-পীরে কামিল, হাফিয, ক্বারী, মুফতী, আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মুহম্মদ শামসুদ্দোহা।
(ধারাবাহিক)
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “কুপ্রবৃত্তি ও লোভের বিরুদ্ধে জিহাদ করার নাম জিহাদে আকবর বা হক্ব জিহাদ। মূলতঃ ত্বমা বা লোভই হচ্ছে ইল্ম ধ্বংসের কারণ যা আলিমের অন্তরকে মুর্দা করে ফেলে। আর হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
عقوببة العلماء موت القلب.
অর্থঃ- “আলিমদের শাস্তিই হলো তাদের অন্তর মরে যাওয়া।” আর আলিমদের অন্তর মরে যাওয়ার অর্থই হলো অন্তরে ও কথায় শয়তানী জ্ঞান মিশ্রিত হওয়া। এ জন্যই অন্তর মরে যাওয়া তথা নিয়ত পঁচে যাওয়া আলিমের কথা ও কাজে দ্বীনের প্রলেপে বদ্দ্বীনি, হালালের মোড়কে হারাম জারি হতে থাকে, যা যামানার মুজাদ্দিদ ব্যতীত কারো পক্ষে বুঝে উঠা সম্ভব হয়না। হযরত বাগবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, এক বর্ণনায় এসেছে, তাবুক যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে রসূলে আক্রাম, সাইয়্যিদুল আরাবী ওয়াল আজম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন,
رجعنا من الجهاد ااصغر الى الجهاد الاكبر.
অর্থঃ- “আমরা এবার ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরে এলাম। জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ্, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ কি? তিনি বললেন, নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা।” একথা তো অনস্বীকার্য যে, নিয়ত বা বিশ্বাসে, কথায় ও কাজে ইখলাছ বা বিশুদ্ধতা অর্জন না হলে কোন জিহাদই মকবুল হবে না। আর প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণের মাধ্যমেই কেবল এমন বিশুদ্ধতা অর্জন ও শয়তানের ওয়াস্ওয়াসা অনুধাবন সম্ভব। আর প্রবৃত্তির দমন ব্যতীত ঐ যোগ্যতা অর্জনের কোন বিকল্পও নেই। তবে বলাই বাহুল্য যে, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে প্রয়োজন নুবুওওয়াতী কুওয়াতের; যাকে তাছাউফের পরিভাষায় বলা হয় জয্বা ও সুলূক, যা আউলিয়া-ই-কিরামের বক্ষ মুবারকে প্রচ্ছন্ন রয়েছে। (মা-লা-বুদ্দা মিনহু) মুফাস্সিরীন-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ এটাকেই ইখলাছ বা বিশুদ্ধায়ন বলেছেন। ছূফী-সাধকগণ এভাবে যখন তাঁদের প্রবৃত্তি দমনে সমর্থ হন তখন তাঁরা হন বিশুদ্ধচারী বা মুখলিছ। তাঁরা তখন নিন্দা-মন্দের পরওয়া করেননা, সুনাম-খ্যাতির আকাংখা ছাড়াই তাঁরা সম্পাদন করেন আল্লাহ্ পাক-এর ইবাদত। প্রকৃত প্রস্তাবে এরই নাম জিহাদে আকবর। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হচ্ছে এই মহান জিহাদের একটি প্রকাশ্য প্রকাশ। জানা দরকার যে, কেবল আল্লাহ্ পাক-এর রেযামন্দী বা সন্তুষ্টি কামনায় যদি জিহাদ সম্পন্ন না হয়, তবে সমস্ত প্রচেষ্টাই পরিণত হবে নিস্ফলতায়। কারণ রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবহিত করেছেন এই বলে যে,
انما لامرئ مانوى.
অর্থাৎ- “মানুষ তাই পাবে যা সে নিয়ত করেছে।” (বুখারী) তাছাড়া, কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ব্যাপারটি একান্ত সাময়িক। কিন্তু শয়তান, কাম-প্রবৃত্তি ইত্যাদি মানুষের সার্বক্ষনিক শত্রু। হর-হামেশা মানুষের সাথে (বরং মানুষের শিরা-উপশিরা ও রক্তের সাথে) এদের বাদ-বিসম্বাদ লেগেই থাকে। এছাড়া, কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদকারী ব্যক্তি শত্রুকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারে; কিন্তু নফ্স ও শয়তান মানুষের চোখে ধরা পড়ে না।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন,
انه يركم هو وقبيله من حيت اترونهم.
অর্থঃ- “তোমরা যেখানেই থাক শয়তান ও তার চেলারা তোমাদের দেখছে তবে তোমরা তাদের দেখনা।” (সূরা আ’রাফ/২৭)
আর একথা বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, দৃশ্যমান শত্রুর চাইতে অদৃশ্য শত্রু মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হয় বেশী। এছাড়া আরও একটি কারণ হলো, শয়তান সরাসরি মানুষের রিপু ও কুপ্রবৃত্তিকে মানুষের বিরুদ্ধে সাহায্য করে।
অর্থাৎ এক্ষেত্রে রিপুই হলো সকল অনিষ্ট ও স্বেচ্ছাচারিতার মূল।
এ প্রসঙ্গটিই সূরা ইউসুফের ৫৩ নং আয়াত শরীফে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ
অর্থাৎ- “নফসে আম্মারা বা কুপ্রবৃত্তি অসদ্বিষয়ে আদেশকারী।” পক্ষান্তরে কাফির, মানুষের রিপু বা নফসের পক্ষে সাহায্যকারী নয়। এ ছাড়া আরও কারণ হলো, কাফিরদের হত্যা করলে গণিমতের মাল পাওয়া যাবে। আবার কাফির কর্তৃক মারা গেলে শহীদ হওয়া যাবে ও জান্নাত পাওয়া যাবে। অর্থাৎ উভয় দিকেই লাভ। পক্ষান্তরে শয়তানকে হত্যা করার দায়িত্ব মানুষকে দেয়া হয়নি তবে শয়তান মানুষকে ওয়াস্ওয়াসা দেয়ার ক্ষমতা আল্লাহ্ পাক থেকে চেয়ে নিয়েছে। আল্লাহ্ পাক না করুন যদি শয়তান ওয়াস্তয়াসা দিয়ে মানুষকে ধ্বংস করে ফেলে তাহলে মানুষ চিরস্থায়ী ফাঁদে পড়ে গেলো। অর্থাৎ এখানে উভয় দিকেই মানুষের ক্ষতি ও ধ্বংস অনিবার্য। এজন্য ছুফীয়া-ই-কিরামগণ বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যার ঘোড়া পলায়ন করে সে শত্রুর হাতে বন্দী হয়। আর শয়তানের ফাঁদে পড়ে যার ঈমান বিলুপ্ত হয়, সে আল্লাহ্ তায়ালার আযাব ও গযবে গ্রেফতার হয়।” অনুরূপ, যে ব্যক্তি কাফিরের হাতে বন্দী হয়, হয়তবা তার হাত দুটো শিকল দিয়ে গলার সাথে বেঁধে দেয়া হয়না, পদদ্বয়ও বাঁধা হয়না, তার উদরও অভুক্ত থাকে না। কিন্তু আল্লাহ্ পাক-এর আযাব ও গযবে ধৃত ব্যক্তির অবস্থা খুবই করুণ, খুবই মারাত্মক। তার মুখমন্ডল কালো অন্ধকার করে দেয়া হয়, হাত দুটো লোহার শিকল দিয়ে গলার সাথে বেঁধে দেয়া হয়, পায়ে আগুনের বেড়ী লাগানো হয়, অগ্নি ও পুঁজ-রক্ত পানাহার করানো হয় এবং আগুনের পোশাক পরানো হয়।
তাফসীরুল কুরআন: উলামায়ে ‘ছূ’ বা ইলমধারী মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিণতি
তাফসীরুল কুরআন: উলামায়ে ‘ছূ’ বা ইলমধারী মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিণতি
তাফসীরুল কুরআন : উলামায়ে ‘ছূ’ বা ইল্মধারী মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিণতি