সব প্রশংসা আল্লাহ্ পাক-এরই। যাঁর কাছে যমীনে ও আসমানে কোন কিছুই গোপন নয়। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অফুরন্ত দরূদ ও সালাম। উম্মতের মাঝে যিনি আবির্ভূত হয়েছেন সাক্ষী, সু-সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে।
সৃষ্টির শুরু হতে আল্লাহ্ পাক গণনা হিসেবে বারো মাসকে নির্ধারণ করেছেন। তন্মধ্যে শাওয়াল মাসের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। বণী ইসমাঈলীদের তথা মুসলমানদের নিয়ামত প্রাপ্তির প্রথম পূর্ণ মাসটি ছিলো শাওয়াল মাস। এ মাসের প্রথম দিনেই মুসলমানদের প্রধান ঈদ তথা ঈদুল ফিত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং ঈদুল ফিতরের এ ঈদ একটি দিনে নির্দিষ্ট থাকলেও মূলতঃ এর পটভূমিকা ও প্রাসঙ্গিকতা; মূল্যবোধ ও মূল্যায়ণ এবং দায়িত্ব ও চেতনা সার্বিক ও সব সময়ের। অথচ এ বিষয়ের মূল্যায়ণ এখন এতটা গণ্ডিভুক্ত হয়েছে যে, ঈদুল ফিতরের পর আর কেউ ঈদ চেতনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার তথা লেখালেখির অবকাশ পাননা। বিষয়টি মূলতঃ সত্যিকার ঈদ চেতনার দ্বার অবরুদ্ধ করে রাখার শামিল। বর্ণিত রয়েছে, এক ঈদের দিনে সবাই যখন খুশীতে মাতোয়ারা ছিলেন তখন আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে ডুকরে ডুকরে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলেন। বিনীতভাবে তার কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “আমি তো জানিনা রোযার রিয়াজত-মুশাক্কাত দ্বারা, তাক্বওয়া হাছিলের দ্বারা, আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে কবুল হওয়ার আনন্দে যে সত্যিকার ঈদ, তদ্বপ্রেক্ষিতে আমার রোযা কবুল হয়েছে কি-না, তাক্বওয়া হাছিল হয়েছে কিনা, আমি মকবুল হয়েছি কিনা?”
মূলতঃ আমীরুল মু’মিনীন, হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর এ চেতনাদগ্ধ প্রশ্নের শান দ্বারা বিজাতীয় বেশরা-বিদ্য়াতী উৎসব আনন্দে উচ্ছসিত আমাদের মৃতপ্রায় অন্তরকে শাণিত করতে হবে, জাগরিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঈদ সম্পূর্ণই ধর্মীয় উৎসব। ধর্মের বিধান ছূরতান ও হাক্বীক্বতান পালনই এ উৎসবের উপকরণ।
কিন্তু আমাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে আমরা রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রবর্তিত ঈদকে বাদ দিয়ে আইয়্যামে জাহিলিয়াতের শরৎ ও বসন্ত জোছনায় উদযাপিত নওরোজ ও মিহিরজান উৎসবই পালন করছি। প্রসঙ্গতঃ একটি জাতীয় দৈনিকে লিড নিউজ হয়, “ঈদ আনন্দ ….. তিনটি টিভি চ্যানেলে একত্রিশটি নাটক, নয়টি টেলিফিল্ম, উনিশটি ছায়াছবি।” এতে বলা হয়, “পবিত্র ঈদ উপলক্ষে বি.টি.ভিসহ তিনটি টিভি চ্যানেলে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।” এছাড়া আরো উল্লেখ করা হয়, “পবিত্র ঈদ উপলক্ষে মোট ছয়টি ছায়াছবি মুক্তি পেয়েছে।”
উল্লেখ্য, ‘মুসলমান দাবী করবেন- কিন্তু কুরআন শরীফ মানবেন না’ এটা যেমন হতে পারে না তেমনি ‘কুরআন শরীফ স্বীকার করবেন কিন্তু কুরআন শরীফে ব্যক্ত বেপর্দাজনিত চোখের যিনা তথা হারাম ছবি নির্ভর হাজারো কবীরাহ গুণাহ্র সমাহারে তৈরী সিনেমা-টিভির সব প্রোগ্রাম, যা দিলকে অপবিত্র করে তার দ্বারা যে পবিত্র ঈদের পবিত্রতা ভূলুক্তিত হয় তা মানবেন না তা কখনো হয় না।”
জানা গেছে, এবারের ঈদে বারো হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণে জানা যায় এ কেনাকাটা হয়েছে বল্গাহারা আঙ্গিকে। উল্লেখ্য, ইসলামী চেতনার বিপরীতে বিজাতীয় আবেদন নিয়ে পোশাক তৈরী ও কেনার মনোবৃত্তি দিন দিন বেড়েই চলছে। একটি দৈনিকে মন্তব্য করা হয়েছে, … তবে শপিং সেন্টার গুলোতে এবার দেবদাস ক্রেজ হয়েছে মূলত আকর্ষণ। জামা-কাপড়, শাড়ি, জুতা, গহনা সবকিছুতেই রয়েছে এবার দেবদাস শব্দটি। ” উল্লেখ্য, এ ধরণের ক্রেজ তৈরী করে মুসলমানদের ইসলামী ভাবধারা বিনষ্টকরণের পাশাপাশি হিন্দুয়ানী, খ্রীষ্টানী কালচারে ভাসিয়ে দেয়া মূলতঃ বিধর্মীদের একটি সূক্ষ্ম ও শক্ত ষড়যন্ত্র এবং মারাত্মক সাংস্কৃতিক ছোবল। যার মূলকথা হচ্ছে উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা।
উল্লেখ্য, বিগত দিনের প্রতিদ্বন্দ্বি পুঁিজবাদী আমেরিকা ও সমাজতন্ত্রী রাশিয়ার ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, পুঁজিবাদী আমেরিকার তরফ থেকে সমাজতন্ত্রী রাশিয়ার জনগণের প্রতি নববর্ষের শুভেচ্ছা ইথার মারফত প্রেরণ করা হলে, অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক কৌশল দ্বারা সে শুভেচ্ছা প্রেরণের মোকাবিলা করা হয়।
সুতরাং আজকে যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং ভারতের বাজপেয়ীর পাশাপাশি দেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ, খ্রীষ্টান অ্যাসোসিয়েশন, শ্রীকৃষ্ণ সেবা সংঘ, খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্র, শ্রী শ্রী রামানা কালী মন্দির ও বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টসহ বিভিন্ন বিধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এদেশের মুসলমানদের ঈদ শুভেচ্ছা জানান তখন ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রেক্ষিতেই মুসলমানদের ভেবে দেখা উচিত যে, বিধর্মীদের এ ঈদ শুভেচ্ছাতে তাদের কতখানি উৎসাহিত হওয়া উচিত অথবা তা প্রত্যাখান করা দরকার।
উল্লেখ্য, ইহুদীদের উৎসব হান্নুক্কাহ্ উপলক্ষে হোয়াইট হাউজ আলোকসজ্জ্বিত করার একদিন পর এবং জাতীয় ক্রীস্টমাস ট্রি সজ্জিত করার কয়েক ঘন্টা আগে বুশ যখন বলে, ‘আমাদের পরিবার ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পক্ষে আমি উপস্থিত, সকল মুছল্লী ও সারাবিশ্বের মুসলমানদের ঈদ শুভেচ্ছা জানাচ্ছি’ কিন্তু সেই বুশ যখন আফগানিস্তান, ইরাকসহ সারাবিশ্বের মুসলমানদের প্রতি খড়গ হস্তে লিপ্ত থাকে তখন তার এ শুভেচ্ছা কতটুকু আন্তরিক ও গ্রহণযোগ্য তা উল্লেখ করার অবকাশ রাখেনা।
কিন্তু তারপরেও এহেন শুভেচ্ছাবাণীর প্রতি কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া কথিত বা তথাকথিত আলিম সমাজের মাঝে লক্ষ্য করা যায়নি।
মূলতঃ এ নির্লিপ্ততাই প্রমাণ করে যে মুসলমানদের ঈমানী জজবা তৈরীর ক্ষেত্রে তারা কতটা মৃতবৎ পুতুল সমতুল্য।
বরং বিজাতীয়, বিধর্মীয় আদর্শ ও কর্মসূচী অনুসরণে তারা আজ পথভ্রষ্ট ও উলামায়ে “ছূ”র অন্তর্ভুক্ত।
বেপর্দা হওয়া, ছবি তোলা, লংমার্চ করা, হরতাল করা, ব্লাসফেমী আইন চাওয়া, ইসলামের নামে গণতন্ত্র তথা নির্বাচন করা ইত্যাদি বিদ্য়াত ও বিজাতীয় কমসূচীর জালে আবদ্ধ হয়ে তারা আজ নিজেদের ঈমানী চেতনা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে।
কাজেই এরা খিলাফতের কথা বললেও এদের দ্বারা কখনও খিলাফত বা ঈদের হাক্বীক্বী স্বাদ আস্বাদন সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, যমীনে খিলাফত কায়িম হলে যমীন তথা দুনিয়াই হবে বেহেশ্ত। তখন প্রতিদিনই হাছিল হবে হাক্বীক্বী ঈদ। বলাবাহুল্য, যামানার মুজাদ্দিদ-এর রূহানী পরশ বিস্তারেই সে প্রাপ্তি সম্ভব। মহান আল্লাহ্ পাক আমাদের তা নছীব করুন। (আমীন)