-সাইয়্যিদ মুহম্মদ মুনিস মুর্শিদ
فبما رحمة من الله لنت لهم.
অর্থঃ- “অতএব, আল্লাহ্ তায়ালার বিশেষ রহমত এই যে, আপনি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত।” (সূরা আলে ইমরান/১৫৯) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অন্তর নিহিত করুণা সমগ্র বিশ্ব বাসীর উপর সহস্রধারায় ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন গৃহে পরিবার পরিজন ও দাস-দাসীর প্রতি, তেমনি সমাজে সহচর-অনুচর, দীন-দুঃখী ও আগন্তুক-অভ্যাগতগণের প্রতি আবার তেমনি সমরক্ষেত্রে শত্রু-মিত্রের প্রতি সমভাবে তাঁর করুণা স্রোত উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ-
استوصوا بهم خيرا.
“তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবেন” সে কারণে, বদরের যুদ্ধ বন্দীদের সাওয়ারীতে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ গিয়ে ছিলেন পায়ে হেঁটে। এক যুদ্ধবন্দীর বর্ণনা, “তাঁরা যখন আমাকে বন্দী করে নিয়ে এল তখন জনৈক আনসারীর ঘরে আমার জায়গা মিলল। তারা আমাকে দু’বেলা রুটি খেতে দিত আর নিজেরা খেজুর খেয়ে থাকত। এ ছিল রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপদেশ ও নির্দেশেরই ফল। কেউ কোথাও থেকে এক টুকরা রুটি পেলেও তা আমাকে এনে দিত। আমার লজ্জা লাগত গ্রহণ করতে, তাই আমি তা ফিরিয়ে দিতাম। কিন্তু তাঁরা আমাকে জোর করে দিত এবং নিজেরা তা হাত দিয়েও ধরত না।” বদরের যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুসহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অন্যান্য নিকট আত্মীয়স্বজনও ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সাথে যে ব্যবহার করা হয়েছিল সাধারণ যুদ্ধবন্দীদের সাথেও সে ব্যবহারই করা হয়। বণী হানীফার সর্দার সুমামা ইবনে আসালকে বন্দী অবস্থায় মসজিদের একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদিক দিয়ে অতিক্রম করলে তাকে সম্বোধন করে বলেন, “সুমামা! তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?” সুমামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, “হে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন তবে এমন একজনকে হত্যা করবেন যার ঘাড়ে রক্ত আছে। যদি আমার সাথে সদয় ব্যবহার করেন তাহলে একজন কৃতজ্ঞ ও সদয় ব্যবহারের স্বীকৃতি প্রদানকারীর সঙ্গে সদয় ব্যবহার করবেন। আর আপনি যদি ধন-দৌলত চান তাহলে তা আপনি বলুন, আপনি যা চাইবেন তা পাবেন। “একথা শুনে তিনি এগিয়ে গেলেন। এরকম তিনবার ঘটলো। তৃতীয়বার তাকে মুক্তি দেয়া হলো। অনন্তর সুমামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মসজিদের নিকটবর্তী খেজুর বাগানে গিয়ে গোসল করলেন এবং রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে হাজির হয়ে ইসলাম কবুল করলেন এবং আরজ করলেন, “আল্লাহ্ পাক-এর কসম! এক সময় ছিল যখন আপনার চেয়ে অধিক অপছন্দের আমার কেউ ছিলনা। কিন্তু আজ আপনার নূরানী চেহারা মুবারক আমার কাছে দুনিয়ার যাবতীয় জিনিষের মুকাবিলায় অধিকতর প্রিয়।” আল্লাহ্ পাক-এর কসম! আপনার দ্বীনের চাইতে বেশি হিংসা-বিদ্বেষ আর কোন ধর্মের প্রতি আমি পোষণ করতাম না। কিন্তু আজ আপনার দ্বীন-দুনিয়ার তাবৎ ধর্ম ও মাযহাবের তুলনায় আমার কাছে অধিক মুহব্বতের।” তিনি ইয়ামামার অধিবাসী ছিলেন। যেখান থেকে মক্কার প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আসত। ফলে তিনি সেই খাদ্যের যোগান বন্ধ করে দেন, ফলে কুরাঈশদের না খেয়ে মরবার উপক্রম হয়। অবশেষে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে আবেদন পেশ করলে তিনি তা কবুল করেন এবং আবার খাদ্যের সরবরাহ চালু হয়। হাতেম তাঈয়ের কন্যা সাফ্ফানা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা এক যুদ্ধে বন্দী হয়ে আসলে, তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে মুক্তির আবেদন জানান। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। উপরন্তু বাহন, প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও জামা কাপড় দিয়ে তাঁর ভাই জলিলুর ক্বদর ছাহাবী হযরত আদি ইবনে হাতীম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। এরই ফলশ্রুতিতে আদি ইবনে হাতিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বণী তাঈ হিদায়েত প্রাপ্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্ষমা বদান্যতা, উদারতা, করুণার বর্ণনা দেয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। মূলতঃ পরাজিত বাহিনী ও যুদ্ধ বন্দীদের প্রতি তাঁর কোমল আচরণ ও বদান্যতা নজীর বিহীন। তাই মক্কা বিজয়ের দিন রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উদাত্ত ঘোষণা,
لاتثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم وهو ارحم الر حيمين.
“আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ্ পাক তোমাদের ক্ষমা করুন। আর তিনিই দয়া প্রদর্শনকারীদের মধ্যে সর্বাধিক দয়ালু।” اليوم يوم الملحمة “আজ প্রচন্ড লড়াইয়ের দিন, আজ রক্তপাতের দিন।” সেখানে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
اليوم يوم المرحمة
‘আজ তো দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনের দিন।” আর এভাবেই একটি হরফের পরিবর্তনে (الملحمة-র পরিবর্তে المرحمة) নাযাত পেল এক কওম। আদর্শ স্থাপিত হল সহনশীলতার, অন্তরের প্রশস্ততার। সে পথ ধরেই এগিয়ে গেছে মুসলিম বিজয় অভিযান। যতটা না দেশ বিজয় হয়েছে তারচেয়ে অধিক বিজয় হয়েছে, মানুষের মন। তাঁরা যেখানেই গেছেন সকলকেই দান করেছেন নিরাপত্তা, অভয়। বিজয়ী হয়ে ঘোষণা করেছেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কালজয়ী শিক্ষা- “আজ উত্তম আচরণ প্রদর্শনের দিন।” এসব ঘটনা থেকে আমরা মুসলমানদের উদারতা ও সহনশীলতা কোন পর্যায়ের ছিল তা খানিকটা অনুধাবন করতে পারি। এর বিপরীতে ঈর্ষাকাতর ও সাম্প্রদায়িক ইহুদী, খৃষ্টান ও হিন্দুরা যে জুলুম ও নির্যাতন চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে তা সহজেই পরিমাপ যোগ্য। ক্রসেডের নামে একাদশ শতাব্দীতে জেরুজালেমে মুসলমানদের অন্যায় ভাবে উৎখাত ও নির্মূলের জন্য নিরস্ত্র অসহায় নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ এবং শিশুদের উপর যে সংঘবদ্ধ, সুপরিকল্পিত, বর্বর হত্যাকান্ড চালানো হয়েছিল দুঃখজনক ভাবে ইতিহাসের সে কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি আজো হয়নি। বলা হয়, সেদিন ঘোড়ার পেট পর্যন্ত রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল। তাই ঐসব তথাকথিত বিজয়ী এবং ইসলামের নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য সূচীত হয়েছে।