বারে এলাহীর তরেই সব প্রশংসা। যিনি পরম পবিত্র, প্রজ্ঞাময় পরওয়ারদিগার। তাঁর পেয়ারে হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি বেশুমার দরূদ ও সালাম। উম্মতের মাঝে যিনি আবির্ভূত হয়েছেন সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং যা ব্যাপ্ত করেছেন তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে। স্বজনের মৃত্যুর মত বেদনাদায়ক বিষয় থেকে উৎসবের উচ্ছাস প্রকাশের উচ্ছল মূহূর্র্তটিতেও। উম্মতে মুহম্মদীর জন্য এমনিতর বিশেষ উৎসবময় দিন হচ্ছে- ঈদুল ফিত্র।
হাদীছ শরীফে উল্লেখ রয়েছে, মদীনায় পূর্বে প্রচলিত শরৎ ও বসন্ত জ্যোৎস্নায় উদ্যাপিত নওরোজ ও মিহিরজান নামক খেল-তামাশার উৎসবকে বাদ দিয়ে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের জন্য ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আয্হার ব্যবস্থা করেন। সুতরাং আজ সে ঈদ যখন পালিত হয়, সিনেমা টিভি চ্যানেলের বিস্তর প্রোগ্রাম, ভারতের নায়িকাদের অনুকরণে ও নামে সংক্ষিপ্ত পোশাক ক্রয়- বিক্রয়, পরিধানসহ বিভিন্ন বেশরা ঢংয়ে, তখন স্পষ্টতঃই বলতে হয় যে, এসব কিছুই আমাদের ঈদ অনুভূতিকে বিকৃত করছে। ঈদের যথাযথ মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণœ করছে।
বর্ণিত রয়েছে, ঈদের দিনেও আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে ডুকরে ডুকরে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলেন। বিনীতভাবে তার কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “আমি তো জানিনা রোযার রিয়াজত-মুশাক্কাত দ্বারা, তাক্বওয়া হাছিলের দ্বারা, আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে কবুল হওয়ার আনন্দে যে সত্যিকার ঈদ, তদ্বপ্রেক্ষিতে আমার রোযা কবুল হয়েছে কি-না, আমি তাক্বওয়া হাছিল করতে পেরেছি কি না।
স্মর্তব্য তাক্বওয়াই ইসলামের মূল মাহাত্ম্য। মূলতঃ তাক্বওয়াবোধকে সমুন্নত করাই একমাস রোযা রাখার মূল নছীহত। আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান, “তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও রোযা ফরয করা হয়েছিল। অবশ্যই তোমরা তাক্বওয়া হাছিল করতে পারবে।”
উল্লেখ্য, রোযার মাসে প্রায় সবাই অপেক্ষাকৃত বেশী ইসলামী মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাক্বওয়ার পথে প্রচেষ্ট হয়। কিন্তু রোযার শিক্ষা তথা তাক্বওয়াবোধ দ্বারা উজ্জীবিত থাকতে হবে সারা বছরই। কেননা তাক্বওয়ার বিপরীত হল নফসানিয়ত, গোমরাহী তথা দুর্নীতি।
প্রসঙ্গত আমাদের জাতীয় জীবনে যে দুর্নীতির কালো থাবা বিস্তার করে আছে তার মূল কারণ হল তাক্বওয়ার অনুভূতিবোধ ও চর্চার অভাব। এবারের টি, আই রিপোর্টে দূর্নীতিতে বাংলাদেশ টানা পঞ্চমবারের মত বিশ্বের ১৫৯টি দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে। পাশাপাশি সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (দাভোস বৈঠক) ও ১১৭টি দেশে জরিপ চালিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ণয় করেছে ১১০-এ। গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্টে দেখা যায় সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রমের সূচক এবং এর উপ-সূচক দূর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্নে অর্থাৎ ১১৭ এ।
অপরদিকে প্রধান বিরোধী দলের দাবী হল বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার গত চার বছরে দুর্নীতি করেছে এক লাখ ৯৩ হাজার ৮৩ কোটি টাকারও বেশী। প্রতি বছর সরকারের নেতৃত্বে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ৪৮ হাজার ২শ ৭১ কোটি টাকা তসরুফ বা লুট হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছে পুলিশ। তন্মধ্যে আবার থানা ও ট্রাফিক পুলিশের হার বেশী। অথচ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য এদের পেছনেই বাজেট বরাদ্দ হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে দুর্নীতি আড়াল করতে মন্ত্রী আমলারা একট্টা। তাই ১৯২৩ সালের ঔপনিবেশিক শাসকদের অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টকে তারা এখনও সাদরে ধরে রাখতে চান। অনিয়ম-দুর্নীতি, কালো টাকার মালিক বনা তথা নির্বাচনী খরচ তোলা এসবে বাধা প্রাপ্তির আশঙ্কায় তারা ‘রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টের’ জন্য আদৌ আগ্রহী নন।
সম্প্রতি পত্রিকান্তরে অপর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে মাত্র কয়েকটি খাতে বছরে দেশে লোকসান হচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। টি. আই. রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ৯টি সরকারি খাতে ঘুষ আদায় হয় ৬ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। উল্লেখ্য গত ২০০২ সালেই রিপোর্ট বেরিয়েছিল বছরে তৈরি হচ্ছে ৬০ হাজার কোটি কালো টাকা। কিন্তু কথা হলো যে, এই কালো টাকা-এর বিচরণভূমি কোথায়? বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্রিস্টিন আই ওয়ালিচ মন্তব্য করেছেন, “বাংলাদেশের দুর্নীতির অন্যতম উৎস হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয়। গত নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে বিশ হাজার কোটি টাকা। এখানে নির্বাচনে জেতার ব্যয় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী।”
সহজ কথা হচ্ছে নির্বাচন হচ্ছে এখন কালো টাকা আর পেশী শক্তি বা সন্ত্রাসের খেলা। কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হারাম থেকে হারামেরই জন্ম হয়।” আর ইসলামের নামে নির্বাচন, ভোট চাওয়া যেহেতু হারাম সুতরাং তা থেকে এসব অনৈতিক অনুষঙ্গ বেরিয়ে আসবে তা তো স্বাভাবিকই।
কিন্তু তারপরও সে পথেই এগুচ্ছে আমাদের নামধারী শাইখুল হাদীছ, মুফতি, মাওলানা, খতীব গং। একসময় অর্থের অভাবে যাদের মাদ্রাসা বন্ধ থাকতো, নির্বাচনী আঁতাতে তারা এখন ফুলে-ফেঁপে ব্যাংক খোলারও তদবির করছে। যার জন্য প্রাথমিক মূলধনই প্রয়োজন একশত কোটি টাকা। পত্রিকান্তরে রিপোর্ট হয়েছে, ইসলামী আন্দোলনের নামে এরা কাদিয়ানীদের থেকেও এখন টাকা খাচ্ছে।
টাকা খেয়েই এরা ছবি তোলা, হরতাল, লংমার্চ, মৌলবাদ, ব্লাসফেমী ইত্যাদি সব হারামই জায়িয করছে। অর্থাৎ এরাও তাক্বওয়া অবলম্বন করছে না। ইসলামী খোলসে থাকা সত্ত্বেও এরাও তাক্বওয়া বর্জনকারী দল তথা মহা দুর্নীতিবাজে পরিণত হয়েছে। যেহেতু তাদের মধ্যে নেই কুপ্রবৃত্তি বা আত্মার দুর্নীতি সংশোধনের প্রক্রিয়া তথা “তাছাউফ” অর্জনের প্রবণতা ও প্রচেষ্টা।
মূলতঃ এদেশে দুর্নীতির বিস্তারের জন্য তারাই দায়ী। কারণ তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্থ হওয়ার কারণে দুর্নীতির বিরদ্ধে সাধারণের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ তথা তাক্বওয়ার চেতনা জাগরিত করতে পারেনি।
স্মর্তব্য, তাক্বওয়া আর তাছাউফ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যা কেবল মাত্র হক্কানী-রব্বানী ওলীআল্লাহ্ তথা মুজাদ্দিদে আ’যমের ছোহবতের মাধ্যমেই সম্ভব। মহান আল্লাহ্ পাক আমাদের সকলকে তা নসীব করুন। (আমীন)