ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৯)

সংখ্যা: ১২১তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

 পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফে অবস্থানের আদব

৬। দরবার শরীফের ধুলো-বালিকে পবিত্র ও বরকতের কারণ মনে করবে। সুতরাং শরীর থেকে তা মুছে ফেলবে না। তবে আপছে আপ যদি পড়ে যায় তবে তা স্বতন্ত্র। মাহ্বুবের (প্রিয়জন) সবকিছুই উত্তম ও প্রিয় মনে হয়ে থাকে। আর এটাই হচ্ছে মুহব্বতের দাবী। সুতরাং মাহবুবের কোন বিষয় যদি মুহিবের (প্রেমিক) অপছন্দ হয় তবে তা যে তার মুহব্বতের স্বল্পতারই কারণ তার প্রমাণের কোন প্রয়োজন নেই। হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে,

ولخلوف فم الصائم اطيب عند الله من ريح المسك.

অর্থঃ- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ্ পাক-এর নিকট মিশ্ক-আম্বর হতে অধিক প্রিয়।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত শরীফ/১৭৩) সুতরাং মুর্শিদ ক্বিবলার দরবার শরীফের ধুলা-বালি ও মুর্শিদ ক্বিবলার কদম মুবারকের পরশের কারণেই মূল্যবান ও সম্মানযোগ্য হয়েছে। কিতাবে বর্ণিত আছে, পৃথিবীর যে যমীনের উপর দিয়ে কোন হক্কানী-রব্বানী আলিম, আউলিয়া-ই-কিরাম পথ অতিক্রম করেন সেই যমীন অন্য যমীনের উপর ফখর (গর্ব) করতঃ বলে যে, ‘আমার উপর দিয়ে ওমুক ব্যক্তির পদচারণা হয়েছে।  হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, হক্কানী-রব্বানী আলিম তথা আউলিয়া-ই-কিরামগণ যদি কোন কবর স্থানের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করেন তাহলে ঐ কবরস্থানের আযাব চল্লিশ দিন পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর যদি কবরবাসীদের জন্য দোয়া করেন তাহলে  তার কবরের আযাব সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দেয়া হয়। (সুবহানাল্লাহ্)   আল্লাহ্ পাককে তালাশকারী হে পথিক! তোমার কি জানা নেই, সমস্ত ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়া-ই-কিরাম একমত যে, রওজা শরীফের সেই মাটি মুবারক যা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্পর্শ করে আছে তা আরশ-কুরসী, লৌহ-কলম হতে শ্রেষ্ঠতম। তার একমাত্র কারণই হচ্ছে আখিরী রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।  সুতরাং তাঁর উত্তরাধিকারী আউলিয়া-ই-কিরামের স্পর্শধন্য দরবার শরীফের মাটি বা ধুলো-বালির কি পরিমাণ সম্মান-ইজ্জত, মর্যাদা-মর্তবা হতে পারে তা ব্যাখ্যা করার অবকাশ রাখেনা।  ৭। পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহ্বতে কিংবা তাঁর দরবার শরীফে অবস্থান করার প্রাক্কালে সাধ্যমত হাদিয়া, তোহ্ফা নিয়ে আসবে।  হাদিয়া দেয়া এবং নেয়া উভয়ই সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

تحادوا تحابوا وتذهب الشحناء.

অর্থঃ- “তোমরা হাদিয়া আদান-প্রদান কর। তাহলে তোমাদের মুহব্বত বৃদ্ধি পাবে এবং অন্তরের কাঠিন্যতা দূরিভূত হবে।” (মিশকাত/৪০৩)

من اتاه رزق من غير مسئلة فرده فانما يرده على الله تعالى.

অর্থঃ- “সুওয়াল করা ব্যতীত যদি কারো কাছে কোন রিযিক (হাদিয়া) আসে আর তা যদি সে গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দেয় তাহলে সে যেন তা আল্লাহ্ পাককেই ফিরিয়ে দিলো।” (নাউযুবিল্লাহ্)     উল্লেখ্য যে, স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর মুহব্বত-সন্তুষ্টি মুরীদের জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। কারণ, তাঁর সামান্য স্নেহ, মুহব্বত, সন্তুষ্টি তথা দয়ার নজরই মুরীদের হাজার বছরের রাস্তা অতিক্রম করার কারণ। সুতরাং সেই বিশেষ নিয়ামত পাওয়ার জন্য মুরীদকে কিরূপ ত্যাগী হওয়া দরকার তা সহজেই অনুমেয়।   কাজেই হাদিয়া দানের ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা কিংবা মনকে সংকুচিত করা উচিত নয়। বরং উদারতার সাথে প্রশান্ত মনে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে হাদিয়া দেয়া আবশ্যক। মনে রাখবে, আল্লাহ্ পাক-এর ওলীগণ আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সকল প্রকার গুণে গুণান্বিত। কাজেই আল্লাহ্ পাক যেমন বান্দার চেহারা-ছূরত এবং ধন-সম্পদের দিকে তাকান না; তদ্রুপ আউলিয়া-ই-কিরাম তথা হক্কানী পীর ছাহেবগণ স্বীয় মুরীদের চেহারা-ছূরত, ধন-দৌলত, টাকা-পয়সার দিকে লক্ষ্য করেননা। তাঁরা লক্ষ্য করেন শুধু, সে পীর ছাহেব ক্বিবলার প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, আত্মোৎসর্গকারী, সন্তুষ্টু-রেযামন্দি ও মুহব্বত লাভের প্রত্যাশি। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

ان الله لاينظر الى صوركم واموالكم ولكن ينظر الى نيتكم وقلوبكم.

অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক তোমাদের চেহারা-ছূরত কিংবা ধন-দৌলতের দিকে লক্ষ্য করেন না বরং তিনি তোমাদের বিশুদ্ধ নিয়ত এবং অন্তরের একাগ্রতার দিকে লক্ষ্য করেন।”     স্মর্তব্য যে, আল্লাহ্ পাক-এর ওলীগণ আল্লাহ্ পাক-এর মেহমানদারীতেই জীবন-যাপনকারী। তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ্ পাক কুদরতীভাবে সম্পন্ন করার জন্য ওয়াদা দিয়েছেন। আল্লাহ্ পাক বলেন, ويرزقه من حيث لايحتسب.  অর্থঃ- “যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অবলম্বন করে(পরহিযগার) তাকে আল্লাহ্ পাক এমন স্থান থেকে রিযিক দান করেন যা সে কল্পনাও করতে পারেনা।” (সূরা ত্বলাক্ব/৩)       তাঁরা আসমানী খাবার তথা ‘মান্না সালওয়া’ খেয়েই জীবন-যাপন করেন। যাদেরকে দুনিয়ার ধন-ভাণ্ডারের চাবী অর্পণ করেন খলক্বে কায়িনাত স্বয়ং মহান আল্লাহ্ পাক। তারা কিভাবে মানুষের সামান্য ধন-সম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পারেন?  সাইয়্যিদুল আউলিয়া, মাহবুবে সুবহানী, গাউসুল আযম হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পকেটে হাত দিলেই টাকা পেতেন। সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি জায়নামাযের নীচ হতে প্রয়োজন মাফিক টাকা-পয়সা পেতেন। শাইখুল ইসলাম বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় জায়নামাযের নীচ হতে প্রতি ওয়াক্তে নামায অন্তে চিনি পেতেন যার জন্য তিনি গনজে শকর তথা চিনির গুদাম নামে আজও সারা পৃথিবী জুড়ে মশহুর হয়ে আছেন। আফযালুল আউলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি পকেট থেকে প্রয়োজন মাফিক টাকা পেতেন। মাহবুবে ইলাহী হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় খাদিমকে বলে দিলেন লঙ্গরখানায় দ্বিগুণ খানার ব্যবস্থা করবে। সাথে সাথে এটাও বলে দিলেন, যত টাকা-পয়সা প্রয়োজন হয় পাকের ঘরের “তাকে” হাত দিলে পেয়ে যাবে। সুলতানুল আরিফীন, কুতুবুল মাশায়িখ হযরত হাবীব আজমী রহমতুল্লাহি আলাইহি তো সারাজীবনই জান্নাতী খাবার খেয়েই জীবন ধারণ করেছেন। প্রতি দশদিন পর পর অচেনা-অজানা চারজন লোক এসে দশদিনের খাবার দিয়ে যেতেন। এমনকি প্রথমবার আগমনের সময় তাঁর বিবি ছাহেবাকে পরিস্কারভাবে বলেই দিয়েছিলেন যে, “আপনার স্বামীকে বলবেন, যদি কাজ (আল্লাহ্ পাক-এর ইবাদত) ভালভাবে করে তবে তাঁর বেতন বাড়িয়ে দেয়া হবে।”  উল্লেখ্য, আসমানী রিযিক আসার এ ব্যবস্থাপনা সবসময় এক রকম থাকে না। বরং সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তবুও আউলিয়া-ই-কিরামগণের সেসব নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা দ্বারা বুঝা যায়, তাঁরা কুদরতী খাবার খেয়েই জীবন ধারণ করেন। বাহ্যিকভাবে যে খাবার গ্রহণ করেন তা একান্তভাবে সুন্নত পালনের লক্ষ্যে। তাঁদের নিকট আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টির বিপরীতে সমস্ত দুনিয়ার একটা মশার ডানা পরিমাণ মূল্যও নয়। যারা সর্বদা দীদারে ইলাহীতে লিপ্ত, দুনিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করার সময় তাঁদের কোথায়? কাজেই তাঁরা মুরীদের দেয়া যে হাদীয়া গ্রহণ করেন তা একান্তভাবে সুন্নত পালন এবং মুরীদের প্রতি ইহ্সান বা করুণা করার উপলক্ষ্য বা উছীলা মাত্র।

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৪)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৫)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৬)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৭)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৮)