ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার
পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক
প্রসঙ্গে (৬১)
প্রসঙ্গঃ দৃঢ়ভাবে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর তরীক্বার অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য মাশায়িখগণের তরীক্বার প্রতি লক্ষ্য করবে না। (মাকতুবাত শরীফ)
একদা রাজ দরবারের জনৈক আমীর ইখতিয়ারুদ্দীন আইবেক কুতুবুল আকতাব, ইমামুল মুহাক্কিক্বীন, সাইয়্যিদুল মুজাহিদীন হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার ক্বাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে কয়েকটি গ্রাম তাঁর জন্য ওয়াক্ফ করার ইচ্ছা করলো। কিন্তু তিনি তাকে এরূপ করতে নিষেধ করলেন। এতদ্ব্যতীত আলতামাশ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রধান উজিরও একদা এরূপ ইচ্ছা পোষণ করলেন। তখন কুতুবুল আকতাব রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, আমাদের চিশ্তিয়া তরীক্বার আউলিয়া-ই-কিরামগণের মধ্যে কেউই কোন সময় বাদশাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত জায়গীর কবুল করেননি। যদি তাঁদের মধ্যে কেউ এরূপ করতেন তবে আমিও গ্রহণ করতাম। যদি আমি তাঁদের তরীক্বার খিলাফ করে আপনার এ জায়গীর গ্রহণ করি তবে ক্বিয়ামতের দিন আমি চিশ্তিয়া তরীক্বার আউলিয়া-ই-কিরামগণের নিকট কিরূপে মুখ দেখাবো? (তাযকিরাতুল আউলিয়া) প্রত্যেক আউলিয়া-ই-কিরাম নিজ নিজ তরীক্বার হিফাযত বা সংরক্ষণের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখতেন। এবং পরবর্তীতে খলীফা মনোনীত করার প্রাক্কালে তা যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য বিশেষভাবে তাকিদ প্রদান করতেন। ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত, সুলতানুল হিন্দ, কুতুবুল মাশায়িখ, আমিরুল মু’মিনীন ফি ইলমিল ফিক্বহে ওয়াত্ তাছাউফ, খাজায়ে খাজে গাঁ, গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ্, আওলাদে রসূল হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি একদা কুতুবুল আকতাব, সাইয়্যিদুল মুজাহিদীন, বুরহানুল আশিকীন হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে নিকটে ডাকলেন। তিনি নিকটবর্তী হলে দরবার শরীফের সমস্ত লোকের সামনে তাঁর মাথা মুবারকে টুপি ও পাগড়ী পরিয়ে দিলেন এবং তাঁর পীর ছাহেব ক্বিবলা সুলতানুল আরিফীন হযরত খাজা উছমান হারুনী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দেয়া লাঠি মুবারক তাঁর হাতে তুলে দিলেন ও খেরকা পরিয়ে দিলেন। কুরআন শরীফ, জায়নামায এবং খড়ম জোড়া দান করে বললেন, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমানত। এটা চিশ্তিয়া সিলসিলার খাজেগানের মাধ্যমে আমার নিকট পেঁৗঁছেছে। তুমি এটাকে জারী রাখবে। যাতে কাল ক্বিয়ামতের ময়দনে চিশ্তিয়া সিলসিলার খাজেগানের সম্মুখে আমাকে লজ্জিত হতে না হয়।” তিনি মাথা নত করে আনুগত্য প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ অব্যক্ত ভাষায় জানালেন যে, “পীর ছাহেব ক্বিবলার আদেশ যথাযথভাবে পালন করবো (ইনশাআল্লাহ্)।” (তাযকিরাতুল আউলিয়া) নকশ্বন্দিয়া-ই-মুজাদ্দিদিয়া তরীক্বার বিশিষ্ট বুযূর্গ, আরিফে রব্বানী, কুতুবুল মাশায়িখ, খাজায়ে জাহাঁ হযরত খাজা আব্দুল খালেক গুজদাওয়ানী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পুত্রকে মর্মস্পর্শি নছীহত করতঃ বললেন, নিজের পূর্ব পুরুষ বুযূর্গানে দ্বীনের তরীক্বার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। “হুশ দরদম” অর্থাৎ প্রত্যেক শ্বাস-প্রশ্বাসে যিকিরের খেয়াল রাখা “নজর বর কদম” অর্থাৎ পথ চলার সময় স্বীয় পায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা। “সফর দর ওতন” অর্থাৎ নফসের খারাপ খাছলত হতে মনকে পবিত্র করতঃ ফেরেশ্তার পবিত্র খাছলত অর্জন করা। “খেলওয়াত দর আঞ্জুমান” অর্থাৎ সর্বদা ক্বালবকে আল্লাহ্ পাক-এর সাথে মশগুল রাখা। জন সমাগম, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও দুনিয়ার নানাবিধ কাজে লিপ্ত থেকেও আল্লাহ্ পাক-এর স্মরণ হতে বিরত না থাকা। “ইয়াদ করদ্” অর্থাৎ সর্বদাই আল্লাহ্ পাক-এর স্মরণ করা। “বাজগাশ্ত” অর্থাৎ কিছুক্ষণ যিকির করার পর আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে দোয়া করা। “নেগাহ্ দাশ্ত” অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক ব্যতীত অন্য চিন্তা মনে যাতে স্থান না পায় তার দিকে লক্ষ্য রাখা। “ইয়াদ দাশ্ত” অর্থাৎ দিলের রোখকে সর্বদা একমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর দিকে রাখা। বিগত জীবনের কৃত-কর্মের হিসেব নেয়া, মানুষের সাথে যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করা এবং দুশমন সম্পর্কে অবহিত থাকা। এ হচ্ছে তোমার পূর্বপুরুষ বুযূর্গানে দ্বীনের তরীক্বা, একান্তভাবে তার অনুসরণ করে চলবে। (তাযকিরাতুল আউলিয়া) অনুরূপভাবে পঞ্চদশ হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ, যিনি আল্লাহ্ পাক-এর খাছ লক্ষ্যস্থল, ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, কুতুবুল আলম, আওলাদে রসূল, হাবীবুল্লাহ্, সাইয়্যিদুনা, ইমাম রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী স্বীয় তরীক্বার প্রতি কত যতœবান ও কঠোর দৃষ্টি সম্পন্ন তা নিম্নলিখিত ঘটনার মাধ্যমে বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বিগত ১৪২২ হিজরী সনের রমাদ্বান মাসটি যখন খোশ-খবরী নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হলো। আমরা তার সওগাত লাভে যথাযথ হক্ব আদায় করার জন্য প্রচেষ্ট হলাম। রমাদ্বান মাসকে আল্লাহ্ পাক মু’মিনগণকে হাদীয়া স্বরূপ দিয়েছেন। যে মাসে তাক্বওয়া হাছিল হয়। আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বতের ভিত্তি মজবুত ও সুদৃঢ় হয়। বিশেষতঃ রমাদ্বানেই ইফতারীর মুহুর্তে বান্দার দোয়া কবুল হয়। সে পরম প্রত্যাশিত নিয়ামত লাভের জন্য ইফতারী করার প্রাক্কালে সম্মিলিতভাবে সকলে হাত তুলে দোয়া করা শুরু করলাম। এমনিভাবে দু’তিন দিন অতিবাহিত হলো।
একদা মাগরীব নামায অন্তে আমাদের মাথার তাজ ্ইমামুল আইম্মা, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয্ যামান, সুলতানুল আরিফীন, হাবীবে আ’লা, গাউসুল আ’যম, গরীবে নেওয়াজ, আওলাদে রসূল আমাদের প্রাণ প্রিয় মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী খানকা শরীফে আসার জন্য খবর পাঠালেন। খবর পেয়ে অতি তাড়াতাড়ি ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে খানকা শরীফে প্রবেশ করে কদমবুছী করে বসে পড়লাম।
মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমরা যারা ইফতার করার পূর্বে সকলকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দোয়া করো তাদেরকে দলীল পেশ করতে হবে এবং তোমরা কোথায় এটা পেয়েছ, তাও বলতে হবে।”
যিনি যুগের শ্রেষ্ঠ ইমাম, যাঁর ইল্ম ও আমলের নিকট সমস্ত আলিম সন্তানতুল্য। যাঁর রূহানী ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ্ পেয়েই গাউস, কুতুব, নকীব, আব্দাল, ওলী, নুকাবা, নুজাবা সকলেই আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বতের শরবত পানের সৌভাগ্য অর্জন করেন। যাঁর নেক দৃষ্টির বদৌলতে মারিফাত-মুহব্বত হাছিলের জজবা পেয়ে থাকেন। যিনি ইল্ম ও আমলের প্রেরণার উৎস। যিনি দ্বীনের ধারক-বাহক। তাঁর নিকট দলীল পেশ করার সাধ্য কার? কে পারবে তাঁর মতের বিপক্ষে দলীল প্রমাণ দিতে? কেননা, তিনি যদি একটি পাথরকে বলেন এটা স্বর্ণের টুকরা এবং স্বর্ণের একটি টুকরাকে যদি বলেন পাথরের টুকরা তাহলে বর্তমানে এমন কোন আলিম বা জ্ঞানী ব্যক্তি নেই যে, পাথরের সে টুকরাকে পাথরের এবং স্বর্ণের সে টুকরাকে স্বর্ণের টুকরা হিসেবে প্রমাণ করতে পারে। কাজেই আমাদের নিশ্চুপ বসে থাকাই আদব বা শিষ্টতা মনে করলাম। তিনি বেশ কিছু সময় আমাদেরকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে নিজেই মধু মাখা কক্তে বললেন, “আমাদের সিলসিলার কেউ কোনদিন এরূপ করেননি। কাজেই তোমরা আর কোন দিন এরূপ করবে না।” তিনি আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে আরো বললেন, “দেখ! ইল্মে শরীয়ত ও তাছাউফ উভয়ের সমন্বয়ে আমল করতে হয়। ইল্মে শরীয়তে করার অনুমতি থাকলেও তা যদি তরীক্বার খিলাফ হয় তবে সে আমল করা যাবেনা।”
ইমামে রব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “শরীয়ত গর্হিত বা খিলাফ না হলেও শুধু তরীক্বার মধ্যে নতুনত্ব সৃষ্টি করা গর্হিত কাজ।” (মাকতুবাত শরীফ) এ প্রসঙ্গে তিনি পূর্ববর্তী আউলিয়া-ই-কিরামগণের একটি ওয়াকেয়া উল্লেখ করে বললেন, ইমামে রব্বানী, গাউসে সামদানী, কাইয়্যূমে আউয়াল, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “আমাদের পীর ছাহেব ক্বিবলা তথা খাজায়ে খাজেগাঁ, সুলতানুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ হযরত খাজা বাকিবিল্লাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর খানার মজলিসে একদা আমি উপস্থিত ছিলাম। শায়খ কামাল নামক হযরতের একজন বিশিষ্ট মুরীদ খানা শুরু করার সময় তাঁর সম্মুখে “বিসমিল্লাহ্” শব্দ উচ্চ স্বরে বললেন। আমাদের পীর ছাহেব ক্বিবলা তাতে এরূপ অসন্তুষ্ট হলেন যে, কঠোরভাবে তাকে নিষেধ করলেন এবং বললেন যে, তোমরা তাকে নিষেধ করো সে যেন আমার খানার মজলিসে আর কোন দিন উপস্থিত না হয়।” এতদ্বশ্রবণে তখন আমরাও আমাদের কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তরীক্বার খিলাফ কোন কাজ না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। কেননা, স্বীয় পীর ছাহেবের তরীক্বার খিলাফ কাজ করে কিংবা পীর ছাহেবকে কষ্ট দিয়ে আমল করে যে জয্বা বা অনুপ্রেরণার উদ্ভব হয় তা ইস্তেদরাজ বা ছলনামূলক উন্নতি স্বরূপ। আর আহলে ইস্তেদরাজ বা ছলনামূলক প্রেরণা লাভ বিধর্মীরাও করে থাকে। গ্রীক দেশীয় দার্শনিক ও ভারতীয় ব্রাহ্মণদের যোগী সন্ন্যাসীরাও এ বিষয়ে তাদের সমতুল্য।
কাজেই প্রত্যেক মুরীদের উচিত গুরুত্ব সহকারে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহ্বত লাভ করতঃ তরীক্বার উক্ত আদর্শ বা নীতিমালা সম্পর্কে ইল্ম হাছিল করা এবং অন্যান্য মাশায়িখগণের তরীক্বার প্রতি লক্ষ্য না করে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার তরীক্বারই পরিপূর্ণ অনুসরণ করা এবং তাতে ইস্তিকামত থাকা। আয় আল্লাহ্ পাক! আমাদের সকলকে যামানার মহান মুজাদ্দিদের উছীলায় স্ব স্ব পীর ছাহেব ক্বিবলার তরীক্বার উপর ইস্তিকামত থাকার তাওফিক দান করুন। (আমীন)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬০)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬২)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৩)
পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৪)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৫)