-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
৪০। দৃঢ়ভাবে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর তরীক্বার অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য মাশায়িখগণের তরীক্বার প্রতি লক্ষ্য করবে না। (মাকতুবাত শরীফ) মুর্শিদে বরহক্ব, সুলতানুল মুহাক্কিকীন, মুফতিউল আ’যম, ইমামুল মুজাহিদীন, আমিরুশ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত, শাহ ছূফী, শায়খ, হযরত মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “তাছাউফের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে দৃঢ়তার সাথে আপন পীর ছাহেব-এর অনুসরণ-অনুকরণ করা।” (কিতাবে ইসতিকামত) কেননা, কোন কাজে পরিপূর্ণ কামিয়াবী বা সফলতা লাভ করা কিংবা কোন বিষয়ের হাক্বীক্বতে পৌঁছার জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে ইস্তিকামত বা দৃঢ় থাকা। ইস্তিকামত বা অবিচল থাকা ব্যতীত সকল কাজই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা, সুলতানুল আউলিয়া, শাইখুল মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন, ইমামুল মুহাক্কিকীন, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “লক্ষ লক্ষ মুরীদ একত্রে মারিফাতের সাগরে অবগাহন করলাম; কিন্তু আমি ছাড়া সকলে নিখোঁজ হয়েছে। অর্থাৎ কেউ পরিপূর্ণ কামিয়াবী লাভ করতে পারেনি” আর এটা যে ইস্তিকামতের অভাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। উল্লেখ্য যে, দুনিয়ার যত গোমরাহী ও পাপাচার দেখা যায় তা সবই ইস্তিকামত হতে দূরে যাওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়। আর এ কাজটি অত্যন্ত কষ্টকর। আল্লাহ পাক উনার রহমত ব্যতীত কারো পক্ষেই ইস্তিকামত থাকা সম্ভব নয়। ইমামুল আইম্মা, মুহইস সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয যামান, সুলতানুল আরিফীন, ওয়াহিদুদ দাহর, আওলাদে রসূল ইমাম রাজারবাগ শরীফের মামদুহ হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেন, “ইস্তিকামত বা দৃঢ় চিত্ত থাকা নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের বিশেষ মু’যিজা। অনুরূপ আউলিয়া-ই-কিরামগণের সবচেয়ে বড় কারামত হচ্ছে ইস্তিকামত বা অবিচল থাকা।
জলিলুল ক্বদর রসূল হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামসহ পূর্ববর্তী অনেক নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের অনেক উম্মত ধ্বংস হয়েছে। যারা ইস্তিকামত বা অবিচল থাকতে পারেনি। মূলতঃ ইস্তিকামত থাকা মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ নিয়ামত।
মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
ان الذين قالوا ربنا الله ثم استقاموا فلاخوف عليهم ولاهم يحزنون.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই যারা বলে ‘আল্লাহ পাক আমাদের রব’ এবং এতে ইস্তিকামত বা অবিচল থাকে তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা কোন প্রকার চিন্তিত হবেনা।” (সূরা আহক্বাফ/১৩)
আল্লাহ পাক অন্যত্র ইরশাদ করেন,
ان الذين قالوا ربنا الله ثم استقاموا تتنزل عليهم الملئكة الاتخافوا ولاتحزنوا وايشروا بالجنة التى كنتم توعدون نحن اويائكم فى الحيوة الدنيا وفى الاخرة ولكم فيها ماتشتهى انفسكم ولكم فيها ماتدعون نزلا من غفور رحيم.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক কেবল আল্লাহ পাক অতঃপর তারা এটার উপর ইস্তিকামত বা অটল রয়েছে উনাদের প্রতি (সু-সংবাদ নিয়ে) ফেরেশতাগণ নাযিল হন (এবং বলেন যে) তোমরা কোন প্রকার ভয় করোনা এবং চিন্তিত হয়োনা। আর তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ শোন যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। আমরা তোমাদের পার্থিব জীবনে সাথী ছিলাম এবং পরকালেও থাকব। যা কিছু তোমাদের বাসনা হবে তথায় তা বিদ্যমান আছে এবং যা কিছু তোমরা চাবে তাও তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে। এটা পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে মেহমানদারী।” (সূরা হা-মীম-সিজদা/ ৩০-৩২) ইস্তিকামত বা অবিচল থাকার বিষয়টি এতো গুরুত্বপূর্ণ যে, এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবু আলী ছুররী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
رايت النبى صلى الله عليه وسلم فقلت يا رسول الله صلى اله عليه وسلم روى عنك انك قلت شيبتنى هود قال نعم فقلت ماالذى شيبك منه قصص الانبياء وهلاك الامم قال لا ولكن قوله تعالى فاستقم كما امرت.
অর্থঃ- “একদা আমি স্বপ্নে আখিরী নবী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে জিজ্ঞেসা করলাম- ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি নাকি বলেছেন যে, ‘সূরা হুদ’ আপনাকে বৃদ্ধ করেছে?’ তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, ‘সেখানে বর্ণিত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম এবং পূর্ববর্তী জাতির ধ্বংসের ঘটনাসমূহ কি আপনাকে বৃদ্ধ করেছে?’ তিনি বললেন, ‘না; বরং সেখানে বর্ণিত ‘আল্লাহ পাক উনার আদেশ-
فاستقم كما امرت ةمن تاب معك ولا تطغوا انه بما تعملون بصير.
“আপনি ইস্তিকামত বা অবিচল থাকুন যেভাবে আদিষ্ট হয়েছেন এবং তারাও যারা তওবা করে (ঈমান এনে) আপনার সাথী হয়েছেন। আর (আল্লাহ পাক উনার নির্ধারিত) সীমা অতিক্রম করবেন না। নিশ্চয়ই তিনি আপনাদের কার্যকলাপ সম্যকভাবে প্রত্যক্ষ করেন।” (বায়হাক্বী শরীফ, তাফসীরে দুররে মানছুর-৩/৩২০) মুফাসসিরীন-ই-কিরামগণ বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের ইস্তিকামতের জন্যে চিন্তিত ছিলেননা। কেননা, উনার স্বভাবই ছিলো ইস্তিকামত বা দৃঢ় চিত্ত থাকা। যা আল্লাহ পাক উনার রহমতে পরিপূর্ণরূপে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাঝে বিরাজমান ছিলো। কিন্তু উক্ত আয়াত শরীফে সমস্ত উম্মতকে সঠিক ও সরল পথে ইস্তিকামত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে অথচ উম্মতের জন্য তা অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টকর। তাই তিনি অতীব চিন্তিত ও শঙ্কিত ছিলেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, একদা আমিরুল মু’মিনীন, খলিফাতুল মুসলিমীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাওরাতের একটি কপি নিয়ে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট হাজির হলেন এবং বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা তাওরাতের কপি। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতিউত্তরে কিছু বললেন না। অতঃপর আমিরুল মু’মিনীন, ফারুকে আ’যম হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তা পড়তে লাগলেন। আর এদিকে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেহারা মুবারক লাল হতে লাগলো। এটা দেখে সিদ্দীকে আকবর, আফজালুন নাছ বা’দাল আম্বিয়া হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, (হে উমর!) তোমার সর্বনাশ, তুমি কি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেহারা মুবারকের প্রতি লক্ষ্য করনি।” তখন আমিরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেহারা মুবারকের দিকে তাকালেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতঃ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসন্তুষ্টি হতে পানাহ চাই। আমরা আল্লাহ পাককে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, নবীয়ে রহমত, হযরত মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসেবে পেয়ে খুশি হয়েছি। তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহ পাক উনার কসম! যার কুদরতী হাতে আমার জীবন, এ সময় যদি মুসা আলাইহিস সালাম আগমন করতেন আর তোমরা আমাকে ছেড়ে উনার অনুসরণ করতে তাহলে তোমরা নিশ্চয়ই সরল পথ হতে বিচ্যুত হয়ে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হতে। এমনকি তিনি যদি এখন জীবিত থাকতেন; আর আমার নুবুওওয়াতের যামানা পেতেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনিও আমার অনুসরণ করতেন। (সুবহানাল্লাহ) (দারিমী, মিশকাত শরীফ)
অতএব, স্মর্তব্য যে, ছুলুকের পথে ছালিক বা মুরীদের উচিৎ স্বীয় পীর ছাহেব ব্যতীত অন্য কারো প্রতি দৃষ্টি না দেয়া। এবং আরো স্মর্তব্য যে, ছুলূকের পথে ছালিক বা মুরীদকে যত ধাপ বা স্তর অতিক্রম করতে হয় তন্মধ্যে ইস্তিকামত বা অটল-অবিচল থাকার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টসাধ্য বটে। কাজেই সকল মুরীদকে তৎপ্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা ও সজাগ থাকা বাঞ্ছনীয়। পূর্ববর্তী সকল মাশায়িখগণ বিশেষভাবে এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন।
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬০)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬২)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৩)