মুহম্মদ শামীম আল-মামুন ভূঁইয়া (এডভোকেট)
এ.জি.পি, ঢাকা জেলা জজ আদালত, ঢাকা
সুওয়াল : জনৈক মাওলানা ছাহিব বলেছেন যে, নামাযের ক্বাযা আছে, কিন্তু কাফফারা নেই। এ বিষয়ে দলীলভিত্তিক জাওয়াব জানতে বাসনা রাখি।
জাওয়াব : ক্বিল্লতে ইলম ক্বিল্লতে ফাহম অর্থাৎ কম জ্ঞান কম বুঝই হচ্ছে ফিতনা সৃষ্টির কারণ। আর ফিতনা সম্পর্কে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
الفتنة اشد من القتل
অর্থ : ফিতনা হচ্ছে কতল অপেক্ষা বড় গুনাহ। (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৯১)
আর না জেনে কোন মাসয়ালা বললে বা মাসয়ালার জাওয়াব প্রদান করলে তার অপরাধ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
من افتى بغير علم فقد اثمه على من افتاه
অর্থ : যাকে ইলম ছাড়াই (ভুল) ফতওয়া দেয়া হয়েছে (ভুল ফতওয়া আমল করার কারণে) তার যত গুনাহ হবে তা ফতওয়াদাতার উপর বর্তাবে। (মিশকাত শরীফ)
মূলতঃ যে মাওলানা মুফতী ছাহিবের তাকওয়া-পরহেযগারিতা নেই এমন মুফতী মাওলানারাই মনগড়া, ভুল ফতওয়া দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকে।
এ শ্রেণীর মাওলানা-মুফতী, আলিম-উলামা নামধারী ব্যক্তির থেকে দূরে থাকার জন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يكون فى اخر الزمان دجالون كذابون يأتونكم من الاحاديث بما لـم تسمعوا انتم ولا اباؤكم فاياكم واياهم لا يضلونكم ولا يفتنونكم.
অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আখিরী যামানায় কিছু সংখ্যক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে, তারা তোমাদের নিকট এমন সব (মিথ্যা-মনগড়া) কথা বলবে, যা তোমরা কখনো শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও কখনো শুনেনি। সাবধান! তোমরা তাদের থেকে দূরে থাকবে এবং তোমাদেরকে তাদের থেকে দূরে রাখবে। তবেই তারা তোমাদেরকে গোমরাহ করতে পারবে না এবং ফিতনায় ফেলতে পারবেনা।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)
অত্র পবিত্র হাদীছ শরীফখানা মূলত আলিম নামধারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক হয়েছে। এখানে তাদেরকে দাজ্জালে কাযযাব অর্থাৎ চরম মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অন্য বর্ণনায় তাদেরকে উলামায়ে ‘সূ’ অর্থাৎ নিকৃষ্ট আলিম, শাররাশ শাররি অর্থাৎ সৃষ্টির নিকৃষ্টতর প্রাণী বলা হয়েছে এবং আরো বলা হয়েছে যে, তাদের আবাসস্থল জাহান্নামের সর্বনিকৃষ্টতম স্থান জুব্বুল হুযনে। নাউযুবিল্লাহ!
অতএব, সুওয়ালে উল্লেখিত মাওলানা উলামায়ে ‘সূ’দেরই অন্তর্ভুক্ত। এদের থেকে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার মাসয়ালা-মাসায়িল জানা বা গ্রহণ করা জায়িয নেই।
ছহীহ মুসলিম শরীফ-এ বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
ان هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون دينكم
অর্থ : “নিশ্চয়ই (পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ) উনাদের ইলমই হচ্ছে দ্বীন। অতঃপর তোমরা লক্ষ্য করো কার নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করছো।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)
অতএব, যাকে তাকে অনুসরণ করা, যার তার নিকট ইলম শিক্ষা করা, মাসয়ালা জিজ্ঞেস করা বা তা গ্রহণ করা জায়িয নেই। এটা পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মুবারক নির্দেশ। মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون
অর্থ : তোমাদের কোন বিষয় জানা না থাকলে যাঁরা আহলে যিকির বা আল্লাহওয়ালা উনাদেরকে জিজ্ঞেস করে তা জেনে নাও। (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩)
যিনি আল্লাহওয়ালা উনার দায়িত্ব হচ্ছে জিজ্ঞাসিত বিষয়ের সঠিক জাওয়াব প্রদান করা। এ লক্ষ্যেই যামানার তাজদীদী মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ উনার মধ্যে সঠিক এবং দলীলভিত্তিক জাওয়াব প্রদান করা হয়।
কাজেই, সুওয়ালে উল্লেখিত নামাযের কাফফারা সম্পর্কে জনৈক মাওলানা যে মাসয়ালা দিয়েছে তা মোটেও শুদ্ধ হয়নি। তা হানাফী মাযহাবের সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েছে। কেননা হানাফী মাযহাব মতে নামাযের যেরূপ ক্বাযা রয়েছে তদ্রুপ কাফফারও রয়েছে। নামাযের ক্বাযার বিষয়টি যেমনিভাবে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে ঠিক তেমনি নামাযের কাফফারার বিষয়টিও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনার দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে।
যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
عن حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنه قال لا يصلى احد من احد ولا يصوم احد من احد ولكن يطعم عنه مكان كل يوم مد من حنطة
অর্থ : রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, একজন আরেকজনের পক্ষ থেকে নামায আদায় করবে না এবং একজন আরেকজনের পক্ষ থেকে রোযা রাখবে না। বরং প্রতিদিনের (রোযার) পরিবর্তে তার পক্ষ থেকে এক মুদ করে গম খাদ্য হিসেবে প্রদান করবে। (নাসায়ী শরীফ)
অনুরূপ একখানা পবিত্র হাদীছ শরীফ হযরত ইমাম বায়হাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সূত্রে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বাণী হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, পবিত্র রমাদ্বান শরীফ উনার রোযা ক্বাযা করে যে ব্যক্তি ইনতিকাল করবে তার পক্ষ থেকে প্রতিদিনের পরিবর্তে অর্ধ সা (দুই মুদ) গম খাদ্য হিসেবে প্রদান করতে হবে।
উপরে উল্লেখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনার উপর ভিত্তি করে হানাফী মাযহাবে যে মাসয়ালা গ্রহণ করা হয়েছে তা হচ্ছে, একজনের ক্বাযাকৃত বা অনাদায়ী নামায আরেকজন আদায় করে দিলে তা আদায় হবে না। অনুরূপ একজনের ক্বাযাকৃত রোযা আরেকজন রাখলে তাও আদায় হবে না। এক্ষেত্রে ক্বাযাকৃত নামায ও রোযা উভয়ের পরিবর্তে ফিদইয়া বা কাফফারা অভাবগ্রস্তদেরকে প্রদান করতে হবে।
যেমন এ প্রসঙ্গে উছূল শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ কিতাব নূরুল আনওয়ার কিতাবে বর্ণিত রয়েছে-
ووجوب الفدية فى الصلوة للاحتياط
অর্থ: আর নামাযের ক্ষেত্রে ফিদইয়া ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি সতর্কতার ভিত্তিতে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আরো বর্ণিত রয়েছে
يجب على الوارث ان يفدى بعوض كل صلوة ما يفدى لكل صوم على الاصح
অর্থ: বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী ওয়ারিছগণের উপর প্রত্যেক নামাযের পরিবর্তে একেকটি রোযার সমপরিমাণ ফিদইয়া আদায় করা ওয়াজিব হবে।
মোট কথা হলো, রোযার ফিদইয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين
অর্থ: যারা রোযা রাখতে অপরাগ বা অক্ষম তারা রোযা রাখার পরিবর্তে ফিদইয়া স্বরূপ কোন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। (সূরা বাক্বারা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৮৪)
অর্থাৎ এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার হুকুমটি এমন একটি কারণের সাথে সম্পর্কিত, যে কারণটি রোযার ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে তেমনি নামাযের ক্ষেত্রেও রয়েছে, আর তা হচ্ছে অপারগতা। অপরপক্ষে রোযা যেরূপ উদ্দেশ্যপূর্ণ শারীরিক ইবাদত, তদ্রƒপ নামাযও উদ্দেশ্যপূর্ণ শারীরিক ইবাদত; বরং রোযা অপেক্ষা নামায অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কাজেই সম্মানিত শরীয়ত যেমন ফিদইয়াকে রোযার স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করেছে, তদ্রƒপ উহা নামাযেরও স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। তবে ক্বিয়াসের ভিত্তিতে নয়; বরং সতর্কতার দিক বিবেচনায় ফিদইয়ার হুকুমকে নামাযের দিকে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই আশায় যে, মৃত ব্যক্তি যেইসব নামায ক্বাযা করেছে উহার পরিবর্তে এ ফিদইয়া মহান আল্লাহ পাক উনার দরবার শরীফে যথেষ্ট হবে। নতুবা অন্ততঃপক্ষে ছদকার ছওয়াব তো সে পাবেই।
বস্তুতঃ হানাফী মাযহাবে নামাযের জন্য ফিদইয়া (কাফফারা) ওয়াজিব করা হয়েছে সতর্কতার দিক বিবেচনা করে, ক্বিয়াসের উপর ভিত্তি করে নয়। আর এক্ষেত্রে আমরা ফিদইয়া কবুল হওয়ার আশা পোষণ করি।
স্মরণীয় যে, ফিদইয়ার পরিমাণ হচ্ছে এক ফিতরা অর্থাৎ অর্ধ সা গম বা আটা অথবা তার মূল্য; যা বর্তমানে গ্রাম হিসেবে ১৬৫৭ গ্রাম প্রায়। তবে উত্তম হলো দুই কেজি পরিমাণ আটা বা তার মূল্য প্রদান করা।
উল্লেখ্য, ফরযের ক্বাযা আদায় করা ফরয এবং ওয়াজিবের ক্বাযা আদায় করা ওয়াজিব। তা নামায হোক কিংবা রোযা হোক। এ হিসেবে একদিনের রোযার জন্য একটি ফরয। আর একদিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য পাঁচ ফরয এবং এক ওয়াজিব।
অতএব, কারো যদি পুরো একদিনের নামায ক্বাযা হয়ে যায়, এবং সে যদি তা আদায় না করে ইনতিকাল করে তাহলে তার কাফফারা বা ফিদইয়া বাবদ পাঁচ ফরয ও এক ওয়াজিবের জন্য মোট ছয় ফিতরা পরিমাণ আটা বা তার মূল্য গরীব মিসকীনদের দান করে দিতে হবে। অর্থাৎ ফরয ও ওয়াজিব প্রতি ওয়াক্ত নামাযের জন্য অর্ধ সা বা তার মূল্য অভাবগ্রস্তদেরকে প্রদান করা হচ্ছে পবিত্র শরীয়ত উনার নির্দেশ।
দলীলসমূহ: মুসলিম শরীফ, নাসায়ী শরীফ, মিশকাত শরীফ, তাফসীরে মাযহারী শরীফ, আযযিয়াদাত, নূরুল আনওয়ার, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ফতওয়ায়ে শামী ইত্যাদি।