ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৭)

সংখ্যা: ১০৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

          প্রসঙ্গঃ হাদিয়া প্রদান সাধারণ দান-সদকা করা হতে  উত্তম।

‘আহলুল্লাহ্’ তথা পীর-মাশায়িখ, ওলী-আউলিয়া, সূফী-দরবেশ,  আলিম-উলামা যারা অন্তরের পরিশুদ্ধিতা লাভ করেছেন তাদেরকে হাদিয়া প্রদান জরুরীও বটে। কেননা, তাঁরা হাক্বীক্বীভাবে দ্বীনের ধারক-বাহক। তাঁরা খালিছভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। তাঁদের মাল-জান এবং জীবনের পুরো সময়টাই এ পথে ব্যয় করে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে অর্থ উপার্জনের সময় পান না। সুতরাং তাঁদেরকে হাদিয়া দেয়া, সাহায্য-সহযোগিতা করা প্রকারান্তরে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর  হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হাদিয়া দেয়াই তথা দ্বীনের প্রচার-প্রসারের পথে সাহায্য-সহযোগিতা করারই নামান্তর। তাছাড়া আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ‘রফিকে আলার’ সাথে দিদারে মশগুল হওয়ার মাধ্যমে নুবুওওয়াত ও রিসালতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে; কিন্তু বিলায়েতের পরিধি ক্বিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।     প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য যে, একশত হিজরী বৎসর পর পর মুজাদ্দিদ আগমন করবেন; এবং প্রতি সময়ে যামানার ইমাম থাকবেন। যাঁর মাধ্যমে দ্বীন টিকে থাকবে।  সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমার উম্মতের একটি জামায়াত সর্বদা সত্য দ্বীনের উপর কায়িম থাকবে। কেউ তাদের কোন প্রকার ক্ষতি করতে পারবে না।”           কাজেই কেউ যদি যুগের ইমাম কিংবা মুজাদ্দিদ-এর সংবাদ বা সন্ধান পান তাহলে তাঁর ছোহ্বত হাছিল করা, তাওফিক আন্দাজ মাল-জান সবকিছু দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতঃ খিলাফত আলা মিন্হাজিন্ নুবুওওয়াতের পথকে সুগম করা তথা দ্বীনের প্রচার-প্রসার করার কোশেশ করা ঈমানী দায়িত্ব। স্মর্তব্য যে, দুনিয়ার যমীনে ক্বিয়ামত পর্যন্ত দু’টি দল থাকবে। কুরআন শরীফের পরিভাষায় একটি হচ্ছে ‘হিযবুল্লাহ্’ বা ‘আল্লাহ্ পাক-এর দল’ অপরটি হচ্ছে ‘হিযবুশ্ শয়তান’ বা ‘শয়তানের দল।’ আর এ দু’দলের নেতাও থাকবে সব যুগে।      হিজবুল্লাহ্ বা আল্লাহ্ পাক-এর দল যেমন জান-মাল সব দিয়ে ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য কোশেশে লিপ্ত থাকেন তেমনি শয়তানের দলও তাঁদেরকে প্রতিহত করার জন্য বৃথা কোশেশে লিপ্ত থাকবে। তবে যারা যে দলের নেতার অনুসরণ-অনুকরণ করবে, তাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করবে তারা সে দলের নেতার সাথে ক্বিয়ামতের ময়দানে উত্থিত হবে। মহান আল্লাহ্ পাক বলেন,

يوم ندعوا كل اناس بامامهم قمن اوتى كتبه بيمينه فاولئك يقر عون كتبهم ولا يظلمون قتيلا.

অর্থঃ- “সেদিন আমি প্রত্যেক মানুষকে তাদের ইমাম বা নেতাসহ আহবান করবো। অতঃপর যাদেরকে ডান হাতে তাদের আমলনামা দেয়া হবে তারা নিজেদের আমলনামা পাঠ করবে। আর তাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও জুলুম করা হবেনা।” (সূরা বণি ইসরাঈল/৭১) এ আয়াত শরীফের তাফসীরে রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে,

يامام زمانهم الذى دعاهم فى الدنيا الى ضلالة اوهدى.

অর্থঃ- “যামানার ইমাম যারা মানুষকে হিদায়েতের দিকে ডাকেন অথবা যেসব নেতা যারা মানুষকে গোমরাহীর দিকে ডাকে।”(তাফসীরে মাযহারী ৫/৪৬০ পৃষ্ঠা, যাদুল মাছীর ৫/৪৭)     হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,

المراد بالامام امام عصرهم قيدعى اهل كل عصر بامامهم الذى كاذوا يأتمرون يأ مره وينتهون بنهيه.

অর্থঃ- “ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের যুগের ইমাম। (ক্বিয়ামতের দিন) প্রত্যেক লোককে তাদের যুগের ইমামসহ আহবান করা হবে; যারা সৎ কাজের প্রতি আদেশ দান করেন অথবা অসৎ কাজে নিষেধ করেন।” (তাফসীরে ফাতহুল ক্বাদীর ৩/২৪৬) যামানার ইমাম বা হাদী তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পাদন করেছেন কি-না আর লোকেরা তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা করেছে কি-না, তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ কতটুকু করেছে তার জাওয়াব তলব করবেন।   ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয্ যামান, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেন, “যারা যামানার ইমামের অনুসরণ-অনুকরণ করবে, সাহায্য-সহযোগিতা করবে, তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার কোশেশ করবে তিনি তাদের পক্ষে তার স্বীকারোক্তি করতঃ তাদের নাযাতের জন্য(শাফায়াত) সুপারিশ করবেন। আর তা গৃহীত হবে। তখন ইমাম তাদের সকলকে নিয়ে চির সুখের স্থান জান্নাতে চলে যাবেন।” সুতরাং সেদিন যারা হাদিয়া দানকারী তারা যে তাঁদের প্রচারিত দ্বীনের সাহায্যকারী, তাঁদের সুপারিশের আওতাভুক্ত হবেন তা আর নতুন করে বলার অবকাশ নেই।   “তাফসীরে রুহুল বয়ান” ৫ম খন্ডের, ১৮৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “যে সম্প্রদায় যাদের অনুসরণ করবে তারাই তাদের ইমাম বা নেতা মনোনীত হবে। সুতরাং যে দল দুনিয়া, দুনিয়ার চাকচিক্য এবং তার কামনা-বাসনার অনুসরণ করবে তাকে ‘আহলুদ্ দুনিয়া’ বা ‘দুনিয়াদার’ বলে আহবান করা হবে। আর যে সম্প্রদায় আখিরাতের অনুসরণ করবে এবং তার সু-উচ্চ মর্যাদা ও নিয়ামত তলব করবে তাকে ‘আহলে আখিরাত’ বলে ডাকা হবে। আর যারা আল্লাহ্ পাক-এর মুহব্বতের জন্য সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করবে এবং তাঁর কুরবত (নৈকট্য) ও মারিফাত কামনা করবে তাঁদেরকে ‘আহলুল্লাহ্’ বা ‘আল্লাহ্ওয়ালা’ বলে আহবান করা হবে।”         আর নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের পরে এ ‘আহলুল্লাহ্’ বা ‘আল্লাহ্ওয়ালা’ তথা আউলিয়া-ই-কিরামগণই সবচেয়ে বেশী সম্মানিত ও মর্যাদা সম্পন্ন হবেন। আর তাঁদের কাছ থেকে সকলেই ফায়দা হাছিল করবে।     এ প্রসঙ্গে সুলতানুল হিন্দ, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত, গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ্, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “একদা আমার পীর ছাহেব ক্বিবলা সুলতানুল আরিফীন, সাইয়্যিদুল আউলিয়া, ইমার্মু রাসিখীন, খাজায়ে খাজেগাঁ, খাজা উসমান হারূণী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং কুতুবুল ইরশাদ খাজা আহাদুদ্দীন কিরমানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং আমি মদীনা শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফরে বের হলাম। দামেস্কে পৌঁছে সেখানে অবস্থিত বার হাজার নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম গণের রওজা শরীফ জিয়ারতের জন্য কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করলাম। এক মসজিদে হযরত খাজা মুহম্মদ আরিফ নামে একজন কামিল বুযূর্গ থাকতেন। একদিন আমরা তাঁর মজলিসে বসেছিলাম। তিনি তাঁর অমূল্য নছীহতের এক পর্যায়ে বললেন, “ক্বিয়ামতের দিন সূফী সম্প্রদায় হতে সকলেই ফায়দা হাছিল করবে এবং সম্মানিত হবে।” তখন এক ব্যক্তি এ ব্যাপারে তাঁর সাথে (বাহাস) বিতর্কে লিপ্ত হলো। সে বললো, “আপনার বক্তব্যের পিছনে কোন দলীল আছে কি? এটা কোন কিতাবে পেয়েছেন?” উত্তরে খাজা মুহম্মদ আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “কিতাবের নামটা স্মরণ করতে পারছিনা।” লোকটি বললো, “কিতাবের লিখা না দেখানো পর্যন্ত বিশ্বাস করিনা।” তখন খাজা আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় মাথা মুবারক আকাশের দিকে উত্তোলন করে বললেন, “ইয়া বারে ইলাহী! কিতাবের নাম আমার মনে নেই, ভুলে যাওয়া কিতাবটি দেখিয়ে দিন।” তৎক্ষণাত আল্লাহ্ পাক ফেরেশ্তার প্রতি নির্দেশ করলেন, “যে কিতাবে এটা লিখা আছে তা নিয়ে দেখাও।” তখন ফেরেশ্তা ঐ কিতাব নিয়ে খাজা মুহম্মদ আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট হাযির হয়ে উক্ত কিতাবটি প্রদান করেন। তখন তিনি কিতাব খুলে লোকটিকে তা দেখিয়ে দিলেন। তখন সে ব্যক্তি লজ্জিত হয়ে খাজা মুহম্মদ আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কদম মুবারকে পড়ে গেলো এবং তওবা করে তাঁর নিকট মুরীদ হলো।” (দলিলুল আরিফীন)   এ প্রসঙ্গে “ইসরারুল আউলিয়া” কিতাবে উল্লেখ আছে যে, “সাইয়্যিদুল মুজাহিদীন, ইমামুল আযম, শাইখুল ইসলাম হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গন্জে শোকর রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “আমার পীর ছাহেব কুতুবুল আলম, সাইয়্যিদুল আউলিয়া, ইমামুল আইম্মা, সুলতানুল মাশায়িখ হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ্ পাক যখন সূফীগণকে আহবান করবেন তখন তাঁরা প্রত্যেকেই কম্বল (সূফীগণের বিশেষ পোশাক) কাঁধে নিয়ে উপস্থিত হবেন। তাঁদের কম্বলের সাথে হাজার হাজার শিকল বা সূতা লাগানো থাকবে। তাদের মুরীদ-মু’তাকিদ, আশিকীন-মুহিব্বীন, সাহায্য-সহযোগিতাকারীগণ সেই শিকল বা সূতা ধরবে। তিনি তাদেরকে নিয়ে পুলসিরাত অতিক্রম করতঃ জান্নাতে চলে যাবেন। অতঃপর পুনরায় হাশরের ময়দানে ফিরে এসে উচ্চ স্বরে বলবেন, “আমার ভক্ত-অনুরক্তগণ কোথায়? তোমরা আমার কম্বলের সূতা ধরে জান্নাতে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট চলে যাও।” (সুবহানাল্লাহ্) সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, যে ব্যক্তি স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে জান-মাল, অর্থ-সম্পদ, সময়-শ্রম দিয়ে যত বেশী সাহায্য-সহযোগিতা করবে সে ব্যক্তি তাঁর শাফায়াত বা সুপারিশের ততোধিক হক্বদার হবে। (মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই অধিক জানেন)

মহান আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে যামানার মহান মুজাদ্দিদ-এর উছীলায় স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে হাদিয়া দানের মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার-প্রসার কাজে শরীক থাকার তাওফীক দান করুন। (আমীন)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৮)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬০)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬২)