(ধারাবাহিক)
হযরত উম্মুল মু’মিনীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্নাগণকে কতটুকু পবিত্রতা আল্লাহ পাক দিয়েছিলেন এ প্রসঙ্গে বলা হয়, সেই ইফকের ঘটনা যা ঘটেছিলো বণী মুস্তালিকের জিহাদে যখন আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি গেলেন, সেখানে হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহা তায়ালা আনহা উনার গলার হারটা হারিয়ে গেল। সেটা খুঁজতে গিয়ে তিনি পিছনে পড়ে গেলেন। তিনি পিছনে আসলেন উটে করে।
উল্লেখ্য, আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একটা আদত ছিল যখন কোন স্থান থেকে তাবু তুলে অন্য দিকে প্রস্থান করতেন অর্থাৎ গমন করতেন, পিছনে একজন লোককে পাঠাতেন কিছু রয়ে গেল কিনা দেখে আসার জন্য।
উটের যে হাওদায় হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ছিলেন সেটা রওয়ানা হয়ে গেলো। সকলেই মনে করলেন উনি হয়তো এসেছেন। কিছু অন্ধকার ছিল এবং কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা প্রথম জীবনে একটু হালকা-পাতলা ছিলেন, যার জন্য উটের উপর চড়ার কারণে তিনি উটের উপর রয়েছেন কিনা সেটা অনুধাবন করা যায়নি। উটের চলার গতি দেখেও সেটা বুঝা যায়নি। কিন্তু যে ছাহাবী পিছনে আসলেন। তিনি এসে দেখতে পেলেন, পিছনে অন্ধকারের মধ্যে আবছা-আবছা ছায়া রয়েছে, তার মধ্যে মনে হচ্ছে একজন মহিলা রয়েছেন। যিনি কাপড় মুড়ি দিয়ে বসে রয়েছেন।
অর্থাৎ হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা যখন সেই কাফিলা পেলেন না; হার খুঁজতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলো। কাফেলা পেলেন না যার জন্য চুপ করে বসে রইলেন কাপড় মুড়ি দিয়ে। যে ছাহাবী পিছনে এসেছিলেন, তিনি আকার-আকৃতি দেখে বুঝতে পারলেন ইনি হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হবেন। কারণ পূর্ববতী যামানায় উনাকে দেখেছিলেন। তিনি উট নিয়ে আসলেন, হাওদায় চড়ালেন, হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়লা আনহাকে চড়িয়ে নিয়ে গেলেন। যখন ঘটনা ঘটে গেল, যারা মুনাফিক ছিল, তারা মিথ্যা রটিয়ে দিলো। হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহা-এর নামে একটা অপবাদ। যেটা সমস্ত মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। কাফির, মুশরিক, ইহুদী, মুনাফিক সকলেই সেটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিলো আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি একটা তোহ্মত দেয়ার জন্য। উনার একটা দোষত্রুটি প্রমাণ করার জন্য তারা এটা ব্যাপক ছড়িয়ে দিলো।
আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন যে, এটা মিথ্যা। কিন্তু তিনি যদি বলেন, যে ঘটনাটা মিথ্যা তাহলে যারা কাফির, মুশরিক, মুনাফিক রয়েছে তারা বলবে যে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই তার স্ত্রীর সম্পর্কে ভাল বলে থাকে, কাজেই উনি তো সেটাই বলবেন।’
আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে জন্য চুপ করে রইলেন। যে আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে আয়াত শরীফ নাযিল হয়ে সেটা ফায়সালা হয়ে যাক। তাহলে কারো কোন চূ-চেরা, কিল-কাল থাকবে না এবং ঠিক তাই হয়েছিল। আল্লাহ্ পাক পরবর্তীতে আয়াত শরীফ নাযিল করে দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর পবিত্রতা আরো সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল, মানুষ যেটা অনুধাবন করেছিলো, যার জন্য উনাকে “ছিদ্দীকা” লক্বব দেয়া হয়েছিল।
হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা যখন এই ইফকের ঘটনায় আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হুজরা শরীফ থেকে বাড়িতে চলে গেলেন, অর্থাৎ হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ওখানে চলে গেলেন ও অবস্থান করতে লাগলেন যে, আল্লাহ্ পাক কোন ফায়সালা করেন কিনা? এদিকে কাফিরেরা, মুশরিকেরা, মুনাফিকরা সেটাতো রটাতে লাগলো। আখিরী রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটা কিছু কিছু ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, “তোমরা কী মনে করো?” উনারা প্রত্যেকেই উনাদের আক্বল, সমঝ অনুযায়ী কথা বললেন এবং হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর পবিত্রতা ঘোষণা করলেন, “এটা কস্মিন কালেও হতে পারেনা।”
সবচাইতে স্পষ্টভাবে যিনি বলেছিলেন, তিনি হলেন হযরত উমর বিন খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যার শানে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলেছিলেন,
الحق ينطق على لسان عمر.
“স্বয়ং আল্লাহ্ পাক হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর যবানে কথা বলেন।”
উনাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, “হে উমর বিন খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! “আপনি কি মনে করেন এই ঘটনার ব্যাপারে?” উনি বললেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এটা কি করে বিশ্বাস করা যেতে পারে? এই ঘটনা কি করে বিশ্বাস করা যেতে পারে? কারণ যেখানে আল্লাহ্ পাক আপনাকে এতো পবিত্র করে তৈরী করেছেন, আপনার শরীর মুবারকে কোন মশা, মাছি বসে না। কোন ময়লা পয়দা হয়না, সমস্ত অপবিত্র থেকে, নাপাকী থেকে আল্লাহ্ পাক আপনাকে পবিত্র রেখেছেন। যেখানে আপনার সমস্ত কিছুকে পবিত্র থেকে পবিত্রতম করে দেয়া হয়েছে, সেখানে এটা কি করে চিন্তা করা যেতে পারে যে হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর এই ঘটনাটা। এটা কস্মিনকালেও শুদ্ধ নয়, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানানো।” মুনাফিকদের এটা মিথ্যা তোহ্মত বলে উনি স্পষ্ট ঘোষণা করলেন।
তার কয়েকদিন পর আয়াত শরীফ নাযিল হলো। হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা তায়ালা আনহা-এর পবিত্রতা আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করে দিলেন, যে কতটুকু পবিত্রা উনারা ছিলেন। অর্থাৎ কতটুকু পবিত্রা ছিলেন সেটা আল্লাহ্ পাক এই ঘটনার মাধ্যমে ফুটিয়েছেন।
আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেছেন,
ويطهر كم تطهيرا.
“আল্লাহ্ পাক আপনাদেরকে পবিত্রা করবেন পবিত্রা করার মতোই। এমন পবিত্রা যার পর কোন অপবিত্রতার লেশমাত্রও থাকবে না, চিহ্ন মাত্রও থাকবে না।”
এরপর আল্লাহ্ পাক বলে দিলেন, যেহেতু আপনাদেরকে এত পবিত্রা থেকে পবিত্রাতম করা হলো, তাহলে আপনাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে সেটা হচ্ছে,
واذكرن ما يتلى فى بيوتكن من ايت الله والحكمة ان اله كان لطيفا خبيرا.
“আপনাদের ঘরের মধ্যে যে সমস্ত আয়াত শরীফ নাযিল হয়ে থাকে বা আলোচনা করা হয়ে থাকে এবং আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমস্ত কথা বলে থাকেন অর্থাৎ যে সমস্ত হাদীসগুলো আপনাদের এখানে আলোচনা হয়ে থাকে সেগুলো আপনারা স্মরণ রাখুন এবং সে আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফ মানুষদেরকে আপনারা সাধ্যমত তাওফিক আন্দাজ পৌঁছে দিন অর্থাৎ তা’লীম, তালক্বীন দান করুন,
ان الله كان لطيفا خبيرا.
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক সূক্ষ্মদর্শী এবং জাননেওয়ালা, সংবাদ রাখনেওয়ালা এবং সূক্ষ্মদর্শী।”
আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করে দিলেন। হযরত উম্মুল মু’মিনীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্নাদের পবিত্রতা এবং পর্দার হুকুম জানিয়ে দিলেন যে, পর্দা করা ফরয করে দেয়া হলো, শুধু তাই নয় পর্দা করা ফরয এবং আনুসাঙ্গিক যে অবস্থাগুলো বা আমলগুলো সেগুলো আল্লাহ্ পাক জানিয়ে দিলেন। এই আয়াত শরীফেই নাযিল করা হয়েছে প্রথম পর্দার জন্য।
কাজেই পর্দা প্রত্যেকের জন্যই ফরয। যেটা প্রত্যেক মুসলমান নর এবং নারীর জন্য অর্থাৎ মহিলারা পর্দা করবে পুরুষেরা তার পর্দার ব্যবস্থা করে দিবে। আর যখন পুরুষেরা রাস্তায় চলবে বা মহিলারা যখন রাস্তায় চলবে তখনও তাদের প্রতি পর্দার যে হুকুম-আহ্কাম রয়েছে তা সূক্ষ্মভাবে পালন করবে।
মূলতঃ পর্দার ফরযের জন্য আরো আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে, যেটা “সূরা আহযাব” এবং “সূরা নূরের” মধ্যে। আমরা পর্যায়ক্রমে আল্লাহ্ পাক তাওফিক দিলে সামনে আলোচনা করবো। (অসমাপ্ত)
ওয়াজ শরীফ কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ উনার আলোকে পদার গুরুত্ব-তাৎপয, ফাযায়লে-ফযীলত ও হুকুম-আহকাম