৪১। কোন লোক যদি পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর শান-মান, মর্যাদা-মর্তবার খিলাফ কোন কথা বলে; তাহলে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে তা জানাবে না।
কারণ, যারা জাহিল, মূর্খ, আউলিয়া-ই-কিরামগণ-এর মর্যাদা-মর্তবা সম্পর্কে বে-খবর তাদের দ্বারা কিভাবে আউলিয়া-ই-কিরামগণ-এর ছানা-ছিফতের আশা করা যেতে পারে? বে-আদবের নিকট আদবের আশা করা আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র। কবি বলেন,
انك لا تجنى من الشوكـ العناب.
অর্থঃ-“তুমি কাটাযুক্ত গাছ থেকে কখনও আঙ্গুর ফল পাবেনা।” সুতরাং তাদেরকে তাদের আমলের উপর ছেড়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
خذ العفو وأمر بالعرف واعرض عن الجهلين.
অর্থঃ- “ক্ষমাকে গ্রহণ কর, সৎ কাজে আদেশ দাও আর জাহিল (মুর্খ) লোকদের থেকে দূরে সরে থাক” (সূরা আ’রাফ/১৯৯) তিনি আরো ইরশাদ করেন,
وعباد الرحمن الذين يمشون على الارض هونا واذا خاطبهم الجهلون قالوا سلما.
অর্থঃ- “দয়াময় মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দাতো তাঁরাই যারা বিনীত-বিনম্র হয়ে যমীনে চলাফেরা করে এবং যখন জাহিল লোকেরা তাদের সাথে কথা বলে তখন তাঁরা শান্তি বজায় রেখে কথা বলেন।” (সূরা ফুরক্বান/৬৩)
অর্থ্যাৎ জাহিলদের সাথে বির্তকে লিপ্ত হয়ে তাদের কুফুরীর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া বা হিদায়েত হতে বঞ্চিত করা মু’মিনগণের স্বভাব বিরোধী কাজ। পক্ষান্তরে আউলিয়া-ই-কিরামগণের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব আউলিয়া-ই-কিরামগণের কাছে বলার অর্থই হচ্ছে তাদের হিদায়েতের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। সর্বোপরি তাদের জিহালতপূর্ণ কথোপকথন, আউলিয়া-ই-কিরামগণের সামনে উপস্থাপন করা তাঁদের মনোকষ্টের কারণ। যা আদবের খিলাফ, চরম অন্যায়।
সুতরাং আউলিয়া-ই-কিরামগণ-এর আগোচরে তাঁদের শান-মান, মর্যাদা-মর্তবার খিলাফ কিছু বলা যেরূপ অন্যায় তার চেয়ে বেশী অন্যায় ও ক্ষতিকর হচ্ছে তাঁদের সামনে তা উল্লেখ করা।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, মুজাহিদে আ’যম, শাইখুল আরব ওয়াল আ’যম হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সামনে একদা তাঁর একজন মুরীদ বললো, “হুযূর! অমুক ব্যক্তি আপনাকে মন্দ খেতাবে সম্বোধন করেছে।” তখন শাইখুল আরব ওয়াল আ’যম মুহাজিরে মক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “তুমি তো সেই ব্যক্তির চেয়েও নিকৃষ্ট কাজ করলে। কারণ সে এতটুকু সৌজন্য রক্ষা করেছে যে, আমার সামনে বলেনি। অথচ তুমি আমার সামনেই তার পুনরাবৃত্তি করেছ!”
কাজেই কোন ব্যক্তি স্বীয় পীর ছাহেবের মর্যাদা-মর্তবার খিলাফ কোন উক্তি করলে হিকমতের সাথে নরমভাবে তাকে পীর ছাহেবের মর্যাদা-মর্তবার বিষয়টি বুঝিয়ে দিবে। কিন্তু তাতে যদি তার বোধোদয় না হয় কিংবা তার মতের পরিবর্তন না আসে তবে সেখান থেকে সরে পড়বে। কেননা স্বীয় পীর ছাহেবের শান-মান, মর্যাদা-মর্তবার পরিপন্থী আলোচনা শুনাটাও ক্ষতির কারণ। আর যারা পীর ছাহেবের প্রশংসা করে, তাঁর মান-মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় শুধু তাদেরই কথা তাঁকে জানাবে। তাতে পীর ছাহেব ক্বিবলা খুশী হবেন, যা তার জন্য আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত ও মুহব্বতের পথকে প্রসারিত করবে।
৪২। প্রত্যেক সালিক বা মুরীদের উচিত সকল কাজের উপর স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দেয়া ওযীফাকেই প্রাধান্য দেয়া। দিন-রাতের যে কোন সময়ই হোকনা কেন প্রথমে ওযীফা পাঠ করবে অতঃপর অন্যান্য কাজ করবে।
‘ওযীফা’ শব্দের অর্থ নিয়মতান্ত্রিকভাবে পালনীয় আমল বা কাজ। তাছাউফের পরিভাষায় সালিক বা মুরীদকে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর তরফ থেকে প্রদত্ত আমলকে ওযীফা বলে। যা পালনের মাধ্যমে মুরীদ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নৈকট্য তথা মা’রিফাত-মুহব্বত লাভ করে। ওযীফা আদায় করা প্রত্যেক সালিকের জন্য ফরয। সুতরাং তা অপরাপর সকল কাজের আগে অতি গুরুত্ব সহকারে পালন করা আবশ্যক।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত কাসিম ইবনে মুহম্মদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,
وكانت عائشة اذا عملت العمل لزمته.
অর্থঃ- “উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দিকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা যখন কোন আমল করতেন তখন তা লাজিম (অত্যাবশ্যক) করে নিতেন।” (মুসলিম শরীফ ১/২৬৬)
অন্যত্র বর্ণিত আছে,
وكان ال محمد صلى الله عليه وسلم اذا عملوا عملا اثبتوه.
অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বংশধরগণ যে আমল করেন তার মধ্যে তাঁরা অটল থাকতেন।” (মুসলিম শরীফ ১/২৬৬)
সর্বোপরি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
احب الاعمال الى الله ادومها وان قل.
অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক-এর নিকট ঐ আমলই অধিক প্রিয় যা দায়িমীভাবে করা হয় যদিও তা অল্প হয়।” (মুসলিম শরীফ ১/২৬৬)
এ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় মুসলিম শরীফের সম্মানিত ব্যাখ্যাকার হযরত ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
لان بدوام القليل يدوم الطاعة والذكر والمراقبة والنية والاخلاص والاقبال على الخالق سبحانه وتعالى.
অর্থঃ- “অল্প আমলের উপর দায়িম-কায়িম থাকার দ্বারা আল্লাহ্ পাক-এর পরিপুর্ণ আনুগত্য, যিকির-ফিকির, মুরাকাবা, মুশাহাদা, নিয়তের বিশুদ্ধতা, ইখলাছ (একাগ্রতা) কবুলিয়ত তথা নৈকট্য লাভের উপর অটল থাকা সহজ।” (শরহুন্ নববী- ১/২৬৬) অর্থাৎ যারা যথারীতি ওযীফা আদায় করে তাদের জন্য আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত, মুহব্বতের সমস্ত রাস্তা প্রসারিত হয়। আউলিয়াকুলের মধ্যমনি, সতী-সাধ্বী, সাইয়্যিদাতুন্ নিসা হযরত রাবেয়া বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহাকে একদা প্রশ্ন করা হলো, ‘সবচেয়ে উত্তম আমল কি?’ তিনি উত্তরে যথার্থই বলেছিলেন, ‘সময়মত মুরাকাবায় লিপ্ত থাকা।” (দলীলুল আরিফীন)
পক্ষান্তরে ওযীফা গাফলতির সাথে আদায় করা অথবা ওযীফা পরিত্যাগ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
تارك الورد ملعون.
অর্থঃ- “আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “ওযীফা পরিত্যাগকারী অভিশপ্ত।” (দলীলুল আরিফীন/৩০) মুজাদ্দিদে মিল্লাত, ইমামুদ্ দুনিয়া ফী ইলমিল ফিক্বহে ওয়াত্ তাছাউফ, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত আবু হামিদ মুহম্মদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি সালিক বা সাধনাকারীদেরকে সতর্ক করতঃ বলেন, “ইছলাহ্ বা আত্মপরিশুদ্ধির জন্য পীর ছাহেবের নিকট ওযীফা নেয়া, যিকির-ফিকির, মুরাকাবা-মুশাহাদায় আত্মনিয়োগ করার অর্থ হচ্ছে ঘোষণা দিয়ে শয়তানের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। সুতরাং যুদ্ধের ময়দানে যেমন গাফলতি করলে বা অমনোযোগী হলে প্রতিপক্ষের তরফ থেকে অতর্কিত আঘাতে নিহত হওয়া অনিবার্য; তদ্রুপ সালিকের জন্য সাধনার পথে অমনযোগী বা গাফলতি করলে শয়তানের কাছে পরাজিত হয়ে ধ্বংস অনিবার্য।” (মিন্হাজুল আবিদীন, সিরাজুত্ ত্বলিবীন)
স্মর্তব্য যে, যথাসময়ে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে একান্ত গভীর মনোযোগের সাথে ওযীফা আদায় করা আল্লাহ্ পাক-এর খাছ রহমতের উপর নির্ভরশীল। যাদের উপর খাছ রহমত বর্ষিত হয় তাদের পক্ষেই ওযীফার যথাযথ হক্ব আদায় করা সম্ভব। তাই পীর ছাহেব ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হয়ে ওযীফা নেয়ার সাথে সাথে আল্লাহ্ পাক-এর খাছ রহমত পাওয়ার জন্য তাঁর নির্দেশ মত ছোহবত ইখতিয়ার করাও আবশ্যক। কারণ, যতক্ষণ কারো উপর আল্লাহ্ পাক-এর রহমত বর্ষিত হয় ততক্ষণ তার পক্ষে গুনাহ্র কাজ হতে বিরত থাকা এবং নেক কাজে মশগুল থাকা সহজ ও সম্ভব হয়ে উঠে। কিন্তু যখন রহমত উঠে যায় তখনই মানুষ গুনাহ্র কাজে লিপ্ত হয় এবং নেক কাজে অলসতা আসে। হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “যদি কোন সালিকের রাত্রিকালীন কোন ওযীফা তরক্ব হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে, দিনের বেলা তার দ্বারা কোন না কোন গুনাহ্র কাজ সংঘটিত হয়েছে। কাজেই খালিছ তওবা-ইস্তিগ্ফার করে আমল শুদ্ধ করার কোশেশ করা আবশ্যক।” (ইহ্ইয়াউ উলুমিদ্ দ্বীন)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬০)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৩)
পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৪)
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৫)