-পীরে কামিল, হাফিয, ক্বারী, মুফতী, আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মুহম্মদ শামসুদ্দোহা
وكذلك جعلنا لكل نبى عدوا شيطين الانس والجن يوحى بعضهم الى بعض زخرف القول غرورا.
অর্থঃ- “এরূপে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রু করেছি মানব ও জ্বীন জাতির মধ্য হতে যারা শয়তান; তাদেরকে। ধোকা বা প্রতারণার উদ্দেশ্যে তারা একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে।” (সূরা আনয়াম/১১২)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অনেক ওলীআল্লাহ্ তো এ রকম মুনাজাতও করতেন যে, আয় বারে খোদা! আমাকে এমন সূক্ষ্ম লেবাস দান করুন যাতে আমার গীবত-শেকায়েত ও গিল্লাহ্ বৃদ্ধি পায়। আর যারা আমার গীবত করে করে আমার গুনাহ্র বোঝা নিজের মাথায় তুলে নিলো তাদের যেন আমি আমার আখিরাতের বন্ধু মনে করতে পারি সেই তাওফিক ও ধৈর্য আমাকে দান করুন।”
সাইয়্যিদুনা হযরত ক্বাতাদাহ্ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, “প্রত্যেক সীমালঙ্ঘনকারী ও অবাধ্যরাই শয়তান। আর শয়তান মানুষকে বিভিন্নভাবে প্রতারিত করতে পারে।”
আলোচ্য আয়াত শরীফে ‘যুখরুফাল ক্বওল’ বা চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্রতারিত করার কথা উল্লিখিত হয়েছে। মূলতঃ শয়তান যখন সরাসরি প্রতারণা করতে অক্ষম হয় তখন সে তার জন্য উপযুক্ত মানুষ ও পরিবেশ খোঁজ করতে থাকে। আর মূলতঃ অবাধ্য মানুষ ও বেগানা-বেপর্দা মহিলা পরিবেষ্টিত পরিবেশই হলো শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রতারণার উপযুক্ত স্থান, সময় ও মাধ্যম।
“সূরা শুয়ারার” ২২১ ও ২২২ নং আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ্ পাক বলেন,
هل انبئكم على من تنزل الشيطين تنزل على كل افاك اثيم.
অর্থঃ- “আমি তোমাদের কি জানাবো, কার নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়? ওরা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেকটি ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর নিকট।”
বুঝা গেল, প্রত্যেক মিথ্যাবাদী ও পাপাচারী ব্যক্তিই শয়তান ধরা বা শয়তান প্রভাবিত মানুষ এবং এই শয়তান প্রভাবিত মানুষগুলোই শয়তানের খলীফা বা প্রতিনিধি হয়ে আল্লাহ্ পাক-এর যথার্থ খলীফা নবী ও ওলী আল্লাহ্গণের চরম শত্রুতায় লিপ্ত হয়। অর্থাৎ প্রকাশ্য হারামখোর প্রকাশ্য শত্রু। আর গোপন হারামখোর গোপন বা নেপথ্য শত্রু।
সাইয়্যিদুনা হযরত আবু যর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন, মানুষ শয়তান ও জ্বিন শয়তানের প্ররোচণা থেকে আল্লাহ্ পাক-এর কাছে পরিত্রাণ প্রার্থনা করো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! মানুষের মধ্যেও কি শয়তান হয়? তিনি বললেন- হ্যাঁ, আর মানুষ শয়তান, জ্বিন শয়তান অপেক্ষা অধিকতর ক্ষতিকর, নির্মম এবং পাষন্ড। কারণ আল্লাহ্ পাক-এর কাছে পরিত্রাণ প্রার্থী হলে জ্বিন শয়তান দূরে সরে যায়। কিন্তু হতভাগা-হতচ্ছাড়া মানুষ শয়তান প্রকাশ্যে পাপের পথে টানতে থাকে।
এটা আল্লাহ্ পাক-এর কুদরতী বিধান যে, তাঁর পেয়ারা ওলী, বান্দাদের নামের চর্চা হতেই থাকুক। মূলতঃ এজন্যই তিনি তাঁর মাহবুব বান্দাদের শত্রু তথা কাফির, মুনাফিক ও উলামায়ে ‘ছূ’দের সিলসিলা সর্বদা পুরাদমে চালু রেখেছেন। অর্থাৎ দুশমন যত বেশী হবে তাঁর পেয়ারা বান্দাদের নাম-ধামের চর্চাও তত বেশী হবে। আল্লাহ্ পাক এজন্যই তো সাইয়্যিদুনা হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম-এর বিরুদ্ধে ফিরআউন ও তার হাজার হাজার জালিম অনুসারী; সাইয়্যিদুনা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম-এর বিরোধিতায় নমরূদ ও তার হাজার পান্ডা সহচর এবং বিশেষতঃ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শত্রুতায় আবু জাহিল, আবু লাহাব, উতবাহ্, শাইবাহ্, উবাই ইবনে সলুল গংদের সৃষ্টি করেছেন; যেন নুবুওওয়াতের শক্তির পরিচয় দিবালোকের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
মূলতঃ নবী ও ওলীআল্লাহ্গণের শত্রুরা খুব ভালভাবেই জানতো যে, আল্লাহ্ পাক-এর পেয়ারা বান্দাগণ পঙ্কিল সমাজে বসবাস করা সত্ত্বেও তারা সমস্ত পঙ্কিলতা ও হারামীপনা থেকে নিজেদের চরিত্রকে মুক্ত করে রেখেছেন। যেহেতু ওলী আল্লাহ্গণ মাহ্ফুজ (পাপ থেকে সুরক্ষিত) অথচ তাঁদের বিরোধীরা অসংখ্য অগণিত পাপের কাজে, হারাম কাজে পূর্ণরূপে নিমজ্জিত। ফলে নিজেদের কায়িমী স্বার্থ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নিজেদের অন্ধ অনুসারীদের সামনে যেন ওলীআল্লাহ্গণ উপস্থিত হতে না পারেন তারা সদা-সর্বদা সেই ফিকিরে মগ্ন থাকে। বর্তমান পঞ্চদশ হিজরী শতাব্দীর মুযাদ্দিদ, ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, কুতুবুল আলম, আওলার্দু রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলীকেও দেখছি, সমাজের চারিদিকে এতো অসভ্যতা, নির্লজ্জতা আর হারামের ছড়াছড়ি হওয়া সত্ত্বেও যিনি নিজেকে সমস্ত রকমের হারাম থেকে যখন দূরে, বহু দূরে রেখেছেন, বরং বর্তমান যামানায় একমাত্র তাঁর মাঝেই যখন শাশ্বত ইসলাম পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হচ্ছে এবং যামানার মুযাদ্দিদ হিসেবে তিনিই সকল বেশরা-বিদয়াত নির্মূল করে ছহীহ্ ইসলাম বিকশিত করছেন; তখন তাঁর বিরোধিতা করছে সমাজের সেই সব লোক যারা অসংখ্য অগণিত প্রকাশ্য হারাম কাজে লিপ্ত।
মূলতঃ এ প্রশ্ন জেগে উঠা স্বাভাবিক যে, আখিরী যামানার কলুষযুক্ত এ সমাজ থেকে সকল বিদয়াত মিটিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সুন্নতের পূনঃপ্রচলন করার মত মহান কাজ যিনি করছেন তাঁর আবার বিরোধীতা হয় কি করে?
আসলে আল্লাহ্ পাক যথার্থই বলেছেন,
وكذلك جعلنا لكل نبى عدوا من المجرمين وكفى بربك هاديا ونصيرا.
অর্থঃ- “এভাবেই আমি প্রত্যেক হযরত নবী আলাইহিস সালাম উনার জন্য শত্রু করেছিলাম। আপনার জন্য আপনার রব তিনিই পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারীরূপে যথেষ্ট।” (সূরা ফুরক্বান/৩১)
অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক বলেন, হে আমার রসূল! সত্য ও মুখলিছকে জেনে শুনে প্রত্যাখ্যানকারীদের শয়তানী আচরণে দুঃখিত হবেন না। কারণ সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব এভাবেই চলে এসেছে। আবহমানকাল থেকে যেন পরিণামদর্শী ও মুক্তিপিয়াসী ব্যক্তি দ্বন্দ্বযুক্ত উভয়ের অবস্থাকে তুলনা করে অধিকতর উত্তমকে গ্রহণ করে ও কাছে টেনে নিতে পারে।
কারণ আমার ইচ্ছাতো এই যে,
بل نقذف بالحق على الباطل فيدمغه فاذا هو زاهق ولكم الويل مما تصفون.
অর্থঃ- “কিন্তু আমি সত্য দ্বারা মিথ্যাকে প্রচণ্ড বেগে আঘাত হেনে মিথ্যাকে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দেই। এবং তৎক্ষনাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা যা বলছো তার জন্য।” (সূরা আম্বিয়া/১৮) বুঝাই যাচ্ছে যে, বাতিল বা ভন্ডদের শোর (বা চিৎকার) হয় বেশী আর হক্ব বা সত্যের জোর (বা ক্ষমতা) হয় বেশী। যেমন হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম-এর হাত মুবারকের লাঠিখানা ফিরআউনী যাদুকরদের নিক্ষিপ্ত বস্তুগুলোকে নিমিষে হজম করে নিয়েছিলো। আর কুরআন শরীফ হাঁক-ঢাক ছাড়াই নীরবে শব্দে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর নাযিল হয়ে সকল কুফর, শিরকের ও হারামের উপর গালিব বা বিজয়ী হয়ে গেল। আসলে বিজয় হক্ব বা সত্যেরই হয়ে থাকে এবং হবে। (সমাপ্ত)
তাফসীরুল কুরআন : উলামায়ে ‘ছূ’ বা ইল্মধারী মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিণতি
তাফসীরুল কুরআন: উলামায়ে ‘ছূ’ বা ইল্মধারী মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিণতি
তাফসীরুল কুরআন: উলামায়ে ‘ছূ’ বা ইল্মধারী মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিণতি- ৪
তাফসীরুল কুরআন উলামায়ে ‘ছূ’ বা ইল্মধারী মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিণতি- ৪
তাফসীরুল কুরআন: মানুষ ও জ্বীনের মধ্যে যারা শয়তান; তারাই নবী-রসূল ও আউলিয়া-ই-কিরামগণের শত্রু