ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৯)

সংখ্যা: ১১১তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গঃ দৃঢ়ভাবে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর তরীক্বার অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য মাশায়িখগণের তরীক্বার প্রতি লক্ষ্য করবে না।  (মাকতুবাত শরীফ) এ প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে, আল্লাহ্ পাক-এর ওলী এক জরুরী কাজে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক ডাকাতকে মৃতাবস্থায় একটি গাছের ডালে ঝুলন্ত দেখতে পেলেন। তিনি এলাকাবাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মৃতব্যক্তিকে ঝুলিয়ে রাখার কারণ কি?’ লোকজন তাঁকে জানালেন, ‘সে ব্যক্তি ছিলো ডাকাত। ডাকাতি কাজে হাতে-নাতে ধরা পড়ায় তার এ অবস্থা।’ একথা শুনা মাত্রই তিনি ডাকাতের পায়ে চুমো দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘হে ব্যক্তি! তোমার জীবন কামিয়াব।’ লোকজন উক্ত বুযূর্গ ব্যক্তির এহেন কাজ দেখে আশ্চর্যান্বিত হলো। তারা সমস্বরে বলতে লাগলো, ‘হুযূর! আপনাকে আমরা আল্লাহ্ পাক-এর ওলী হিসেবে জানি। অথচ আপনি মৃত ডাকাতের পায়ে চুম দিলেন?’ তার জাওয়াবে বুযূর্গ ব্যক্তি বললেন, দেখ! ডাকাতি অত্যন্ত ঘৃণিত পেশা। আর এ ব্যক্তি এ ঘৃণিত পেশায় নিয়োজিত ছিল। মাল-জান সর্বস্ব দিয়ে এবং আমৃত্যু ডাকাতির মত অন্যায় পেশায় ইস্তিকামত ছিলো। মৃত্যুর পরোয়া করেনি হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করেছে তবুও ডাকাতি ছাড়েনি। কিন্তু আমি আল্লাহ্ পাক-এর মা’রিফাত ও মুহব্বতের আকাঙ্খি। আর সে আশা নিয়েই জীবন অতিবাহিত করছি। আমার জান-মাল সবকিছু দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত যদি এ পথে ইস্তিকামত বা অবিচল থাকতে পারি তবেই আমার কামিয়াবী। কিন্তু ইন্তিকাল পর্যন্ত এ পথে ইস্তিকামত থাকতে পারব কিনা জানি না। কিন্তু এই ডাকাত তার পথে আমৃত্যু ইস্তিকামত ছিল দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। বিধায় তার পায়ে চুমা দিলাম।’ ছালেক তথা আল্লাহ্ প্রেমিকগণের এরূপই দৃঢ় প্রত্যয় থাকা এবং সে লক্ষ্যে কোশেশ করা আবশ্যক। কেননা, দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি তথা আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বত, সন্তুষ্টি হচ্ছে সবচেয়ে বড় নিয়ামত। “আল্লাহ্ পাক যাকে ইচ্ছা তাকেই তা দান করেন।”  (সূরা জুমুয়া/৪)  এ নিয়ামত লাভের পথটি অত্যন্ত কক্তকাকীর্ণ ও কষ্টসাধ্য বটে। নানা প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই প্রতি পদে পদে। সুতরাং এ পরম প্রত্যাশিত অকল্পনীয় নিয়ামত হাছিলের জন্য সালিক বা মুরীদকে কতটুকু ইস্তিকামত বা দৃৃঢ় চিত্ত হওয়া প্রয়োজন তা সহজেই অনুমেয়। আর সেক্ষেত্রে কামিল পীর ছাহেবের ছোহ্বত অনস্বীকার্য। কারণ কামিল পীর ছাহেব ক্ষীণ ও দুর্বল মানসিকতাকে আল্লাহ্ প্রদত্ত শক্তি তথা ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ্ দ্বারা দূর করে দিয়ে মুরীদকে ইস্তিকামত বা অবিচল থাকার এবং মা’রিফত ও মুহব্বত লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলেন। কথিত আছে যে, “যে ব্যক্তি কামিল পীর ছাহেবকে পেলেন, সে যেন আল্লাহ্ পাককেই পেলেন।”   সাইয়্যিদুশ্ শুয়ারা, ইমামুর রাসিখীন, শাইখুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

بوے قلاؤزست ورهبر مرترا+

می برد نا خلد وکوثر مرترا.

بوے بد مرجیدہ را تارى کند+

بوے یوسف دیدہ را یاری کند.

অর্থঃ- “ঐ সুবাস (কামিল পীর ছাহেবের ছোহ্বত ও নছীহত) তোমার জন্য দিশারী ও পথ প্রদর্শক হবে। তোমাকে হাউজে কাওছার ও জান্নাতুল খুলদ বা চিরস্থায়ী জান্নাত পর্যন্ত নিয়ে যাবে। (অন্তরের) দুর্গন্ধ চোখকেও অন্ধকারময় করে দেয়। পক্ষান্তরে হযরত ইউছূফ আলাইহিমুস্ সালাম-এর ন্যায় অন্তরের সুগন্ধ চোখের সাহায্যকারী হয়। অর্থাৎ কামিল মুকাম্মিল পীর-মুর্শিদগণের উপদেশসমূহ অন্তর চোখে দৃষ্টি আনয়ণ করে সত্যকে বুঝবার, সত্য পথ দেখার ক্ষমতা যোগায়। তার বিপরীত নামধারী পীর এবং ফাসিক-ফুজ্জারদের কথাবার্তা তাদের লেখা বা রচনাও অন্তর চোখে অন্ধকার সৃষ্টি করে সত্যকে বুঝার, সত্য পথ দেখার শক্তি বিনষ্ট করে দেয়। অন্তরে দুনিয়ার মুহব্বত জন্মায়।” (মসনবী শরীফ)         কাজেই কামিল পীর ছাহেবের ছোহবত অর্জন করা যেমন ফরয তদ্রুপ তার পূর্বে পীর ছাহেবের কামালিয়ত বা আমল-আক্বীদা কিরূপ তাও যাচাই-বাছাই করা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাও ফরয। কেননা, কোন ব্যক্তির হিদায়েতের পথে অবিচল থাকা বা গোমরাহীতে নিমজ্জিত হওয়ার জন্য পীর ছাহেবই যথেষ্ট। কিন্তু বাইয়াত গ্রহণ তথা মুরীদ হওয়ার পর স্বীয় পীর ছাহেবকে যাচাই-বাছাই করা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্পূর্ণ হারাম, নাজায়িয এবং পথভ্রষ্ট হওয়ার কারণ। বরং দ্বিধাহীন চিত্তে একাগ্রতার সাথে অতি গুরুত্ব সহকারে স্বীয় পীর ছাহেবের তরীক্বার অনুসরণ করতে হবে এবং তাতেই ইস্তিকামত বা অবিচল থাকতে হবে। অন্যান্য মাশায়িখগণের তরীক্বার চাক-চিক্য তথা কাশফ-কারামত ইত্যাদির প্রতি নজর দেয়া যাবেনা নতুবা সকল পরিশ্রমই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

এ প্রসঙ্গে ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয্ যামান, আওলার্দু রসূল, ইমাম রাজারবাগ শরীফের মামদুহ্ হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী একটি ওয়াকিয়া উল্লেখ করেন, “এক বুযূর্গ ব্যক্তির একজন মুরীদ ছিলো। যার ইস্তিকামত বা অবিচলতা ছিলোনা। সে বুযূর্গ ব্যক্তির দরবার শরীফে একদা তাঁর পীর ছাহেব ক্বিবলা তাশরীফ আনলেন। এবং তাঁর সামনে অনেক কারামত প্রকাশ করলেন। সে কারামত দেখে উক্ত মুরীদ তাঁর সে দাদা পীর ছাহেবের প্রতি আকৃষ্ট হলো এবং মনে মনে সিন্ধান্ত নিলো যে, তার পীর ছাহেবের ছোহ্বত ত্যাগ করত; দাদা পীর ছাহেবের ছোহ্বত ইখতিয়ার করবে।      যেমন সিদ্ধান্ত তেমনি কাজ। কিছুদিন পর তার পীর ছাহেবের ছোহ্বত ছেড়ে দিয়ে দাদা পীর ছাহেবের ছোহ্বত ইখতিয়ার করতে লাগলো। তবে এ ব্যাপারে তার দাদা পীর ছাহেব তাকে কিছুই বলেননি। এমনিভাবে বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হলো। একদিন সে বুযূর্গ ব্যক্তি তাঁর পীর ছাহেবের সাক্ষাত লাভের উদ্দেশ্যে তার খানকা শরীফে হাযির হলেন এবং খানকা শরীফে বসেই তাঁর পীর ছাহেবের চেয়ে আরো অনেক আশ্চর্য্যন্বিত কারামত প্রকাশ করলেন। তা দেখে উক্ত মুরীদ আবার তার প্রতি আকৃষ্ট হলো এবং দাদা পীর ছাহেবের ছোহ্বত ত্যাগ করে পূর্ব পীর ছাহেবের ছোহ্বতে আসলো। তখন সে পীর ছাহেব তাকে বলে দিলেন যে, আমার ছোহ্বতে তুমি থাকতে পারবেনা। তোমার ইস্তিকামত বা দৃঢ়তা নেই। যা আল্লাহ্ পাক  ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত মুহব্বত হাছিলের প্রধান শর্ত। তুমি শুধু কারামত দর্শনে লিপ্ত। কাজেই আমার ছোহ্বত তোমার কার্যকর হবেনা।”     ইমামে রব্বানী, কাইয়্যূমে জামান, আফযালুল আউলিয়া, মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি সেটাই বলেছেন, “যে ব্যক্তি এক স্থানে সে সব স্থানে আর যে সব স্থানে তার কোন স্থান নেই।” (মাকতুবাত শরীফ)         আরো উল্লেখ্য যে শাইখুল ইসলাম কুতুবুল আকতাব, ইমামুল মুজাহিদীন হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শক্র রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন কোন এক জরুরী কাজে স্বীয় মুরীদ খাদিমকে বাজারে পাঠালেন। কিন্তু খাদিম যথা সময়ে বাবা ছাহেবের নিকট হাযির হলো না। শাইখুল ইসলাম বাবা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি খাদিমের বিলম্বে ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। খাদিম তার জাওয়াবে বললেন, হুযূর! আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ শোকরিয়া যে, আমার সৌভাগ্য নছীব হয়েছে। বাজারে দেখতে পেলাম আপনার খালাত ভাই মাহবুবে ইলাহী হযরত বাহাউদ্দীন যাকারিয়া সোহরাওয়ার্দী মুলতানী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে। তিনি ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করতঃ সারা বাজার প্রদক্ষিণ করছেন। হঠাৎ আমার দৃষ্টি তাঁর উপর পতিত হলো। আমি তাঁর নিকটবর্তী হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম। হে আল্লাহ্ পাক-এর ওলী! “আমরা জানি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুনিয়ার যমিনে সর্বনিকৃষ্ট স্থান হচ্ছে বাজার।” অথচ আপনি আল্লাহ্ পাক-এর ওলী এ নিকৃষ্টতম স্থানে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে অযথা ঘুরা-ফেরা করছেন। তার কারণ কি?” তখন তিনি বললেন, “আল্লাহ্ পাক আমার প্রতি ইলহাম করেছেন যে, “অদ্য যারা তোমার সাথে মোলাকাত করবে বা তোমাকে দেখবে তাদের সকলকেই আমি ক্ষমা করব সুতরাং আমার ইচ্ছা কোন লোকই যেন এ নিয়ামত হতে মাহরুম বা বঞ্চিত না হয়। মূলতঃ আমি সেজন্য  সারা বাজার, শহর-বন্দর, প্রদক্ষিণ করছি।” হুযূর আপনার খালাত ভাই মাহবুবে ইলাহী হযরত বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এমন মর্যাদা-মর্তবা দেখে অভিভূত হলাম। সে নিয়ামত লাভের জন্য আমিও কিছু সময় তার ছোহবতে কাটিয়ে আসলাম।      একথা শুনে শাইখুল ইসলাম, কুতুবুল আকতাব বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শক্র রহমতুল্লাহি আলাইহি স্নিগ্ধ হাসি দিলেন। বাবা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি -এর মুখে হাসি দেখে খাদিম আশ্চর্যান্বিত হলো এবং বিনয়াবত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “হুযূর আপনার  নিকট একটি সুসংবাদ শোনালাম আর আপনি হাসলেন তার হিকমত কি?” তখন শাইখুল ইসলাম, কুতুবুল আকতাব বাবা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “আমার ভাই বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে আল্লাহ্ পাক একবার ইলহাম করেছেন তা শুনেই তুমি আশ্চর্য হয়েছ। আমার জরুরী কাজ ফেলে রেখে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলে। আর আমাকে আল্লাহ্ পাক শত-সহস্রবার ইলহাম ইল্কা করেছেন এই বলে যে, আপনাকে ক্ষমা করলাম এবং আপনার মধ্যস্থতায় কিংবা বিনা মধ্যস্থতায় কিয়ামত পর্যন্ত যারা আপনাকে উছীলা বানাবে তাদেরকেও ক্ষমা করলাম।” (সুবহানাল্লাহ)

স্মর্তব্য যে, যারা স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার তরীক্বার উপর ইস্তিকামত বা অবিচল থাকতে পারেনা, স্বীয় পীর ছাহেবের পরিপূর্ণ অনুসরণ করেনা এবং স্বীয় পীর ছাহেবের বাধ্যানুগত নয় তারা পীর ছাহেব ক্বিবলার নেক দৃষ্টি ও পূর্ণ ফয়েয-তাওয়াজ্জুহ্ হতে মাহরুম বা বঞ্চিত হয়। আর মুরীদ যখন স্বীয় পীর ছাহেব হতে বঞ্চিত হয় তখন পৃথিবীর সব স্থান হতে সে বিতাড়িত হয়।

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬০)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬২)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৩)

পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৪)