-মাওলানা মুহম্মদ আব্দুর রহমান
واذ اخذ الله ميثاق النبين لما اتيكم من كتب وحكمة ثم جاء كل رسول مصدق لما معكم لتؤمنن به ولتنصرنه قال ءاقررتم واخذتم على ذلكم اصرى قالوا اقررنا.
অর্থঃ- “স্মরণ করুন যখন আল্লাহ্ পাক সমস্ত নবীগণের থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি, কিতাব ও হিকমত, অতঃপর তোমাদের নিকট আসেন একজন রসূল তোমাদের কিতাবের সত্যায়ণকারী হিসাবে, তখন তোমরা সে রসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ্ পাক বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। (সূরা আলে ইমরান/৮১) উল্লিখিত আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় হযরত মুফাস্সিরীন-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ বলেছেন, কোন নবীকে নুবুওওয়ত দেয়া হয়নি, কোন রসূলকেও রিসালত দেয়া হয়নি যতক্ষণ না তাঁরা সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রিসালতকে স্বীকার করেছেন। তাঁদের প্রতি আল্লাহ্ পাক এ নির্দেশ জারি করেছেন যে, যদি আপনাদের হায়াত কালে তাঁর আগমন ঘটে তাহলে অবশ্যই আপনারা তাঁর ইত্তিবা তথা অনুসরণ-অনুকরণ করবেন। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীস শরীফে এ সম্পর্কে ইরশাদ ফরমান,
لوكان موسى حيا ما وسعه الا اتباعى.
“যদি হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম জীবিত থাকতেন তাহলে আমার ইত্তিবা তথা অনুসরণ-অনুকরণ ব্যতীত তাঁর গত্যন্তর ছিলনা অর্থাৎ আমার ইত্তিবা করতে হত।” (সুবহানাল্লাহ) একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, সমস্ত মাখলুকাতের মধ্যে আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন মানুষকে আশরাফিয়াতের মর্যাদা দান করেছেন। আর মানুষদের মধ্য থেকে নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের মর্যাদা-মর্তবা, শান সকলের উর্ধ্বে। আবার সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের চেয়ে অধিক মর্যাদা-মর্তবার অধিকারী হলেন আমাদের নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। (সুবহানাল্লাহ্) কিতাবে আরো বর্ণিত রয়েছে, আল্লাহ্ পাক প্রথম রহমত সৃষ্টি করে তা একশত ভাগ করে নিরানব্বইভাগ রহমত নিজের কাছে রেখে দেন। বাকী এক ভাগ রহমতকে আবার একশত ভাগ করে নিরানব্বই ভাগ রহমত দিয়ে দেন আখিরী নবী, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। এ প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে,
وما ارسلنك الا رحمة للعلمين.
অর্থঃ- “আমি আপনাকে সমস্ত আলমের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া/১০৭) আর অবশিষ্ট একভাগ রহমত সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম থেকে শুরু করে সমস্ত মাখলুকাতের মধ্যে বন্টন করে দেন। নিম্নে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শ্রেষ্ঠত্বের আরো কতিপয় দলীল প্রমাণ পেশ করা হল- স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
كنت اول النبين فى الخلق واخرهم فى البعث.
অর্থঃ- “আমি সৃষ্টিগতভাবে সমস্ত নবীদের প্রথম এবং প্রেরণের দিক হতে তাঁদের সকলের শেষ।” (ইবনে হাব্বান) পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
ولكن رسول الله وخاتم النبين.
অর্থঃ- “(তিনি) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন, আল্লাহ্ পাক-এর মনোনীত রসূল এবং সকল নবীদের শেষ অর্থাৎ তিনি সর্বশেষ নবী, তাঁর পরে আর কেউ নবী হবেননা।” (সূরা আহ্যাব/৪০) তিরমিযী শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
قيل له متى وجبت لك النبوة فقال وادم بين الروح والجسد.
অর্থঃ- “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল- কখন থেকে আপনি নবী? হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম যখন রূহ ও জিস্ম (শরীরের) এর মাঝে বিদ্যমান তখনও আমি নবী।” (সুবহানাল্লাহ) (তিরমিযী শরীফ) এছাড়াও আমরা পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফের বিভিন্ন আয়াতে কারীমায় দেখতে পাই যে, পূর্ববর্তী নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণকে আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন তাঁদের নাম মুবারক-এর পূর্বে হরফে নেদা সংযোগ করে সম্বোধন করেছেন, যেমন-
(সূরা বাক্বারা/৩৫, হুদ/৪৮, হুদ/৭৬, আ’রাফ/১৪৪, ছোয়াদ/২৬, মায়িদা/১১০, মরিয়ম/১৭, মরিয়ম/১৩) এরূপ আরো অনেক আয়াতে কারীমা বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু একমাত্র আমাদের নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কারণে তাঁর নাম মুবারক ধরে সম্বোধন করা হয়নি। আল্লাহ্ পাক করেননি; বরং লক্বব বা উপাধী উল্লেখ পূর্বক সম্বোধন করেছেন, এভাবে-
(সূরা আনফাল/৬৪, মায়িদা/৬৭, মুয্যাম্মিল/১, মুদ্দাছ্ছির/১) তবে তার রিসালতের প্রমাণ স্বরূপ শুধু মাত্র তাঁর নাম মুবারক কোন রূপ সম্বোধন ব্যতীতই বর্ণনা করা হয়েছে, যার কতিপয় দৃষ্টান্ত নিম্নরূপ-
(1) محمد رسول الله. (2) وما محمد الا رسول قد خلت من قبله الرسل. (3) وامنوا بما نزل على محمد وهوا الحق (4) ما كان محمد ابا احد من رجالكم.
অর্থঃ- “(১) ‘মুহম্মদ’ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ পাক-এর একজন রসূল। (সূরা ফাত্হ/৩৯) (২) মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ পাক-এর রসূল ব্যতীত আর কিছুই নন। তাঁর পূর্বে অনেক রসূল অতিবাহিত হয়েছেন। (সূরা আলে ইমরান/১৪৪) (৩) মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর যা অবর্তীণ হয়েছে, তোমরা তার উপর ঈমান আন। তিনি হচ্ছেন সত্য নবী। (সূরা মুহম্মদ/৩)। (৪) মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের মধ্যস্থিত কোন পুরুষের পিতা নন। (সূরা আহ্যাব/৪০)
পবিত্র কুরআনুল কারীমের মাধ্যমে আমরা আরো অবগত হই যে, পূর্ববর্তী উম্মতেরা স্বীয় নবীর নাম মুবারক উচ্চারণ পূর্বক সম্বোধন করত। যেমন- হযরত হুদ, হযরত ছালেহ, হযরত মুসা, হযরত ঈসা আলাইহিমুস্ সালামগণকে তাঁদের উম্মতগণ বলেছিল,
قالوا يهود ما جئتنا ببينة.
অর্থঃ- “তারা বলল, হে হযরত হুদ! (আলাইহিস্ সালাম) আপনি আমাদের নিকট কোন মু’জিযা প্রমাণ নিয়ে আসেননি।” (সূরা হুদ/৫৩)
قالوا يصلح قد كنت فينا مر جوا قبل هذا.
অর্থঃ- “তারা বলল, হে হযরত সালেহ (আলাইহিস্ সালাম) ইতোপূর্বে আপনি আমাদের অতি আশস্ত ছিলেন।” (সূরা হুদ/৬২)
قالوا يـموسى اجعل لنا الها كما لـهم الـهة.
অর্থঃ- “হে হযরত মুসা (আলাইহিস্ সালাম), তাদের উপাস্যদের মত আমাদেরকেও একজন উপাস্য করে দিন।” (সূরা আ’রাফ/১৩৮)
يعيس ابن مريم هل يستطيع ربك ان ينزل علينا مائدة من السماء.
অর্থঃ- “তারা বলল, হে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আলাইহিমাস্ সালাম), আপনার প্রভূ কি আমাদের জন্য আসমান হতে খাঞ্চা পূর্ণ খাদ্য নাযিল করতে সক্ষম?” (সূরা মায়িদা/১১২)
কিন্তু মহান আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন, আমাদের প্রিয় নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নাম মুবারক উচ্চারণ পূর্বক সম্বোধন করতে উম্মতে মুহম্মদিকে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
لا تجعلوا دعاء الرسول بينكم كدعاء بعضكم بعضا.
অর্থঃ- “তোমরা পরস্পর পরস্পরকে যেভাবে ডেকে থাক, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেভাবে ডেকো না।” (সূরা নূর/৬৩)
এ আয়াতে কারীমার তাফসীরে রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন,
لاتقولوا يا محمد قولوا يا رسول الله.
অর্থঃ- “তোমরা ইয়া মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!’ বলনা, বরং তোমরা বল, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।” ছহিবু উসওয়াতিন হাসানা, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মর্যাদা ও ফযীলতের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় হযরত বায্যার রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণিত হাদীস শরীফ থেকে। তিনি হযরত ওমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমাকে যখন আকাশে নিয়ে আসা হল (মিরাজ রজনীতে) তখন প্রত্যেক আকাশে আমার নাম লিপিবদ্ধ দেখলাম। সর্বত্রই লিখা রয়েছে, “মুহম্মদুর রসূলুল্লাহ” (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন-এর তরফ থেকে আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি যত প্রকারের ফযীলত-কামালত, মর্যাদা-মর্তবা ও ইজ্জত সম্মান দান করা হয়েছে তার সবকিছু বর্ণনা করা হয়েছে একখানি সমষ্টিভূত বাক্যে। আর তা হলো-
انا اعطينك الكوثر.
অর্থঃ- “(হে আমার মাহবুব) নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি।” (সূরা কাউছার/১)
রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, كوثر হচ্ছে দুনিয়া ও পরকালের সমস্ত কল্যাণ ও ভালাই। এমনিভাবে অসংখ্য অগণিত দলীলের দ্বারা প্রমাণিত যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিরত-ছূরত, ইল্ম-আমল, আক্বল-সমঝ, তাঁর চাল-চলন, কথা-বার্তা এক কথায় ইহকালীন, পরকালীন সর্ব বিষয়ে সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ বেশী শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার অধিকারী। (সুবহানাল্লাহ) মহান আল্লাহ্ পাক যেন আমাদেরকে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, রহমতুল্লিল আলামীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাক্বীক্বী মর্যাদা-মর্তবা, শ্রেষ্ঠত্ব, উপলব্ধি করে তাঁর যথাযথ হক্ব আদায় করার তৌফিক দান করেন এবং সমস্ত সুন্নত পালন করে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ সন্তুষ্টি-রেজামন্দী, মুহব্বত-মারিফত নছীব করেন। (আমীন)