পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৪)

সংখ্যা: ১১৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

প্রসঙ্গঃ প্রত্যেক সালিক বা মুরীদের উচিত সকল কাজের উপর স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দেয়া ওযীফাকেই প্রাধান্য দেয়া। দিন-রাতের যে কোন সময়ই হোকনা কেন প্রথমে ওযীফা পাঠ করবে অতঃপর অন্যান্য কাজ করবে।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তবে ওযীফা তরককারীদের এই সতর্কীকরণের পদ্ধতি কোন এক বিশেষ অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন রূপ হয়ে থাকে। এমনকি কোন কাজেই সফলতা লাভ না করা কিংবা সময়ের মধ্যে বরকত না হওয়া অথবা জীবন-যাপন অতি দুর্বিষহ ও কষ্টকর হওয়াও এক প্রকার শাস্তি যা আল্লাহ্ পাক-এর তরফ হতে সতর্কীকরণ। কেননা, মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,

ولنذيقنهم من العذاب الادنى دون العذاب الاكبر لعلهم يرجعون.

অর্থঃ- “আমি তাদেরকে (পরকালের) কঠিন শাস্তি দানের পূর্বে (দুনিয়াতে) অবশ্যই লঘু শাস্তি (বিপদাপদ, রোগ-শোক) দান করব; যাতে তারা ফিরে আসে অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করে।” (সূরা সিজদা/২১)

ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত, গরীবে নেওয়াজ, কুতুবুল মাশায়িখ, হাবীবুল্লাহ্ হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “মাওলানা রাজিউদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি একদা ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘোড়ার পা গর্তে পড়ে ভেঙ্গে গেল। তিনি বাড়ীতে ফিরে এসে ভাবতে লাগলেন এ দুর্ঘটনার কারণ কি? অনেক চিন্তা-ফিকিরের পর তাঁর খেয়াল হলো যে, সকালের ওযীফা যা প্রতিদিন পাঠ করতেন তা আজ ক্বাযা হয়ে গেছে। সুতরাং এ দুর্ঘটনা তারই সতর্কীকরণ।”

হযরত খাজা আব্দুল্লাহ্ মুবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি নামে একজন বুযূর্গ ছিলেন। তিনি কোন একদিন স্বীয় ওযীফা আদায় করতে ভুলে গেলেন। অতঃপর গায়িবী নেদা (ঐশী আওয়াজ)হলো, ‘হে আব্দুল্লাহ্! আপনার প্রতিজ্ঞা যথাযথভাবে সম্পাদন হয়নি। আপনি যে ওযীফা আদায় করতেন তা আজ আদায় করতে ভুলে গিয়েছেন।” (দলীলুল আরিফীন)

স্মর্তব্য যে, তায্কিয়া-ই-নফ্স বা আত্মপরিশুদ্ধি লাভ করা এবং আল্লাহ্ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বত হাছিলের বিষয়টি অত্যন্ত আয়াসসাধ্য। কঠোর সাধনা, রিয়াজত-মুশাক্কাত ব্যতীত তার কল্পনা করা যায় না।

     তাই হে যুবক! শুধু ছূফীগণের বাহ্যিক পোশাক-পরিচ্ছদ, চাকচিক্য ও মনোমুগ্ধকর কথাবার্তা শুনেই উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধনার পথে পা বাড়াবেনা বরং তোমার বুকে যদি সৎ সাহস থাকে, যদি তুমি তোমার জীবনকে বাজি রাখতে পার তাহলে এ পথে অগ্রসর হও।’ আউলিয়া-ই-কিরামগণের এ বক্তব্য দ্বারা বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

উল্লেখ্য, সাইয়্যিদুল আউলিয়া, মাহবুবে সুবহানী হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মত ব্যক্তিত্বকে সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর ইরাকের জঙ্গলে কাটাতে হয়েছে। রিয়াজত-মুশাক্কাতের তীব্রতার কারণে তাঁর পা মুবারক চালুনের মত ছিদ্র হয়ে গিয়েছিলো। অর্ধাহারে, অনাহারে কেটে গেছে মাসের পর মাস।

শাইখুল ইসলাম হযরত ফরীদুদ্দীন মাসউদ গন্জে শোকর রহমতুল্লাহি আলাইহি এমন কঠোর রিয়াজত-মুশাক্কাতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন যে, তাঁর চেহারা মুবারকে কোন গোশ্ত ছিলো না। একটি কাক শত কোশেশ করেও খাওয়ার মত এক টুকরো গোশ্ত তাঁর শরীর মুবারকে খুঁজে পায়নি।

প্রসঙ্গতঃ বর্তমান যামানায় খোদ ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, কুতুবুল আলম, মুযাদ্দিদুয্ যামান, আওলার্দু রসূল, রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর কঠোর রিয়াজত-মুশাক্কাতের ঘটনা শুনলে শরীর শিউরে উঠে। তাঁর মত ব্যক্তিত্ত্বকে  স্বেচ্ছায় অনাহারের তরীক্বা গ্রহণ করে স্বীয় পেট মুবারকে পাথর বাঁধতে হয়েছিলো। অথচ ইচ্ছা করলে রাজকীয় জীবন-যাপন করতে তাঁর কোন অসুবিধা হতোনা। ইচ্ছা করেই বেঁছে নিলেন দুঃখ-কষ্টের জীবন। অনাহারে, অর্ধাহারে যে কত দিন কেটে গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ইশার নামাযের ওজু দিয়ে  ফজর নামায আদায় করার বিষয়টি তাঁর নিকট ছিলো একেবারেই মামুলি ব্যাপার। বরং ফজরের নামাযের ওজু দিয়ে ইশার নামায আদায় করার মত বিরল দৃষ্টান্ত আউলিয়া-ই-কিরামগণের মধ্যে একমাত্র তিনিই স্থাপন করেছেন। (সুবহানাল্লাহ্) সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দিগী করা ছিলো তাঁর স্বভাবগত আদত। রাতের শেষার্ধে পরম করুণাময়ের সাথে একান্তে মহামিলনে সারা মাখলুকাতের নাজাতের সুপারিশ ও কল্যাণ কামনায় আকুল প্রার্থনা দেখলে পরিস্কারভাবে ফুটে উঠতো কুতুবুল আলম তথা সমস্ত মাখলুকাতের ত্রাণকর্তার অনবদ্য রূপ। তাঁর পানাহারের স্বল্পতা দেখলে সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, আউলিয়া-ই-কিরামগণ দুনিয়াবী খাদ্য, পানীয়-এর মোহ্তাজ নন বরং তাঁরা সর্বদা কুদরতী খাদ্য খেয়েই জীবন-যাপন করেন। তবে যা খান তা সুন্নত আদায়ের জন্যেই খেয়ে থাকেন। তাঁর শ্রদ্ধেয় আব্বা কুতুবুজ্জামান, মুজতাযাবুদ্ দাওয়াত, গরীবে নেওয়াজ আমাদের সম্মানিত দাদা হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট থেকে এই অধমের শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, তাঁর রিয়াজত, মুশাক্কাতের কিছু কাইফিয়াত তথা নমুনা। তিনি প্রায়শঃই তাঁর রিয়াজত-মুশাক্কাতের অভিনব পদ্ধতি বর্ণনা করতেন। তিনি জানান যে, হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী যেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নাওয়া-খাওয়ার কোন প্রয়োজন অনুভব করতেন না। আল্লাহ্ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একান্ত দীদার ও জিয়ারতই তাঁর তৃষ্ণা নিবারণ করে দিত। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুহব্বত, তাওয়াজ্জুহ্-জিয়ারতই ছিলো তাঁর খাদ্যপানীয়। তিনি ছিলেন খুবই স্বল্পভাষী। তাঁর এ অবস্থা দেখলে যে কোন লোকই অনুধাবন করতে পারতেন +যে, তিনি আল্লাহ্ পাক যা বলতে বলেন তার বাইরে কোন কথাই উচ্চারণ  করেন না। সুন্নতের আমলের উপর ইস্তিকামত এবং চরম ধৈর্য দেখলে যুগের ইমামের হাক্বীক্বী গুণ অনুধাবন করতে কষ্ট হতনা।

ইল্ম চর্চায় কেটে যেত সারাটি রাত। ইল্ম চর্চায় মনোযোগ দেখলে মনে হত না যে, তিনি দুনিয়াবী কোন ব্যক্তির নিকট শিক্ষা করেছেন। বরং মনে হতো স্বয়ং আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ্ পাক এবং আল্লাহ্ পাক-এর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মহান শিক্ষাদাতা। মুহম্মদিয়া গবেষণা কেন্দ্রে তাঁর মওজুদকৃত পাঁচ কোটি টাকার অধিক কিতাবের এমন কোন কিতাব নেই, যে কিতাবে তাঁর হাত মুবারকের স্বাক্ষর পড়েনি। বরং বিশেষ বিশেষ সমস্ত কিতাবই তিনি এত অসংখ্য বার পড়েছেন এবং জরুরী বিষয় ও ভুল স্থান গুলো সনাক্ত করেছেন যা দেখলে যে কোন লোকই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাবে। তাঁর সুন্নত আমলের রিয়াজত দেখলে ফুটে উঠতো মুহ্ইস্ সুন্নাহ্ লক্ববের বাস্তব নমুনা। চরিত্র গঠনের সাধনা এবং চারিত্রিক গুণাবলী দেখে সকলকেই বলতে হয়-

كان خلقه القران. (কানা খুলুকুহুল কুরআন)। মুরীদ-মুতাকিদ পর্যন্ত দীর্ঘদিন দেখতে পেয়েছেন তাঁর হাত মুবারকে রিয়াজত-মুশাক্কাতের আলামত। ঘুমের ভাব হলে তিনি প্রজ্জ্বলিত আগর বাতির আগুন দ্বারা স্বীয় হাত-পা মুবারকে ছেঁকা দিতেন। উদ্দেশ্য, আল্লাহ্ পাক-এর সেই গুণে গুণান্বিত হওয়া যে, আল্লাহ্ পাক ঘুমান না এবং তন্দ্রাও যান না।

মূলতঃ এ সমস্ত রিয়াজত-মুশাক্কাতের বিষয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দেয়া ছবক বা ওযীফা নিয়মিত আদায় এবং পীর ছাহেবের নেক দৃষ্টি তথা ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ্-এর মাধ্যমে সহজ ও সম্ভব হয়ে উঠে। যে সমস্ত ছালেক স্বীয় পীর ছাহেবের দেয়া ওযীফা যত গুরুত্ব দিয়ে আদায় করে এবং পীর ছাহেবের দয়ার দৃষ্টি লাভ করে তাদের পক্ষেই এরূপ অসাধ্য সাধন হয়। কল্পনাতীত আমলগুলো তাদের কাছে মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়। যার কারণে সমস্ত মাশায়িখ-ই-কিরাম স্ব-স্ব মুরীদকে নিয়মিতভাবে ওযীফা আদায় করার কঠোর তাকিদ প্রদান করে থাকেন।

ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত, গরীবে নেওয়াজ, খাঁজায়ে খাঁজেগা, হাবীবুল্লাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি ওযীফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন, যে সমস্ত ওযীফা আমি পূর্ববর্তী বুযূর্গানে দ্বীন তথা পীর-মাশায়িখগণ হতে লাভ করেছি সেগুলো এখন পরিপূর্ণরূপে পালনে সুদৃঢ় রয়েছি। আর তোমাদেরকেও তা পালন করার নির্দেশ দিচ্ছি, প্রতিটি ওযীফা যা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে সেগুলোর প্রতি পরিপূর্ণরূপে যত্নবান থাকবে।”

তিনি আরো বলেন, মুরীদের উচিত স্বীয় পীর ছাহেবের নির্দেশ যেন সামান্যতম অবহেলা না হয় তৎপ্রতি খেয়াল রাখা। পীর ছাহেব ক্বিবলা যে আমল বা ওযীফা আদায়ের নির্দেশ দিবেন সে নির্দেশের প্রতি মুরীদ যেন সবিশেষ যতœবান হয়। পীর ছাহেব মুরীদের জন্য ‘কনে’ সাজানোর মত কাজ করে থাকেন। সুতরাং পীর ছাহেবের প্রতিটি নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করাই মুরীদের কামিয়াবীর কারণ।” (দলীলুল আরিফীন)

স্মর্তব্য, ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুযাদ্দিদুয্ যামান, আওলার্দু রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম, রাজারবাগ শরীফের মামদুহ হযরত হুযূর ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী মুরীদানদেরকে নছীহত করার প্রাক্কালে প্রায়শঃই একথা বলেন যে, “কিছু কর আর না কর নিজের সবক বা ওযীফা ঠিক মত আদায় করবে।

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬০)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬২)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৩)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৫)