মুহম্মদ ইয়াকুব আলী সিংড়া, নাটোর
জাওয়াব: তথাকথিত উক্ত ক্বওমী ইমামের বক্তব্য আদৌ শুদ্ধ নয়। বরং তা চরম মিথ্যা, মনগড়া, ভুল ও বিভ্রান্তিকর সাথে সাথে তা প্রকাশ্য কুফরী এবং কাফির ও জাহান্নামী হওয়ারও কারণ।
ক্বওমী ইমামের উক্ত কুফরীর জন্য তাকে খালিছ তওবা করতে হবে। অন্যথায় তার পিছনে নামায পড়লে, নামায শুদ্ধ হবে না।
স্মরণীয় যে, পবিত্র সূরা ইখলাছ শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ الله الصمد উনার স্থলে لله الصمد পাঠ করা হলে সাধারণভাবে লাহনে জ্বলী হওয়ার কারণে এবং অর্থ পরিবর্তন হওয়ার কারণে নামায ফউত বা ফাসিদ হয়ে যাবে। আর খাছভাবে الله الصمد উনার পরিবর্তে لله الصمد পাঠ করার কারণে পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে তাহরীফ অর্থাৎ পরিবর্তন করার কারণে তা প্রকাশ্য কুফরীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
জানা আবশ্যক যে, শব্দগত পরিবর্তন কিংবা অর্থগত পরিবর্তন, তা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে হোক অথবা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে হোক সর্বসম্মতিক্রমে তা হারাম ও কুফরী। অতএব الله الصمد (আল্লাহুছ ছমাদ) উনার পরিবর্তে لله الصمد (লিল্লাহিছ ছমাদ) পবিত্র কালাম উনার মধ্যে এক ধরণের তাহরীফ বা বিকৃতিসাধন। যা সুস্পষ্ট কুফরী।
মুসলমান নামধারী কেউ কুফরী করলে সে মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে কাফির ও মুরতাদে পরিণত হয়।
আর শরীয়তে মুরতাদের শাস্তি বা ফায়সালা হলো, তার স্ত্রী তালাক হবে যদি বিয়ে করে থাকে এবং এক্ষেত্রে পূনরায় তওবা না করে, বিয়ে না দোহরানো ব্যতীত তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করা বৈধ হবেনা। আর এ অবৈধ অবস্থায় সন্তান হলে সে সন্তানও অবৈধ হবে। হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে যদি হজ্জ করে থাকে, সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে, তার ওয়ারিশসত্ব বাতিল হবে। তাকে তিন দিন সময় দেয়া হবে তওবা করার জন্য এবং যদি তওবা করে, তবে ক্ষমা করা হবে। অন্যথায় তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ-। কেননা হাদীছ শরীফে রয়েছে, তিন কারণে মৃত্যুদ- দেয়া জায়িয। যথা- ১. ঈমান আনার পর কুফরী করলে অর্থাৎ মুরতাদ হলে। ২. ঐ ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিণী, যারা বিবাহিত বা বিবাহিতা। ৩. যে অন্যায়ভাবে কাউকে ক্বতল করে, তাকে।
আর মুরতাদ মারা যাবার পর যারা জানাযার নামায পড়ে বা পড়ায় বা জানাযার নামাযে সাহায্য-সহযোগিতা করে, তাদের সকলের উপরই মুরতাদের হুকুম বর্তাবে এবং এ সকল মুরতাদ মরলে বা নিহত হলে তাকে মুসলমানগণের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না। এমনকি মুসলমানের ন্যায়ও দাফন করা যাবেনা। বরং তাকে মৃত কুকুরের ন্যায় গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখতে হবে।
বস্তুত মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম পাক উনার মধ্যে তাহরীফ বা বিকৃতিসাধন কাফিরেরাই করে থাকে।
যেমন এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
من الذين هادوا يحرفون الكلم عن مواضعه
অর্থ : ইহুদীদের অন্তর্ভুক্ত লোকেরা পবিত্র কালাম উনার স্থান হতে পরিবর্তন করে ফেলে। (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৬)
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-
فبدل الذين ظلموا قولا غير الذى قيل لـهم فانزلنا على الذين ظلموا رجزا من السماء بما كانوا يفسقون
অর্থাৎ: তাদেরকে যেরূপ বলতে বলা হয়েছে তদ্রপ না বলে যালিমরা পরিবর্তন করে বলেছিল। ফলে আমি তাদের নাফরমানীর কারণে তাদের উপর আসমান থেকে আযাব নাযিল করি। (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৯)
পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ সব ধরণের তাহরীফ বা বিকৃতিসাধন থেকে পবিত্র। যেমন পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার সত্যতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি স্বয়ং ইরশাদ মুবারক করেন-
ذلك الكتب لا ريب فيه هدى للمتقين.
অর্থ: “এটি এমন এক কিতাব যার মধ্যে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। এটি মুত্তাক্বীনদের জন্য পথ প্রদর্শক।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ২)
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালাম পাক উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
تنزيل من رب العلمين.
অর্থ: “এটি সমগ্র আলমের মহান রব তায়ালা উনার নিকট হতে অবতীর্ণ।” (পবিত্র সূরা হাক্কাহ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩)
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-
ولو كان من عند غير الله لوجدوا فيه اختلافا كثيرا.
অর্থ: “আর যদি পবিত্র কুরআন শরীফ মহান আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া অন্য কারো নিকট হতে নাযিল হতো তাহলে তারা উনার মধ্যে অনেক ইখতিলাফ (মতবিরোধ) দেখতে পেত।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৮২)
কাজেই, পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ শুরুতেই যেভাবে নাযিল হয়েছে বর্তমানে সেভাবেই রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও সেভাবেই থাকবে। এর মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়নি এবং কস্মিনকালেও হবে না। কেননা, মহান আল্লাহ পাক তিনি স্বয়ং নিজে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার হিফাযতের ভার গ্রহণ করেছেন। সুবহানাল্লাহ!
মহান আল্লাহ পাক তিনি স্বীয় কালাম পাক সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক করেন-
بل هو قران مجيد فى لوح محفوظ.
অর্থ: “বরং এটি মহিমান্বিত কুরআন শরীফ, লওহে মাহফূযে রয়েছে।” (পবিত্র সূরা বুরূজ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ২১,২২)
উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী নাযিলকৃত আসমানী কিতাবসমূহের হিফাযতের জিম্মাদারী স্ব-স্ব হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের এবং উনাদের উম্মতদের প্রতি ছিল। যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
استحفظوا من كتب الله وكانوا عليه شهداء.
অর্থ: “উনাদের এ (তাওরাত শরীফ) খোদায়ী কিতাব উনার হিফাযত বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং উনারা উক্ত কিতাব উনার দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত ছিলেন।” (পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৪)
কিন্তু হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের বিদায়ের পর উনাদের উম্মতরা তা বিকৃত করে ফেলে। নাউযুবিল্লাহ!
আর মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি যে কালাম পাক উনার প্রিয়তম রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি নাযিল করেছেন উনার হিফাযতের জিম্মাদারী স্বয়ং তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন। এ পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ যমীনে নাযিল হওয়ার পূর্বে আসমানে “লওহে মাহফূযে” হিফাযত করেছেন। অতঃপর সেখান থেকে পৃথিবীর আকাশে “বাইতুল ইজ্জতে” অতঃপর সেখান হতে কোনরূপ পরিবর্তন-পরিবর্ধন ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত অবস্থায়, হুবহু আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি নাযিল করেন।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
انا نحن نزلنا الذكر وانا له لحفظون.
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল করেছি এবং আমিই উনার হিফাযতকারী।” (পবিত্র সূরা হিজর শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৯)
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল করে যেভাবে “লওহে মাহ্ফূযে” রেখে দিয়েছেন ঠিক সেভাবেই যমীনে নাযিল করেছেন এবং সেভাবেই অনাদি-অনন্তকাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, খলীফা মামুন তার শাহী দরবারে দিন ধার্য করে ইলমী মজলিসের ব্যবস্থা করতেন। সেই মজলিসে উপস্থিত থাকতেন তার সভাসদ, আলিম-উলামা, অন্যান্য জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ। একদিন এক নতুন ব্যক্তি উক্ত মজলিসে উপস্থিত হলো। যে ছিল খৃস্টান ধর্মাবলম্বী। সে ছিল একজন ভাষাবিদ, যে ভাষাই আলোচনা করা হতো সে ভাষায়ই সে বুঝতো ও আলোচনা করতো। এছাড়া সে তাওরাত শরীফ, যাবূর শরীফ, ইনজীল শরীফ ও পবিত্র কুরআন শরীফসহ সব আসমানী কিতাব সম্পর্কে খুব ভাল জ্ঞান রাখতো এবং সে ছিল একজন হস্ত লিখা বিশারদ। অর্থাৎ তার হাতের লিখা অত্যন্ত ভাল ছিল। এসব জেনে খলীফা মামুনের পক্ষ থেকে উক্ত ব্যক্তির নিকট প্রস্তাব পেশ করা হলো, সে যদি মুসলমান হয়ে তার দরবারে থাকে তবে তাকে বেশ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। প্রস্তাব শুনে উক্ত ব্যক্তি হ্যাঁ কিংবা না কোন জবাবই দিলনা। মজলিস শেষে তার অবস্থানে সে চলে গেল। দীর্ঘ এক বছর অনুপস্থিতির পর আবার সে উক্ত মজলিসে এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু এবার সে খৃষ্টান নয় মুসলমান হয়ে এসেছে।
তাকে সম্মানিত ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, “ইতোপূর্বে তোমাকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তুমি মুসলমান হয়ে খলীফার দরবারে থাকলে তোমাকে রাজকীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। কিন্তু তুমি সে প্রস্তাব ও সুযোগ গ্রহণ না করে চলে গেলে। অতঃপর কোন কারণে তুমি তোমার বাপ-দাদার খ্রিস্ট ধর্ম ছেড়ে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ না করে একমাত্র সম্মানিত দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হলে?”
সে জবাব দিলো, খলীফা মামুনের পক্ষ হতে তাকে মুসলমান হয়ে তার দরবারে থাকার প্রস্তাব দেয়ার পর সে নিজ আবাস স্থলে চলে যায়। গিয়ে সে প্রতিটি আসমানী কিতাব- তাওরাত শরীফ, যাবূর শরীফ, ইনজীল শরীফ ও পবিত্র কুরআন শরীফ নিজ হাতে তিন কপি করে সুন্দর করে লিপিবদ্ধ করে এবং প্রতিটি কপির মধ্যে কিছু কাট-ছাট, সংযোজন-বিয়োজন, পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে; যার ফলে একটা কপির সাথে অন্য কপির হুবহু মিল নেই, তবে প্রতিটি কপির লেখা খুবই সুন্দর ও মনোরম।
সে তার লিখিত কপিগুলো নিয়ে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের নিকট গেলো বিক্রির জন্য। অর্থাৎ প্রথমে তাওরাতের কপিগুলো নিয়ে ইহুদীদের নিকট উপস্থিত হলো। তারা কপিগুলোর সুন্দর মনোরম লিখা দেখে বেশি দামে ক্রয় করে নিল কিন্তু তার মধ্যে যে হেরফের করা হয়েছে, পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়েছে তারা সেটা যাচাই-বাছাই করলোনা। একইভাবে খৃষ্টানরাও ইনজীল কিতাবের কপিগুলো সুন্দর মনোরম লিখা দেখে কোনরূপ যাচাই-বাছাই না করেই বেশি মূল্যে ক্রয় করে নিলো। যাবূর কিতাবের কপির ক্ষেত্রেও ঠিক একই অবস্থা। সেগুলোও বেশি মূল্যে বিক্রি হয়ে গেল।
কিন্তু যখন পবিত্র কুরআন শরীফ উনার কপিগুলো নিয়ে সে মুসলমানদের নিকট উপস্থিত হলো, তারা উনার মধ্যে হেরফের, পরিবর্তন-পরিবর্ধন, কাট-ছাট দেখে সেগুলো ক্রয় করা তো দূরের কথা তারা তাকে সাবধান বাণী শুনিয়ে দিল। তখন সে উপলব্ধি করলো যে, সত্যিই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন-পরিবর্ধন, কাট-ছাট করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অতঃপর সে পবিত্র কুরআন শরীফ এবং তা যে ধর্মে তথা সম্মানিত দ্বীনে নাযিল হয়েছে অর্থাৎ সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার সত্যতা বুঝতে পেরে মুসলমান হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ!
কাজেই, বর্তমানে আমাদের মধ্যে বা আমাদের নিকট যে পবিত্র কুরআন শরীফ রয়েছে, তা মাছহাফে উছমানী শরীফ উনারই অবিকল কপি বা নকল অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর যে পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল হয়েছে হুবহু তাই। একটিমাত্র অক্ষরেরও বেশ-কম নেই। এমনকি তৎকালে মাছহাফে উছমানী শরীফ উনার মধ্যে যে কয়টি শব্দ মুবারক বর্তমান লিখন পদ্ধতির ব্যতিক্রমে লেখা হয়েছে, অদ্যাবধি তারই অনুকরণ করা হয়েছে। যেমন- “রহমত” শব্দ বর্তমান লিখন-পদ্ধতি অনুসারে গোল ‘তা’ দ্বারা رحمة লেখা হয়। কিন্তু মাছহাফে উছমানী শরীফ উনার মধ্যে উহা চার স্থানে লম্বা “তা” দ্বারা رحمت লেখা হয়েছে। এখনও পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যেও এরূপই রয়েছে। এরূপ আরো শব্দ মুবারকের উদাহরণ রয়েছে। পরে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে হিজরী ৮৬ সনে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে হরকত অর্থাৎ যের, যবর, পেশ ইত্যাদি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে অনারবগণ পবিত্র কুরআন শরীফ ভুল না পড়েন। এতে কোন শব্দের আকার বা অর্থের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। অতঃপর কেউ কেউ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সমস্ত আয়াত শরীফ, শব্দ শরীফ, অক্ষর শরীফ এমনকি নুকতা শরীফ বা বিন্দুসমূহও পর্যন্ত গণনা করে রেখেছেন। সুবহানাল্লাহ! (আল ইতকান)
অতএব, পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ যা আছে হুবহু তাই নাযিল হয়েছে। এর উপরই ইজমা বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর এর উপরই বিশ্বাস স্থাপন করা প্রত্যেকের জন্য ফরয।
পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সংজ্ঞায় বর্ণিত রয়েছে-
اما الكتاب فالقران الـمنزل على رسول الله صلى الله عليه وسلم الـمكتوب فى الـمصاحف الـمنقول عن النبى عليه السلام نقلا متواترا بلا شبهة وهو النظم والـمعنى جميعا فى قول عامة العلماء وهو الصحيح من قول ابى حنيفة عندنا.
অর্থ : “পবিত্র কিতাবুল্লাহ শরীফ উনার দ্বারা পবিত্র কুরআন মাজীদ উদ্দেশ্য; যা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, যা কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট হতে মুতাওয়াতির পদ্ধতিতে সন্দেহমুক্ত প্রক্রিয়ায় বর্ণিত হয়েছে। আর পবিত্র কুরআন শরীফ শব্দ ও অর্থ উভয়ের সমষ্টিগত নাম। এটাই সকল উলামায়ে কিরাম উনাদের মত। আমাদের কাছে ইমামে আ’যম হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতওয়া অনুযায়ী ইহাই ছহীহ মত।” (উছূলুল বাযদূবী, আল মানার, আত তা’রীফাতুল ফিক্বহিয়্যাহ)
পবিত্র কুরআন শরীফ কিতাবুল্লাহ, কালামুল্লাহ, কুরআনুম মাজীদ, কুরআনুল কারীম, ফুরক্বান ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত। পবিত্র কুরআন শরীফ হচ্ছে ওহীয়ে মাতলু অর্থাৎ যা হুবহু তিলাওয়াত করতে হয়। পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ভাষা, ভাব, শব্দ, অর্থ সবই মহান আল্লাহ পাক উনার। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম বা কথা মুবারক।
মহান আল্লাহ পাক তিনি যেমন অসীম, মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম পাক উনার শান মুবারক, ফযীলত মুবারক, মর্যাদা মুবারক, মর্ম মুবারক, ব্যাখ্যা মুবারক, তাৎপর্য মুবারক ইত্যাদিও তেমনি অসীম এবং তা গইরে মাখলূক্ব।
এ প্রসঙ্গে আকাঈদের কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে-
القران غير مخلوق من قال القران مخلوق فهو كافر.
অর্থ: “পবিত্র কুরআন শরীফ গইরে মাখলূক্ব তথা সৃষ্ট বস্তু নয়। যে ব্যক্তি বলবে পবিত্র কুরআন শরীফ মাখলূক্ব বা সৃষ্ট বস্তু সে কাফির।” (আকাইদে নাসাফী)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
انزل القران على سبعة احرف.
অর্থ: “কুরআন শরীফ সাত হরফে (ভাষায়) অবতীর্ণ হয়েছে।” (নাসায়ী, শরহুস্ সুন্নাহ্, মিশকাত, দায়লামী, বাযযার, মাজমাউয্ যাওয়ায়িদ, আল মুতালিয়াতুল আলিয়া, কাশফুল খিফা, মিরকাত)
হযরত ইমাম সুয়ূতী, আল্লামা ইমাম বদরুদ্দীন আইনী, ইমাম বুখারী, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহিম প্রমূখ উলামায়ে কিরাম এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দ্বারা সাতটি ভাষা যেমন, (১) কুরাইশ, (২) ত্বয়, (৩) তামীম, (৪) হুযাইল, (৫) ছাক্বীফ, (৬) ইয়েমেন এবং (৭) হাওয়াযিনকে বুঝিয়েছেন।
আবার কেউ কেউ সাতটি ভাষা দ্বারা সাত ক্বিরয়াতকে বুঝিয়েছেন।
সুতরাং, এই অসীম কালাম পাক উনার মাহাত্ম ও হাক্বীক্বত মাখলুক তথা জ্বিন-ইনসান কতটুকুই বুঝবে।
মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-
وما اوتيتم من العلم الا قليلا
অর্থ: “মানুষকে যৎসামান্য ইলিম ব্যতীত প্রদান করা হয়নি।” (পবিত্র সূরা বণী ইসরাঈল শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৮)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, একটা সমুদ্রের মধ্যে একটা সুঁচ ডুবিয়ে তুললে সুঁচ-এর মাথায় যতটুকু পানি উঠবে সমস্ত জ্বিন-ইনসানকে প্রদত্ত ইলিম ও নিয়ামতের পরিমাণ ততটুকু।
আসলে ক্বিল্লতে ইলম ও ক্বিল্লতে ফাহাম অর্থাৎ কম জ্ঞান ও কম বুঝই হচ্ছে সমস্ত ফিতনার মূল। ফার্সীতে একটি প্রবাদ আছে, “নীম হেকীম খতরে জান, নীম মোল্লা খতরে ঈমান।” অর্থাৎ আধা কবিরাজ বা ডাক্তার মানুষের জীবন নাশ করে আর আধা মোল্লা অর্থাৎ মালানা-মুফতী, ইমাম-খতীব মানুষের ঈমান নষ্ট করে।
অতএব, নীম মোল্লা উক্ত ক্বওমীপন্থী ইমাম সে বলেছে لله الصمد (লিল্লাহিছ ছমাদ) এ কালাম মুবারক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বহু স্থানে আছে। নাউযুবিল্লাহ! তার এ বক্তব্য চরম মিথ্যার শামিল। কেননা لله الصمد (লিল্লাহিছ ছমাদ) এরূপ আয়াত শরীফ, বাক্য বা বাক্যাংশ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার কোথাও নেই। শুধু তাই নয় الصمد (আছছমাদ) এ শব্দ মুবারকও পবিত্র সূরা ইখলাছ শরীফ ব্যতীত আর কোন সূরা শরীফ কিংবা আয়াত শরীফ উনার মধ্যে নেই।
কাজেই, উক্ত মিথ্যা বক্তব্যের কারণে কওমীপন্থী ইমাম চরম মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত হয়েছে।
পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
لعنت الله على الكاذبين
অর্থ: মিথ্যাবাদীদের উপর মহান আল্লাহ পাক উনার লা’নত বা অভিসম্পাত। (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৬১)
আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
والله يشهد ان الـمنافقين لكاذبون
অর্থ: মহান আল্লাহ পাক তিনি স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয়ই মুনাফিকরা হচ্ছে মিথ্যাবাদী। (পবিত্র সূরা মুনাফিকুন শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১)
অর্থাৎ মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলা হচ্ছে মুনাফিকদের স্বভাব। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
علمات الـمنافق ثلاثة اذا حدث كذب واذا وعد اخلف واذا اؤتمن خان
অর্থাৎ মুনাফিকদের লক্ষণ তিনটি। কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে এবং আমানত রাখলে খিয়ানত করে। (মুসনাদে আহমদ শরীফ, মিশকাত শরীফ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
انـما الكذب لكل الذنوب ام
অর্থ: নিশ্চয়ই মিথ্যা সমস্ত পাপের মূল।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত হয়েছে, আখিরী বা শেষ যামানায় বহু সংখ্যক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে তারা এমন সব কথা বলবে যা তোমরা শুননি এবং তোমাদের পূর্বপুরুষগণও শুনেনি। তোমরা তাদের থেকে দূরে থাকবে এবং তাদেরকেও তোমাদের থেকে দূরে রাখবে। তবেই তারা তোমাদেরকে ফিতনায় ফেলতে পারবে না এবং তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারবেনা। (মিশকাত শরীফ)
বলার অপেক্ষা রাখে না, উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদেরই পরিপূর্ণ মিছদাক হচ্ছে সুওয়ালে উল্লেখিত কওমীপন্থী ইমাম।
আর সে উক্ত জলজ্যান্ত মিথ্যারই দোহাই দিয়ে আরেক মিথ্যা বক্তব্য বা ফতওয়া দিয়ে বসেছে। যেমন সে বলেছে, “লিল্লাহিছ ছমাদ” পড়লে নাকি কোন ক্ষতি নেই বা নামায ফউত হবে না। নাউযুবিল্লাহ!
কওমীপন্থী ইমামকে তার উক্ত মিথ্যা ও মনগড়া বক্তব্য বা ফতওয়ার স্বপক্ষে দলীল পেশ করতে হবে। কেননা ইমাম, খতীব, মালানা, মুফতী, মুহাদ্দিছ ইত্যাদি যে কেউ হোক না কেন বিনা দলীল-প্রমাণে কারো কোন কথা বা ফতওয়া সম্মানিত ইসলামী শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য অবশ্যই পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ থেকে দলীল পেশ করতে হবে।
কেননা মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশ মুবারক হলো-
هاتوا برهانكم ان كنتم صادقين
অর্থ: যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে তোমরা দলীল পেশ করো।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
ان هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون دينكم
অর্থ: নিশ্চয়ই এই (পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের) ইলমই হচ্ছে সম্মানিত দ্বীন। অতএব তোমরা কার নিকট থেকে দ্বীন বা ইলম গ্রহণ করছো তাকে লক্ষ্য করো অর্থাৎ যাচাই বাছাই করো যে, তার আক্বীদা শুদ্ধ আছে কিনা, আমল-আখলাক্ব শুদ্ধ আছে কিনা। (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)
মহান আল্লাহ পাক না করুন, কেউ যদি বাতিল ফিরক্বা বা বাতিল আক্বীদাপন্থী কোন ব্যক্তির অনুসারী হয়, তাহলে তার আক্বীদা ও আমল নষ্ট হয়ে সে জাহান্নামী হয়ে যাবে। অতএব, সাবধান থাকতে হবে বাতিল ফিরক্বা বা বাতিল আক্বীদাপন্থী ৭২টি ফিরক্বার উলামায়ে ‘সূ’দের থেকে। এরা বাইরের দেশ থেকে আগন্তুক কেউ তা নয় বরং এরা আপনাদেরই মহল্লার, আপনাদেরই মসজিদের ইমাম, খতীব, আপনাদেরই ভাই, ভাতিজা, চাচা, বন্ধু, প্রতিবেশির মধ্যেই পরিচিত কেউ না কেউ।
স্মরনীয় যে, ইহুদী, নাছারা, কাফির, মুশরিকরা মুসলমান দেশে সরাসরি মুসলমানদের ঈমান ও আমলে বাধা দিতে গেলে তারা ধরা পড়বে এবং তারা প্রতিহত হবে সেজন্য তারা উলামায়ে “ছূ” ও মুনাফিক মুসলমানের মাধ্যমে ঈমান-আমল নষ্ট করার কোশেশ করে থাকে। তারই একটি উদাহরণ হচ্ছে উক্ত কওমীপন্থী ইমাম। যেমন কিছুদিন পূর্বে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার মুহতামিম মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, আপনারা হিন্দুস্থানে গরু কুরবানী করবেন না। কারণ গরু হচ্ছে হিন্দুদের দেবতা। নাউযুবিল্লাহ। হিন্দুদের কত বড় দালাল ও গোলাম হলে এ রকম প্রকাশ্য শরীয়তবিরোধী বক্তব্য দেয়া সম্ভব। কাজেই, শুধু ভারতেই নয় আমাদের দেশেও উক্ত মুহতামিমের স্বজাতীয় মালানা, মুফতী, ইমাম, খতীবের অভাব নেই।
এসব নামধারী মালানা, মুফতী, ইমাম, খতীব, ওয়ায়িজ, মুফাসসিরে কুরআন, শায়খুল হাদীছ ইত্যাদি খেতাবধারী হলেই তাকে অনুসরণ করা যাবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত খিতাবধারী ব্যক্তিবর্গ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের পরিপূর্ণ অনুসারী না হবে অর্থাৎ তাদের আক্বীদা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অনুযায়ী না হবে, পবিত্র সুন্নত উনার পাবন্দ না হবে, সর্বপ্রকার হারাম কাজ যেমন ছবি তোলা, বেপর্দা হওয়া, বেগানা মহিলার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা, টিভি দেখা, টিভিতে প্রোগ্রাম করা, খেলাধুলা করা, খেলাধুলা দেখা, গান-বাজনা শোনা, ভোট দেয়া, নির্বাচন করা, গণতন্ত্র করা, নারী নেতৃত্ব সমর্থন করা, হরতাল করা, লংমার্চ করা, কুশপুত্তলিকা দাহ করা ইত্যাদি থেকে বেঁচে না থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে অনুসরণ করা যাবে না। কেননা উল্লেখিত খিতাব ধারণ করে যারা সম্মানিত শরীয়ত বিরোধী তথা হারাম নাজায়িয কাজ করে এবং কাফির-মুশরিকদের প্রবর্তিত হরতাল, লংমার্চ, কুশপুত্তলিকা দাহ, ভোট, নির্বাচন, গণতন্ত্র ইত্যাদি করে তারা উলামায়ে হক্ব উনাদের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং তারা হচ্ছে উলামায়ে ‘সূ’ অর্থাৎ নিকৃষ্ট আলিমদের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ভাষায় দাজ্জালে কাযযাব অর্থাৎ চরম মিথ্যাবাদী, মুনাফিক এবং জাহান্নামী বলা হয়েছে। শুধু তাই নয় তাদেরকে জাহান্নামের সবচেয়ে কঠিন শাস্তিযোগ্য স্থান জুব্বল হুযনের অধিবাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ!
অতএব, মসজিদ কমিটি ও মুছল্লীদের দায়িত্ব কর্তব্য হচ্ছে, অতিসত্বর উক্ত ইমামকে ইমামতি থেকে বরখাস্ত করে শুদ্ধ আক্বীদা ও শুদ্ধ আমল-আখলাক্ব সম্পন্ন ইমাম নিযুক্ত করা।