-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
৩৯। আল্লাহ্ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খালিছ সন্তুষ্টি-রেযামন্দি পাওয়ার জন্যই স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে হাদিয়া বা নজরানা দিবে।
কেননা, হাদিয়া বা নজরানা দিয়ে দুনিয়াবী ফায়দা কামনা করা বা অধিক পাওয়ার আশায় হাদিয়া পেশ করা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। কারণ এরূপ মনোভাব বা উদ্দেশ্য আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসন্তুষ্টির কারণ।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে,
عن ابى هريرة رضى اله تعالى عنه ان اعرابيا اهدى برسول الله صلى الله عليه وسلم بكرة فعوضه منها ست بكرات فتسخط فبلغ ذلك النبى صلى اله عليه وسلم فحمد الله واثنى عليه ثم قال ان فلانا اهدى الى ناقة فعوضته منها ست بكرات قظل ساخطا لقد هممت ان لا اقبل هدية الا من قريش او انصارى اوثقفى اودوسى.
অর্থঃ- “হযরত আবূ হুরায়রাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, একদা এক বেদুঈন ব্যক্তি (মরুবাসী) আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একটি উটনি হাদিয়া স্বরূপ দান করলো। সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রতিদানে ছয়টি উটনি হাদিয়া দিলেন; কিন্তু এতে সে ব্যক্তি (খুশি হলো না বরং) নাখোশ হলো। এ খবর সাইয়্যিদুল আন্য়াম, শাফিউল উমাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পৌঁছলে তিনি আল্লাহ্ পাক-এর হামদ ও ছানা পাঠ করতঃ বললেন- “অমুক ব্যক্তি আমাকে একটি উটনি হাদিয়া বা উপহার দিয়েছে। আর আমি তার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ছয়টি উটনি হাদিয়া স্বরূপ দিয়েছি, কিন্তু সে তাতেও নাখোশ বা অসন্তুষ্ট। আল্লাহ্ পাক-এর কসম! আমি সংকল্প বদ্ধ হয়েছি যে, কোন কুরাঈশী অথবা আনসারী অথবা সাকাফী অথবা দাওসী ব্যতীত কারো হাদিয়া বা নজরানা গ্রহণ করবো না।” (তিরমিযী শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, নাসায়ী শরীফ, মিশকাত শরীফ)
অর্থাৎ যারা ভদ্র ও অভিজাত লোক, যারা হাদিয়া প্রদানে দুনিয়াবী কোন প্রতিদান কামনা করেনা, একমাত্র আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খালিছ সন্তুষ্টি-রেযামন্দি হাছিলের আশায় হাদিয়া প্রদান করেন তাদেরই হাদিয়া তিনি গ্রহণ করবেন।
স্মর্তব্য যে, হাদিয়া অর্থই হচ্ছে,
الهدية تمليك الغير شيئا تقربا اليه واكرام له.
“কারো নৈকট্য লাভের আশায় তাঁর সম্মানার্থে তাঁকে কোন জিনিষের মালিক বানানো। বা কিছু দান করাকে হাদিয়া বলে।” (শরহুত ত্বীবী ৪/৪৯, মিরকাত ৪/১৬৪)
لان الهدية مايؤخذ بلا شرط الاعادة.
অর্থঃ- “ফেরৎ দেয়ার শর্তারোপ ব্যতীত যা গ্রহণ করা হয় তাকে হাদিয়া বলে।” (আত্ তা’রীফাত লিয যুরযানী, আল ফিক্বহুল হানাফী ফি সওবিহীন জাদাদ ২/৩৮৭)
কাজেই যখন এ উদ্দেশ্য ব্যহত হয় তখন তাকে হাদিয়া বলা যায়না। হাদিয়া হচ্ছে মুহব্বতের সেতু বন্ধন। যার দ্বারা পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
সর্বোপরি হাদিয়া বা উপহার আদান-প্রদান করা আখিরী রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে,
عن عائشة رضى الله تعالى عنها قالت كان النبى صلى الله عليه وسلم يقبل الهدية ويثيب عليها.
অর্থঃ- “উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া গ্রহণ করতেন এবং তার বিনিময় দিতেন।” (বুখারী শরীফ, নাসাঈ শরীফ, কানযুল উম্মাল ৫/৩২৭)
হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত আছে,
عن على رضى الله تعالى عنه قال أهدى كسرى لرسول الله صلى الله عليه وسلم فقبل منه وأهدى له الملوك فقبل منهم.
অর্থঃ- “বাবুল ইল্ম ওয়াল হিকাম হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একদা পারস্যের সম্রাট হাদিয়া দিলেন, তিনি তা গ্রহণ করলেন। রোম সম্রাট তাঁকে হাদিয়া দিলেন তাও তিনি গ্রহণ করলেন। অনুরূপ রাজা-বাদশাহ্রা তাঁকে হাদিয়া প্রদান করতেন আর তিনি তা কবুল করতেন।” (আহমদ, তিরমিযী শরীফ, কানযুল উম্মাল ৫/৩২৫)
পূর্ববর্তী সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ হাদিয়া গ্রহণ করতেন এবং তাঁরাও অন্যকে হাদিয়া দিতেন। হাদিয়া নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের সুন্নতহেতু এটাকে উত্তম বা প্রথম শ্রেণীর হালাল রিযিক বলে অভিহিত করা হয়েছে।
অতএব, হাদিয়ার বিষয়টি এত ফযীলতপূর্ণ ও খাছ সুন্নতি আমল হওয়ায় তার দ্বারা মূলতঃ রেজায়ে মুর্শিদ, রেজায়ে নবী ও রেজায়ে মাওলা হাছিলের মকছুদ করাই উচিত। কারণ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, রহমতুল্লিল আলামীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি বা রেযামন্দি হচ্ছে সবচেয়ে বড় নিয়ামত। পীরে কামিল, মুর্শিদে মুকাম্মিল, ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদু মিল্লাত্ ওয়াদ্ দ্বীন, হাকীমুল হাদীস, সুলতানুল আরিফীন, বুরহানুল আশিকীন, সাইয়্যিদুল আউলিয়া, গাউসুল আ’যম, হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমার্মু রাসিখীন, আমিরুল মু’মিনীন, শায়খুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ, সাইয়্যিদুল মুজতাহিদ্বীন, সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা, মুফতিউল আযম, খলীফাতুল্লাহি ফিল আরদ, ছহেবে সুলতানিন্ নাছীর, ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত, ক্বাইয়্যূমুয্ যামান, ক্বাবিউল আউয়াল, জাব্বারিউল আউয়াল, দাফিউল বিদ্য়াত, রসূলে নুমা, ফখরুল ফুক্বাহা, সুলতানুল ওয়ায়েজীন, সিরাজুল উম্মাহ্, লিসানুল্লাহ্, খাজিনার্তু রহমাহ্, হাবীবুল্লাহ্, আওলার্দু রসূল, ফারুকে আযম, সুলতানুল মুহাদ্দাসীন, বাহরুল উলুম, জামিউল আলক্বাব, আল্লামাতুল আইয়াম, রঈসুল মুহাদ্দিসীন, তাজুল মুফাস্সিরীন, ইমামুছ্ ছিদ্দীকিন ওয়াল মুসলিমীন, মামদুহ্ রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেছেন, “দুনিয়ার যমীনে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছে, সুন্নতের ইত্তিবা বা অনুসরণ-অনুকরণ করা। জান্নাতের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছে, আল্লাহ্ পাক-এর দীদার। আর দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছে, আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টি বা রেযামন্দি।” এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে,
رضوان من الله اكبر.
অর্থাৎ- “আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টি হচ্ছে সবচেয়ে বড় নিয়ামত। ” (সূরা তওবা/৭২) হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এ সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত লাভের ক্ষেত্রে ছিলেন অগ্রগামী। যখন তাঁরা সাইয়্যিদুল কাওনাইন, ফখরে দু’আলম, মাশুকে মাওলা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র ছোহ্বতে আসতেন তখন হাদিয়া প্রদান করতেন। যার ফলশ্রুতিতে যে নৈকট্য, সন্তুষ্টি-রেজামন্দি, মুহব্বত পেয়েছেন তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত কোন লোকের পক্ষে লাভ করা সম্ভব হবেনা।
এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, “হযরত আনাছ ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, জাহির ইবনে হারাম নামক একজন বেদুঈন (গ্রাম্য) ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য গ্রাম হতে হাদিয়া নিয়ে আসতেন। আর তিনি যখন যাওয়ার ইচ্ছা করতেন তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কিছু (শহরের) জিনিসপত্র দিয়ে দিতেন এবং বলতেন, “জাহির আমাদের গ্রাম আর আমরা তার শহর। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে খুবই মুহব্বত করতেন।” (শরহে সুন্নাহ্, মিশকাত শরীফ/৪১৬) একদা ছহিবু রসূলিল্লাহ্ হযরত উসমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খাদ্য বোঝাই ১৪টি উট কিনলেন এবং তন্মধ্য হতে ৯টি রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট হাদিয়া স্বরূপ পাঠালেন। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হলো যে, হযরত উসমান যিন্ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এগুলো হাদিয়া স্বরূপ পাঠিয়েছেন। তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুশি হলেন। হাত মুবারক আকাশের দিকে উঠিয়ে উচ্চ স্বরে ছহিবু রসূলিল্লাহ্ জুল হিজরাতাইন হযরত উসমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করলেন।” (হায়াতুছ্ ছাহাবাহ্) অন্যত্র বর্ণিত আছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য এই বলে আল্লাহ্ পাক-এর নিকট দোয়া করলেন, “আয় আল্লাহ্ পাক! আপনি (হযরত) উসমান (রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু)কে ভুলে যাবেননা। দোয়া সমাপনান্তে বললেন, “আজকের পর হতে (হযরত) উসমান (রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) যদি কোন আমল নাও করে তবুও তাঁকে কোন কৈফিয়ত দিতে হবেনা।” (সুবহানাল্লাহ্) (হায়াতুছ্ ছাহাবাহ্)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫২)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৪)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৫)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৬)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৭)