ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৬)

সংখ্যা: ১১৮তম সংখ্যা | বিভাগ:

৪৪। পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহবত ইখতিয়ারের লক্ষ্যে তাঁর নিকট কিছুদিন অবস্থান করার ইচ্ছা করলে পূর্বেই চিঠি-পত্র বা অন্য কোন মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে আসবে। সেক্ষেত্রে সরাসরি পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর নিকট পত্র না লিখে তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠ মুরীদের নিকট লিখাই অধিক শরাফত ও শিষ্টতা।           আদব বা শিষ্টাচার ইল্মে তাছাউফের বুনিয়াদ বা ভিত্তি। আদব ব্যতীত আমলের কোন মূল্য নেই। যুগে যুগে যারা গোমরাহ্ বা পথভ্রষ্ট হয়েছে তারা সকলেই বেয়াদবীর কারণেই হয়েছে। আর যারা সম্মানিত, মর্যাদাবান হয়েছেন তাঁরা সেই আদবেরই কারণে হয়েছেন।

আফযালুল আউলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “পীর ছাহেবের ছোহবতের আদব বা শিষ্টাচার রক্ষা করা এবং তাঁর (ছোহবত) শর্তসমূহ বজায় রাখা তাছাউফের পথের জন্য ফরয। ছোহবতের আদব এবং তার শর্তসমূহ অক্ষুন্ন রাখলে অতি সহসাই ফায়দা (উপকার) আদান-প্রদানের পথ উন্মুক্ত হবে। আর এটা ব্যতীত ছোহবত ইখতিয়ারের মধ্যে কোন ফায়দা হবেনা, পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর মজলিসে অবস্থান করার মধ্যে কোন উপকারীতা দেখা যাবেনা।” (মাকতুবাত শরীফ ৩য় খণ্ড, ২৯২ নং মাকতুব)  আর ছোহবত ইখতিয়ার করা বা পীর ছাহিব ক্বিবলা-এর সাহচর্যে থাকার জন্য স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর অনুমতি থাকা ছোহবতের অন্যতম আদব।

উল্লেখ্য যে, ছোহবত ইখতিয়ারের জন্য আউলিয়া-ই-কিরামগণের আম বা সাধারণভাবে অনুমতি থাকে। যেমন, বর্তমান যামানার যিনি ইমাম ও মুজতাহিদ, ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয্ যামান, সুলতানুল আরিফীন, আওলাদুর রসূল, ঢাকা রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর নিকট কেউ বাইয়াত হলে উনি ছোহবত ইখতিয়ার করার লক্ষ্যে আসা-যাওয়া করতে বলেন।          এ প্রসঙ্গে একদা এক মজলিসে তিনি বলেন, কোন ছালিক যদি তার পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর নিকটবর্তী কোন স্থানে অবস্থান করে; কিংবা তাঁর পরশী হয় তাহলে তার উচিৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেই স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহবত ইখতিয়ার করা। যদি দূরে অবস্থান করে তাহলে কমপক্ষে দৈনিক একবার হলেও স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর সাথে সাক্ষাৎ করা আবশ্যক। যদি আরো দূরে অবস্থান করে; যার ফলে প্রতিদিন সাক্ষাতের সুযোগ ও সময় না হয় তাহলে কমপক্ষে সপ্তাহে একবার হলেও মোলাকাত করবে। যদি আরো দুরে অবস্থান করে; যার ফলে সাক্ষাতের সুযোগ না হয় তাহলে পনের দিনে একবার। আরো দূরে অবস্থান করলে কমপক্ষে মাসে একবার স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহবতে সময় ব্যয় করবে। আর যদি দুরত্ব বেশী হওয়ার কারণে তাও সম্ভব না হয় তাহলে কমপক্ষে তিন মাসে একবার। যদি তার চেয়ে আরো বেশী দূরবর্তী হয় কিংবা বিদেশে অবস্থান করেন তাহলে ন্যূনতম পক্ষে ছয় মাসে একবার হলেও স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহবত ইখতিয়ার করা উচিৎ। যদি আরো দূরবর্তী দেশে অবস্থান করে তাহলে বৎসরে একবার স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহবত ইখতিয়ার করবে। তবে পীর ছাহেব বা খানকা শরীফ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে টেলিফোন, টেলিগ্রাম, চিঠি-পত্র কিংবা অন্য কোন মাধ্যমে যথাসম্ভব সর্বদা যোগাযোগ রাখবে।  যাতে পীর ছাহেবের কাছে সংবাদের আদান প্রদান করতে পারে।

কেননা হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

المكتوب نصف الملاقة.

অর্থঃ- “চিঠি হচ্ছে অর্ধেক সাক্ষাৎ।”

তবে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফে কিছুদিন অবস্থান করতে হলে তাঁর অনুমতি থাকা বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি দরবার শরীফের আদব, মর্যাদা, মর্তবার প্রতি গভীর ভাবে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক।     উল্লেখ্য যে, মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে অবস্থান করা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ও বরকতের কারণ। তা সত্ত্বেও ফতওয়া দেয়া হয়েছে যে, ‘মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে অবস্থান করা মাকরূহ। কারণ, মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফের যথাযথ আদব রক্ষা করা সকলের পক্ষে সর্বদা সম্ভব নয়।’

অনুরূপ পীর ছাহেব-এর দরবার শরীফে অবস্থান করাও অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ও বরকতের কারণ। কিন্তু তার যথাযথ হক্ব আদায় করতে হবে, আদব বজায় রাখতে হবে।

পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার

শরীফে অবস্থানের আদব

‘দরবার’ হচ্ছে ফার্সী শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে- বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অবস্থান স্থান বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা আহুত সভা আর পারিভাষিকভাবে আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর প্রিয় হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক মনোনীত ও নির্ধারিত আউলিয়া-ই-কিরামের হিদায়েতের কেন্দ্রস্থলকে দরবার বলা হয়। যেখানে আউলিয়া-ই-কিরামগণ অবস্থান করতঃ উম্মাহ্র হিদায়েতের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন বা আঞ্জাম দেন।

যেখানে ছূফীয়া-ই-কিরাম তথা গাউস, কুতুব, ওলী, আবদালগণের প্রত্যহ সমাবেশ হয়। আর যেহেতু বিশিষ্ট ব্যক্তি তথা আউলিয়া-ই-কিরামগণ অবস্থান করেন সে কারণে উক্ত স্থানটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মতই বৈশিষ্ট্যধারী, মর্যাদাসম্পন্ন। সুতরাং সে সম্মান-মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য করে ‘শরীফ’ শব্দটি যুক্ত করতঃ “দরবার শরীফ” বলা হয়।

স্মর্তব্য যে, প্রত্যেক আউলিয়া-ই-কিরামের বিশেষভাবে সংরক্ষিত একটি এলাকা থাকে। যেখানে শয়তান, জ্বীন ইত্যাদি সর্বপ্রকার ষড়যন্ত্র হতে মুক্ত থাকে। শয়তানের কোন প্রকার প্রভাব সেখানে পড়তে পারে না। তার পরিধি সংশ্লিষ্ট আউলিয়া-ই-কিরামের মর্যাদা-মর্তবা বুযূর্গী-সম্মান অনুপাতে কম-বেশী হয়ে থাকে। অর্থাৎ যিনি যত মর্যাদা-সম্পন্ন তাঁর দরবার শরীফের পরিধি তত বেশী প্রসারিত হয়ে থাকে। ছালিকগণের সুবিধার্থে দরবার শরীফের কিছু আদব উল্লেখ করা হলো- (১) পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহবত বা সাহচর্য কিংবা তাঁর দরবার শরীফে অবস্থান করার উদ্দেশ্যে তথায় গমনের পূর্বে নিয়তকে বিশুদ্ধ করা। একমাত্র আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খালিছ মা’রিফত, মুহব্বত তথা সন্তুষ্টি হাছিলের উদ্দেশ্যে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহবত ইখতিয়ার করবে কিংবা দরবার শরীফে অবস্থান করবে। দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্য তার মধ্যে রাখবে না।

কেননা হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

انما الاعمال بالنيات وانما لامرئ مانوى فمن كانت هجرته الى الله ورسوله فهجرته الى الله ورسوله.

অর্থঃ- “সমস্ত কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সেটাই রয়েছে যা সে নিয়ত করে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি হাছিলের উদ্দেশ্যে হিজরত (ছফর) করবে নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি-রেযামন্দি হাছিল করতে পারবে।” (বুখারী শরীফ-১/১, মিশকাত শরীফ- ১/১)

আর মুরীদ স্বীয় পীর ছাহিব ক্বিবলা-এর ছোহবত ইখতিয়ার বা মোলাকাতের  চেয়ে আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কুরবত বা নৈকট্য লাভের উত্তম উছীলা বা আর কি পেতে পারে?

কেননা, স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহবত ইখতিয়ার করা, মোলাকাত করা আল্লাহ্ পাক এবং আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্,  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবত ইখতিয়ার করা, মোলাকাত করার নামান্তর । (সুবহানাল্লাহ্)

হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে,

من زار عالما فكانما زارنى من زارنى فقد زار الله.

অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি (হক্বানী-রব্বানী) আলিমের মোলাকাত করল সে যেন আমার সাথেই মোলাকাত করল; আর যে ব্যক্তি আমার সাথে মোলাকাত করল সে যেন আল্লাহ্ পাক-এর সাথেই মোলাকাত করলো।” (সুবহানাল্লাহ)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৭)

  ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৮) -হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৯)

হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৬১) বিশুদ্ধ নিয়ত এবং তার ফযীলত ও গুরুত্ব (৫)

হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৬০)