-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
প্রসঙ্গঃ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খালিছ সন্তুষ্টি-রেযামন্দি পাওয়ার জন্যই স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে হাদিয়া বা নজরানা দিবে। (ধারাবাহিক)
হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সে পথকে অনুসরণ করে আউলিয়া-ই-কিরাম, ইমাম-মুজতাহিদ, সূফী-দরবেশগণও স্ব-স্ব পীর ছাহেবের সাক্ষাৎ প্রাক্কালে হাদিয়া পেশ করতঃ পীর ছাহেব ক্বিবলার যে সন্তুষ্টি-রেযামন্দি পেয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, একবার শাইখুল ইসলাম, সুলতানুল আউলিয়া, হযরত খাজা আযীযান আলী রামিতানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর গৃহে হঠাৎ মেহমান আসলেন। সে সময় হযরতের ঘরে কিছুই খাবার ছিলোনা। মেহমানদারীর জন্য মনে মনে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর রুটি বিক্রেতা মুরীদ (হাদিয়া স্বরূপ) রুটি নিয়ে হাযির হলো। শাইখুল ইসলাম, সুলতানুল আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “তোমার আজকের খিদমত আমার খুবই পছন্দ হয়েছে, তুমি আজ আমার নিকট যা চাবে তাই পাবে।” মুরীদ আরজ করলো, “হুযূর! বহুদিন হতে আমার মনের আকাঙ্খা, আমি যেন আপনার মত হতে পারি।” হযরত বললেন, “এটা খুবই কঠিন ব্যাপার। তুমি এটা ব্যতীত যা চাবে তাই পাবে। কারণ তুমি তা সহ্য করতে পারবেনা।” মুরীদ পুনরায় আরজ করলেন, “আমার অন্তরে এটা ছাড়া আর কোন আরজু নেই।” শাইখুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহি মুরীদকে অনেক বুঝালেন; কিন্তু তিনি নাছোড় বান্দা। বার বার একই আরজু পেশ করতে লাগলেন। শাইখুল ইসলাম, সুলতানুল আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি অবশেষে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে।” অতঃপর কামরায় নিয়ে গিয়ে তাওয়াজ্জুহ্ দানের পর যখন বাইরে নিয়ে আসলেন তখন উক্ত মুরীদের বাতিনী তো দূরের কথা জাহিরী চেহারা পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে শাইখুল ইসলাম, সুলতানুল আউলিয়া হযরত আযিযান আলী রামিতানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মত হয়ে গিয়েছিলো।” (হালাতে মাশায়েখে নক্শাবন্দীয়া মুজাদ্দিদীয়া ১ম খন্ড, ২০০ পৃষ্ঠা) মূলতঃ আল্লাহ্ পাক-এর ওলীগণের করুণা দৃষ্টি যখন যে মুরীদের উপর পতিত হয় তখন হাজার বছরের রাস্তা এক মুহূর্তের মধ্যে অতিক্রম করে সে মঞ্জিলে মাকসুদে উপণীত হয়। সেজন্যই ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত, হাবীবে আ’লা, ইমামুদ্ দুনিয়া ফী ইলমিল ফিক্বহে ওয়াত্ তাছাউফ, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, দাফিউল বিদ্য়াত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ্ দ্বীন, আওলাদে রসূল হযরত খাজা সাইয়্যিদ বাহাউদ্দীন নক্শবন্দ বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “কামিল মুকাম্মিল পীর ছাহেবের এক নজরে বাতিন এরূপ পরিস্কার ও নূরানী হয়ে পড়ে যা বহু রিয়াজত ও মুশাক্কাতের দ্বারাও অর্জিত হয়না। (হালাতে মাশায়েখে নক্শাবন্দীয়া মুজাদ্দিদীয়া ১ম খন্ড, ২০০ পৃষ্ঠা) সুতরাং আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত ও মুহব্বত হাছিলের জন্য স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার সে দয়ার নজর কত গুরুত্ববহ ও অপরিহার্য তা নতুন করে আলোচনা করা নিস্প্রয়োজন। কেননা আবহমান কাল হতে সকল ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়া-ই-কিরাম, ছূফী-দরবেশ আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টি রেযামন্দি হাছিলের জন্য স্বীয় পীর ছাহেবের সন্তুষ্টি-রেযামন্দিকে প্রধান শর্ত বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ পীর ছাহেবের সন্তুষ্টি ব্যতীত আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টি কল্পনাই করা যায় না। আর হাদিয়া আদান-প্রদান হচ্ছে সে মুহব্বত ও সন্তুষ্টি পাওয়ার একটি উত্তম ও সহজ মাধ্যম।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে,
تهادوا تحابوا وتذهب الشحناء.
অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা হাদিয়া আদান-প্রদান করো, তাতে মুহব্বত-ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে এবং শত্রুতা বিদূরীত হবে।” (মিশকাত শরীফ/৪০৩) হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত আছে,
تهادوا فان الهدية تذهب الضغائن.
অর্থাৎ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া বা উপহার প্রদান কর। কেননা হাদিয়া হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে।” (মিশকাত শরীফ/২৬১)
ইমামুল মুহাদ্দিসীন, ফকীহুল উম্মত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, সুলতানুল আরিফীন, হযরতুল আল্লামা আলী ইবনে সুলতান মুহম্মদ ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “মিরকাতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতিল মাসাবীহ” কিতাবের ৬/১৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
تزيل لبغض والعداوة وتحضل الالغة والمحبة.
অর্থঃ- “হাদিয়া হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা দূরীভূত করে এবং মুহব্বত ও ভালবাসা সৃষ্টি করে।” অনুরূপভাবে হাদিয়া রিযিকের সংকীর্ণতা দূরীভূত করে এবং জীবিকা বৃদ্ধি করে। রঈসুল মুফাস্সিরীন, ইমামুর রাসিখীন, ছহিবু রসূলিল্লাহ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত,
تهادوا اطعام بينكم فان ذك توسعة فى ارزاقكم.
অর্থঃ- “তোমরা পরস্পর খাদ্যকে হাদিয়া হিসেবে আদান-প্রদান কর। কেননা এটা তোমাদের রিযিক বৃদ্ধির কারণ।” (তিরমিযী শরীফ, মিরকাত ৬/১৫৮) কাজেই আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বতের অভিলাষী মুরীদের জন্য একান্ত জরুরী যে, স্বীয় পীর ছাহেবের সাক্ষাৎকালে তাঁর নৈকট্য ও মুহব্বত পাওয়ার আশায় হাদিয়া প্রদান করতঃ সাক্ষাৎ করা বা ছোহবত লাভ করা। হাদিয়া বা নজরানা আদান-প্রদানের বিষয়টি আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এত প্রিয় যে, তা যত স্বল্প হোক না কেন তা প্রদান করতে বলেছেন। আর তাকে যেন ক্ষুদ্র মনে করে হাদিয়া দাতাকে ফেরৎ দেয়া না হয় তার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
من عرض عليه ريحان فلايرده فانه خفيف امحم طيب الريح.
অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যাকে সুগন্ধি দান করা হয় সে যেন তা ফিরিয়ে না দেয়। কেননা, এটা হালকা বোঝা, অথচ সুগন্ধযুক্ত।” (মুসলিম , মিশকাত শরীফ/২৬০)
এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে,
ان اهدية اذا كانت قليلة وتتضمن نفعا تاما فلا تردوها لئلا يتأذى المهدى.
অর্থঃ- “হাদিয়া (উপহার) যদি কম হয় এবং তা যদি পরিপূর্ণ ফায়দা দান করে তাহলে তা ফিরিয়ে দিওনা। কেননা, তাতে মুহদী (হাদিয়া প্রদানকারী) কষ্ট পায়।” (মিরকাত ৬/১৫২, শরহুত্ ত্বীবী ৬/১৭৯)
হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,
تلاث لاترد اوسائد والدهن والين.
অর্থঃ- “আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তিনটি জিনিস ফিরিয়ে দেয়া যায়না। বালিশ, তৈল এবং দুধ।” (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ/২৬১)
সেক্ষেত্রে হাদিয়ার কম-বেশীর প্রতি লক্ষ্য না রাখা উচিত। কেননা, আল্লাহ পাক স্বয়ং তাঁর নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের প্রতি অহী নাযিল করেছেন-“হাদিয়ার স্বল্পতার দিকে নজর দিবেন না, বরং দাতার ইয্যত-সম্মান ও মনের দিকে নজর দিবেন।” (গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন) হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
لودعيت الى ذراع او كراع لأجبت ولو اهدى الى ذراع او كراع لقبلت.
অর্থঃ- “আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমাকে যদি ছাগলের একটি ক্ষুর অথবা একটি রান খাওয়ার জন্য দাওয়াত করা হয় অবশ্যই আমি তাতে সাড়া দিব। আর আমাকে যদি ছাগলের একটি ক্ষুর কিংবা একটি রান হাদিয়া স্বরূপ দেয়া হয় তবুও আমি তা কবুল করব।” (বুখারী শরীফ ১/৩৪৯) হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে,
تهادوا فان الهدية تذهب وحر الصدر ولا تحقرن جارة لجاربها وو شق فرسن شاة.
অর্থঃ- “আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা হাদিয়ার আদান-প্রদান করো। কেননা হাদিয়া অন্তরের কলুষতা দূর করে। তোমরা হাদিয়াকে সামান্য মনে করে এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিতে অবহেলা করোনা, যদিও তা এক টুকরা ভেড়ার ক্ষুর হয়।” (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ/২৬০, ফিকহুল হানাফী ফী সওবিহীল জাদীদ২/৩৮৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫১)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৪)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৫)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৬)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৭)