-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ শোয়াইব আহমদ
হিজরী সনের তৃতীয় মাসের নাম রবিউল আউয়াল। আরবী ‘রবিউন’ শব্দটির অর্থ বসন্তকাল এবং ‘আউয়াল’ শব্দটির অর্থ প্রথম। বসন্তকালের দু’টি মাসের প্রথম মাস হচ্ছে এটি। বসন্তকালে গ্রীস্মের প্রচন্ড উত্তাপ এবং শীতের প্রচন্ড শীত কোনটিই অনুভূত হয়না। বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে মনোরম ও আরামদায়ক সময়। এ সময়েই সতেজ ও সুশোভিত হয়ে উঠে প্রকৃতি। তাই এ কালকেই কালের রাজা বলা হয়। এ শ্রেষ্ঠ ও আরামদায়ক কালের বা সময়ের মধ্যেই আল্লাহ্ পাক তাঁর পেয়ারা হাবীব, ইমামুল আম্বিয়া, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, রহমতুল্লিল আলামীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যমীনে প্রেরণ করেন। অর্থাৎ তাঁর যমীনে তাশরীফ গ্রহণ তথা বিলাদত শরীফের মুবারক দিনটি ছিলো ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার। কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
لقد من الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক মু’মিনদের প্রতি ইহ্সান করেছেন তাদের মাঝে একজন রসূল পাঠিয়ে। অর্থাৎ সেই রসূল হচ্ছেন সাক্বিয়ে কাউছার, শাফিয়ে মাহ্শার, ফখরে দো’আলম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।” (সূরা আলে ইমরান/১৬৪) অতএব, ইহ্সানের শোকরানা স্বরূপ মুসলিম উম্মাহ্র জন্য নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যমীনে তাশরীফ গ্রহণের মুবারক দিনটিকে খুশীর দিন হিসেবে উদ্যাপন করা উচিত। কিতাবে এসেছে,
من عظم ليلة مولوده بما امكنه من التعظيم والاكرام كان من الفائزين بدار السلام.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি সাধ্য-সামর্থ অনুযায়ী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবারক বিলাদত শরীফের দিনটিকে ইজ্জত-সম্মান করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সুবহানাল্লাহ্)
উম্মতের দাবীদার এক শ্রেণীর লোক তারা বিলাদত শরীফের মুবারক দিনটিকে খুশীর দিন হিসেবে পালন করার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। তাদের যুক্তি হলো, “যেহেতু রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একই দিনে বিলাদত শরীফ ও ওফাত শরীফ হয়েছে সেহেতু উক্ত দিনে শুধুমাত্র খুশী প্রকাশ করা অন্যায়।” এ নিছক যুক্তি খন্ডনে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ্ পাক-এর প্রথম নবী-রসূল হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর যমীনে পয়দা হওয়া এবং ওফাত হওয়া একই দিনে তথা জুমুয়ার দিনে সংঘটিত হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও স্বয়ং আল্লাহ্ পাক সেই জুমুয়ার দিনকে আমাদের জন্য খুশীর দিন হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
যে মর্মে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
ان هذا يوم عيد جعله الله للمسلمين.
অর্থঃ- “এ জুমুয়ার দিন হচ্ছে ঈদের দিন। এ দিনটিকে আল্লাহ্ পাক মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।” (ইবনে মাজাহ্, মুসনদে আহমদ)
তাহলে ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার দিনটি ঈদ হিসেবে উদ্যাপন করতে বাধা কোথায়? বরং হাদীস শরীফের বর্ণনানুযায়ী ১২ই রবিউল আউয়াল দিনটিকে ঈদ হিসেবে উদ্যাপন করা আমাদের জন্য জরুরী সাব্যস্ত হয়ে পড়ে। মূলতঃ আল্লাহ্ পাক যাদের প্রতি খাছ রহমত নাযিল করেন কেবল তাঁদের পক্ষেই তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছানা-ছিফত করা, তাযীম-তাকরীম করা, মর্যাদা-মর্তবা বর্ণনা করা এক কথায় তাঁর যথাযথ হক্ব আদায় করা সম্ভব।
রবিউল আউয়াল মাস যে নছীহত নিয়ে আমাদের নিকট হাযির হয় তাহলো আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি হুসনে যন (সু-ধারণা), ছহীহ্ ও উত্তম আক্বীদা পোষণ করা, তাঁকে সবকিছু থেকে এমনকি নিজের জীবন অপেক্ষা মুহব্বত করা এবং পরিপূর্ণরূপে অনুসরণ করা।
কেউ যদি মুবারক শান ও মর্যাদার খিলাফ কোন কথা বলে তাহলে সে মুসলমান ও উম্মত থাকতে পারবে না। কেউ যদি তার সবকিছু থেকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বেশী মুহব্বত করতে না পারে তাহলে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারবেনা। আর কেউ যদি তাঁকে অনুসরণ না করে তাহলে সে আল্লাহ্ পাক-এর মুহব্বত, ক্ষমা ও দয়া লাভ করতে পারবে না।
মহান আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
قل ان كنتم تحبون الله فاتبعونى يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله غفور رحيم.
অর্থঃ- “হে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার উম্মতদেরকে বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ্ পাক-এর মুহব্বত পেতে চাও, আমার ইত্তিবা (অনুসরণ) কর, তবেই আল্লাহ্ পাক তোমাদেরকে মুহব্বত করবেন, তোমাদের গুণাহ্সমূহ ক্ষমা করে দিবেন আর আল্লাহ্ পাক হচ্ছেন অধিক ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান/৩১) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের কতিপয় আক্বীদা- ১. আল্লাহ্ পাক সর্বপ্রথম নূরে মুহম্মদী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করেন এবং সেই নূরে মুহম্মদী হতে তামাম মাখলুকাত সৃষ্টি করেন। ২. খালিক্ব বা স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহ্ পাক হলেন একক, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। আর মাখলুক বা সৃষ্টির মাঝে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন একক, তাঁর সমকক্ষ কোন সৃষ্টি নেই। ৩. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নূরের তৈরী। অর্থাৎ তিনি নূরে মুজাস্সাম। তাঁর আপদমস্তক নূর। ৪. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মত নন। তিনি আল্লাহ্ পাক-এর মনোনীত রসূল এবং সকল নবী-রসূলগণের সাইয়্যিদ। ৫. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেহ মুবারক হতে নির্গত রক্ত, ইস্তিঞ্জা, থুথু মুবারক ইত্যাদি সবকিছু পাক ও পবিত্র। এমনকি সে সমস্ত যাঁদের শরীরে প্রবেশ করেছে তাঁরা সকলেই জান্নাতী হয়েছেন। ৬. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেহ মুবারকের ছায়া ছিলো না। ৭. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেহ মুবারকে মশা-মাছি বসতো না। ৮. আল্লাহ্ পাক তাঁকে ইলমে গয়িব দান করেছেন। অর্থাৎ তিনি হলেন মুত্তালা’আলাল গয়িব। ৯. আল্লাহ্ পাক-এর প্রদত্ত ক্ষমতায় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাযির ও নাযির। ১১. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সর্বমোট চৌত্রিশ বার মি’রাজ শরীফ হয়েছে। তেত্রিশ বার হয়েছে রূহানী ভাবে। আর একবার হয়েছে স্বশরীরে। আর মি’রাজ শরীফে তিনি আল্লাহ্ পাক-এর সরাসরি সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। ১২. আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম ছিলেন সম্পূর্ণরূপে মা’ছূম বা নিষ্পাপ।
১৩. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল পিতা-মাতার মাধ্যম হয়ে যমীনে তাশরীফ এনেছেন তাঁদের কেউই কাফির ও মুশরিক ছিলেন না। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ যামানার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মকবুল ব্যক্তি ছিলেন। ১৪. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পিতা-মাতা খালিছ মুসলমান ছিলেন এবং তাঁরা উভয়ই জান্নাতী। ১৫. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ নবী ও রসূল। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কতিপয় সুন্নত ১. চার টুকরা বিশিষ্ট, গোল, সাদা সূতী কাপড়ের টুপি পরিধান করা।
২. সাধারণতঃ কালো, সাদা, সবুজ রং-এর তিন হাত (ঘরের ভিতর), সাত হাত (পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও বাইরে চলার সময়), বার হাত (ঈদ, জুমুয়া ও বিশেষ অনুষ্ঠানাদিতে) পাগড়ী পরিধান করা। ৩. টুপি ও পাগড়ীর নীচে (মাথায় তৈল দেয়ার পর) কিনা অর্থাৎ গোলাকৃত কাপড়ের টুকরা ব্যবহার করা। ৪. টুপি ও পাগড়ীর উপর সাদা রুমাল পরিধান করা। ৫. গুটলীওয়ালা, কোনা বন্ধ, নিছফুসাক সূতী কাপড়ের কোর্তা পরিধান করা। ৬. কোর্তার উপর জুব্বা পরিধান করা। ৭. চাদর ব্যবহার করা। ৮. ফাঁড়া তথা সিলাইবিহীন লুঙ্গী পরিধান করা। ৯. ক্রস বেল্ট বিশিষ্ট চামড়ার চটি সেন্ডেল ব্যবহার করা। ১০. বাবরী চুল রাখা। ১১. মোঁছ ছোট ছোট করে রাখা। ১২. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দাড়ি মুবারক ছিলো সিনা পোর লম্বা। ১৩. জুমুয়া ও ঈদের খুৎবা দানকালে লাঠি ব্যবহার করা। ১৪. পানাহারের সময় কাঠের পেয়ালা, লবনদানী ও চামড়ার দস্তরখানা ব্যবহার করা। ১৫. হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তাবলীগ ছিলো সৎ কাজের আদেশ করার পাশাপাশি অন্যায়-অসৎ কাজ থেকে বারণ করা।
অতএব, আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের যে আক্বীদা সে মুতাবিক আক্বীদা পোষণ করে এবং সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসরণ করে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি-রেযামন্দি হাছিল করা উম্মতের একামাত্র দায়িত্ব। আল্লাহ্ পাক আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। (আমীন)
রবিউস্ সানী মাস ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা
জুমাদাল উলা মাস ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা