সূর্যকে জ্যোতির্ময় এবং চাঁদকে স্নিগ্ধময় করে যিনি তৈরী করেছেন, দিয়েছেন সুনির্দিষ্ট কক্ষপথ, যাতে মানুষ গণণা করতে পারে বছর ও সময়, সে মহান সত্ত্বা আল্লাহ্ পাক-এর জন্যেই সকল প্রশংসা। চাঁদের মাসের পরিস্ফুটন এবং হিজরী সনের প্রবর্তনকারী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্যই সকল ছলাত-সালামের ভান্ডার।
সৃষ্টির শুরু থেকেই গণনায় মাসের সংখ্যা বারটি বলে রব তায়ালা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এবং এক্ষেত্রে মুহররমুল হারাম হিজরী সালের প্রথম মাস বা পয়লা মুহররম নতুন হিজরী সালের প্রথম দিন। তাই মুহররমের আগমন মুসলমানদের জন্য যেমন বিগত এক বৎসরের জিন্দেগীর মূল্যায়নের অবকাশ রাখে, তেমনি প্রেরণা দেয় পরিশুদ্ধ চেতনায় নতুন সালে পদার্পণ করার দীপ্ত অভিপ্রায়ের ও নব চেতনার। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বটেই সমাজ জীবনেও মুসলমানদের ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোতে বা মসজিদ সমূহে দিনটি উদ্যাপনের উদ্যোগে কাঙ্খিত উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়না। এজন্যে অবশ্য নামধারী মাওলানাদের গাফলতি এবং অজ্ঞতাই বিশেষভাবে দায়ী।
বলাবাহুল্য, নামধারী মাওলানাদের কুপমন্ডুকতা, অদূরদর্শিতা, প্রজ্ঞাহীনতা, ইল্ম শুন্যতা তথা হুজুগে মাতাল মনোবৃত্তিই আজকের বিশ্বে মুসলমানদের এরূপ কোনঠাসা হওয়ার কারণ।
উল্লেখ্য, ইরাকের উপর আমেরিকার আক্রমণের বিরুদ্ধে শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয় অমুসলিম বিশ্বেও প্রতিবাদের উত্তাল ঝড় উঠেছে। খোদ লন্ডনে বিশ লক্ষাধিক লোকের সাড়ে ৫ কি. মি লম্বা লাইনের, নিউইর্য়কে এক লাখ লোকের, মেলবোর্নে দেড় লাখ, ইতালীতে এক লাখ, অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে আড়াই লাখ লোকের প্রতিবাদী মিছিলসহ বিশ্বের প্রায় ছয় শতাধিক শহরে লাখ লাখ লোক আমেরিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে।
পাশাপাশি বাংলাদেশকে আমেরিকার সন্দেহভাজন কালো তালিকাভুক্তিতে এ দেশবাসীর সবাই গভীর ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছে।
বলাবাহুল্য দু’ ক্ষেত্রেই মুসলমান ও ইসলামের বিষয়টি সম্পৃক্ত। ইরাকের ক্ষেত্রে অভিযোগ যে সে মারাত্মক জীবানু অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। যদিও পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন পৃথিবীর চতুর্থ তেল উৎপাদনকারী দেশ ইরাকের তেল ভান্ডার লুট করা এবং নিজ মোড়লগিরী আরো শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করাই ইরাক আগ্রাসনের উদ্দেশ্য। এর সাথে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অভিযোগ যে বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের লালনভূমি ইত্যাদি ইত্যাদি। এক্ষেত্রেও আমেরিকার অনুরূপ সুপ্ত উদ্দেশ্য বিরাজমান।
উল্লেখ্য, উভয়ক্ষেত্রেই তথাকথিত মুসলিম দরদীরা বিবিধ দুনিয়াবী তথ্য দিয়ে জবাব দিতে চেয়েছেন, প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। নামধারী আলিমদের কক্তেও তেমন কোন ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়নি। তারা উল্লেখ করেছেন, জাতিসংঘের প্রধান অস্ত্র পরিদর্শক হ্যান্স ব্লিক্স নিরাপত্তা পরিষদে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছেন, তার টীম ইরাকে বিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পায়নি। সাথে সাথে আন্তর্জাতিক আনবিক সংস্থার প্রধান মুহম্মদ আল-রারাদেইও অনুরূপ রিপোর্ট পেশ করেছেন।
তারা উল্লেখ করতে উৎসাহ পান যে, ইসরাঈলের কাছে চার’শ পারমাণবিক বোমা রয়েছে তারপরেও আমেরিকা প্রতি বৎসর প্রকাশ্যেই ইসরাইলকে ৫’শ কোটি ডলার সাহায্য দিয়ে আসছে। কিন্তু তারা এ বিষয়টিতে বিব্রত করা থেকে বিরত থাকেন যে, মুসলিম দেশসমূহের মাঝেই তুরস্ক, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, সৌদিআরব আমেরিকার অনুকূলে রয়েছে।
তারা এ তথ্য অবগত নন যে, ১৯৯০ সালে চৌদ্দ’শ কোটি ডলার ঋণ মওকুফের বিনিময়ে মিশরের হোসনি মুবারক; সিরিয়াতে ফুঁেস উঠা বিরোধী দলকে দাবিয়ে রাখার চুক্তিতে এবং কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র সাহায্য প্রাপ্তিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ; ইরানকে বিশ্বব্যাংক থেকে ২৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পাইয়ে দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন তথা ঘুষ দেয়ার চুক্তিতে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ সমর্থন করানো হয়। আর কেবলমাত্র ইয়েমেন তাতে রাজী না হওয়ায় মাত্র তিনদিনের মধ্যে ৭ কোটি মার্কিন ডলারের সাহায্য কর্মসূচী বন্ধ করে দেয়া হয়। মূলতঃ আমেরিকার প্রচারণার বিপরীতে একটি মূখ্য কথা এ যাবৎ পর্যন্ত যামানার তাজদীদী মুখপত্র আল বাইয়্যিনাত ব্যতীত আর কোথাও উচ্চারিত হয়নি। তা হল টুইন-টাওয়ারে যে হামলা হয়েছে, এরূপ নির্বিচারে হামলা ইসলাম কখনো সমর্থন করেনা এবং সত্যিকার কোন মুসলমান নেতা এরূপে হামলা করতে পারেনা। এ হামলা মূলতঃ ইহুদীরা করেই সুকৌশলে মুসলমানের উপর চাপিয়ে দিয়ে এখন দুনিয়ার সবখানে মুসলমানদের হেনস্তা করার সুযোগ তৈরী করে নিয়েছে।
কাজেই এমতাবস্থায় ইসলাম দরদী সব মহল থেকে এ কথাই বেশী উচ্চারণ করার দরকার ছিল যে, ইসলাম কাফিরদের উপরেও নির্বিচারে হত্যা সমর্থন করেনা। আল্লাহ্ পাক ইরশাদ ফরমান, “আমি বণী ইস্রাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টিকারী ছাড়া কাউকে হত্যা করে এরকম লোক সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে।” (সূরা মায়েদা/৩২) এমনকি হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধে নারী-শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।” (বুখারী, মুসলিম)
উল্লেখ্য, এ হাদীস শরীফের প্রেক্ষিতে পারমানবিক বোমা, জীবানু অস্ত্র ইত্যাদি নাজায়িয হয়ে যায়। মূলতঃ ইসলামের আদর্শে কখনও নির্বিচারে হত্যা, আক্রমণের কথা নেই। তায়েফের ঘটনা আমরা সবাই অবগত। হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহ্ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আঘাতকারীদের দু’পাহাড় একত্র করে পিষ্ট করার অনুমতি চাইলেন তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরম দরদের সাথে বলেছিলেন, এদেরকে যদি এভাবে মেরে ফেল তবে কাদের প্রতি আমি ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাব? এরা না হোক, এদের বংশধররাও তো ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। অতএব ইসলামের এ আদর্শ যদি আজ উচ্চকিতভাবে তুলে ধরা হত এবং টুইনটাওয়ারে হামলা, জীবানু অস্ত্র ব্যবহার ইসলাম সমর্থিত নয় এ মূল্যবোধে যে মুসলমানরা বিশ্বাসী। তার ব্যাপক স্বীকৃতি থাকত, তাহলে আমেরিকার, মুসলমানদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়ার তথা ইরাকে হামলার মওকা মিলতনা।
মূলতঃ এক্ষেত্রে আলিম নামধারীদের ব্যর্থতাই দায়ী।
তারা লংমার্চ, হরতাল, মৌলবাদ, ব্লাসফেমী, গণতন্ত্র, নির্বাচন ইত্যাদি বিজাতীয় আদর্শের যতটা বুলি কপচায়,, নিজস্ব ইসলামী মূল্যবোধ সম্পর্কে তার চেয়ে ঢের নিস্ক্রিয় ও অজ্ঞ থাকে। কাজেই এদের কারণে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হওয়া থেকে উদ্ধার পেতে হলে জামানার মুযাদ্দিদের নেক ছোহবত ব্যতীত বিকল্প নেই। কারণ খোদায়ী মদদগার ও ইল্মে লাদুন্নী সমৃদ্ধ হবার বদৌলতে তিনিই উম্মাহকে সঠিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।