথে কথা হয়েছে তিনি আমাকে দশগুণ মুনাফা দিবেন বলে ওয়াদা করেছেন। একথা শুনে ব্যবসায়ীগণ বিস্ময় প্রকাশ করত নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে থাকেন, আমরাই তো এখানকার বড় ব্যবসায়ী। আমাদের চেয়ে আবার কে বেশি মুনাফা দিয়ে উনার খাদ্যসামগ্রী কেনার চুক্তি করলেন? অতঃপর হযরত যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খলীফাকে লোক পাঠানোর জন্য বললেন, খলীফা লোক পাঠালে তিনি সমস্ত খাদ্য সামগ্রী গরীবদের জন্য দান করে ‘বাইতুল মাল’-এ জমা দিয়ে দিলেন। সুবহানাল্লাহ!
উল্লেখ্য, শাওওয়ালের ছয়টি রোযা রাখার উত্তম বা মুস্তাহাব নিয়ম হচ্ছে- ছয়টি রোযা একাধারা না রেখে বরং দু’একদিন বাদ দিয়ে দিয়ে রাখা।
স্মরণীয় যে, রমাদ্বান শরীফ-এর পরবর্তী এ মাসটিতে বান্দার গুনাহ করার আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। কারণ, রমাদ্বান মাসে আবদ্ধ থাকার পর শয়তান এবং সদ্যমুক্ত কু-রিপুগুলি দ্বিগুণভাবে উত্তেজিত হয়ে মানুষকে কুপথে পরিচালনার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। সুতরাং এ মাসে গুনাহ হতে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। এ জন্যেই হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এক হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি শাওওয়াল মাসে নিজেকে গুনাহ থেকে হিফাযত করে তার জন্য আল্লাহ পাক তিনি বেহেশত নির্দিষ্ট করে রাখেন। সুবহানাল্লাহ!
হযরত মুজাদ্দিদ আ’যম মুদ্দা জিল্লুহুল আলী তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার রহমত ব্যতীত কারো পক্ষে পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
এখন মানুষ রহমত পাবে কোথায়? সে প্রসঙ্গে তিনি কালামুল্লাহ শরীফ-এর আয়াত শরীফ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক-উনার রহমত ওলীআল্লাহ উনাদের নিকটে।”
তিনি বলেন, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা রহমতুল্লিল আলামীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ছোহবতে গিয়ে, উনার নিকট বাইয়াত হয়ে রহমত হাছিল করেছেন।
কিন্তু পরবর্তী উম্মতকে সেই রহমত হাছিল করতে হলে অবশ্যই যিনি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সত্যিকার নায়িব বা ওয়ারিছ তথা যিনি হক্কানী ওলীআল্লাহ উনার ছোহবতে যেতে হবে, উনার নিকট বাইয়াত হতে হবে। তাহলেই রহমত হাছিল করতে পারবে।
মাহে রজব ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মাহে শা’বান ও তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা
সম্মানিত রজবুল হারাম শরীফ, সম্মানিত শা’বান শরীফ ও সম্মানিত রমাদ্বান শরীফ মাস এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা