-মুফতী মুহম্মদ নূরুল ইসলাম
وداعيا الى الله باذنه وسراجا منيرا.
অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক-এর আদেশক্রমে তাঁরই দিকে আহবানকারী রূপে এবং এক দীপ্তিমান আলোকদানকারী রূপে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানো হয়েছে।” (সূরা আহযাব/৪৬)
এ আয়াতে কারীমাতে খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে داعى الى الله হিসাবে উল্লেখ করে তাঁর দাঈ (আল্লাহ্ পাক-এর দিকে আহবায়ক) সুলভ সীরাত এবং পয়গম্বর সুলভ সকল ফযীলত ও কামালতের উপর আলোকপাত করা হয়েছে, داعيا الى الله বাক্যাংশের পূর্বে شاهد ((সাক্ষী) مبشر (সূসংবাদদাতা) ও نذير (সতর্ককারী) শব্দগুলো এনে ৪৫ নম্বর আয়াতে দাওয়াতের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় দু’টি মৌলিক বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রথমতঃ شاهد সাক্ষী ও প্রমাণরূপে দাঈর দ্বিতীয়তঃ তারগীব বা উৎসাহদান ও তারহীব বা সতর্কীকরণ مبشر ও نذير “সুসংবাদদাতা” ও “সতর্ককারী” এ শব্দদ্বয়ের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যা দাওয়াতের উছূল ও আরকান তথা মৌলিক নীতিসমূহ ও বিধান মালার মূল। অপরদিকে مبشر، شاهد ও نذيرদাওয়াতের এ বুনিয়াদী শব্দগুলোকে مطلق বা শর্তহীন ভাবে উল্লেখ করে دعوت الى الله (আল্লাহ্ পাক-এর দিকে আহবান)-এর ব্যাপকতা ও বিস্তৃতির প্রতি ইশারা করা হয়েছে, যা প্রকৃত পক্ষে খত্মে নুবুওওয়াতেরই বিষয়বস্তু। আর শেষে وسراجا منيرا (জ্যোর্তিময়) শব্দ এনে দাঈ ও দাওয়াতের যে ব্যাপক ও বিস্তৃত দিক সে داعى -এর মধ্যে যা লুকিয়ে আছে তার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। অন্য আয়াতে কারীমায় আল্লাহ্ পাক বলেন,
لقد من الله عى المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم يتلوا عليهم ايته ويزكيهم ويعلمهم الكتب والحكمة وان كانوا من قبل لفى ضلل مبين.
“আল্লাহ্ তা’আলা মু’মীনদের বড় নিয়ামত দিয়েছেন যে, তাদের জন্য তাদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদেরকে আল্লাহ্ পাক-এর আয়াত তিলাওয়াত করে শুনান এবং তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। যদিও তারা পূর্বে হিদায়েত প্রাপ্ত ছিলনা।” (সূরা আলে ইমরান/১৬৪) উপরোক্ত আয়াতে চারটি কাজ যথা তিলাওয়াত, তা’লীম, তাযকিয়া ও ‘হিকমত’-এর কথা বলা হয়েছে এবং উলামা-ই-কিরাম এ চারটি কাজকে সূর্যের চারটি তাকবীনি দায়িত্ব- তাওয়াজ্জুহ, তানবীর, তা’সীর, তাসী-এর সাথে তুলনা করেছেন। তিলাওয়াতঃ সূর্য যেমন তাওয়াজ্জুহ অর্থাৎ জনসমক্ষে উদিত হয়ে আলোর ঝিলিক দেখায় তেমনি তিলাওয়াতের মাধ্যমে খোদায়ী ইল্ম ও ওহীর এবং পয়গম্বরীর সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে।
তালীমঃ সূর্য যেমন তানবীর- অর্থাৎ আলোকিত করে, ফলে এক বস্তু অন্য বস্তু থেকে পৃথক করা যায়। ঠিক সে ভাবে তালীমের মাধ্যমে বাতিল আর হক্ব পৃথক হয়েছে।
তাযকিয়াঃ সূর্য যেমন তাসীর অর্থাৎ তার উত্তাপ দ্বারা অন্যকে উত্তপ্ত করে তোলে এবং সূর্য রশ্মি জীবানু ইত্যাদি ধ্বংস করে। ঠিক সেভাবে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্বলব মুবারক থেকে ফয়েজ বিচ্ছূরিত হয়ে ক্বলবে পতিত হয়ে অন্তরের পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জিত হয়।
হিকমতঃ সূর্য যেমন তাসী-অর্থাৎ গতিবিধির মাধ্যমে আদর্শ স্থাপন ও পথপ্রদর্শন করে। ঠিক সেভাবে উম্মতের আমল করার জন্য আদর্শস্থাপন করে অর্থাৎ اسوة حسنة “উসওয়ায়ে হাসানা কায়িম করে, মানুষের মনগড়া ও অপরিপক্ক মতবাদ ও আমল ত্যাগ করে চিরস্থায়ী নিয়ামত অর্জনের পথ প্রদর্শন করেছেন।
আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফিকিরই ছিল, কি করে প্রত্যেকটি মানুষ হিদায়েত ও নাযাত পায়। তিনি দোয়া করতেন,
اللهم اهدنا واهدبنا الناس جميعا.
“হে আল্লাহ্ পাক! আমাদেরকে হিদায়েত দান করুন এবং আমাদের উছীলায় প্রত্যেককে হিদায়েত দান করুন।”
আর আল্লাহ্ পাক হিদায়েত দিবেন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উছীলায়। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেন,
قد جاء كم من الله نور وكتب مبين يهدى به الله من اتبع رشوانه.
“নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহ্ পাক-এর তরফ থেকে এসেছে সুস্পষ্ট কিতাব এবং এক নূর (হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাঁর উছীলায় আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টি অন্বেষণকারীদের হিদায়েত দান করবেন।” (সূরা মায়িদা/১৫) তাই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে رحمه للعلمين (সমস্ত আলমের জন্য রহমত স্বরূপ) এবং نذير للعلمين সমগ্র আলমের জন্য সতর্ককারী বলা হয়েছে। আর হিদায়েতের দায়িত্ব পালনে তিনি নজিরবিহীন কষ্ট তকলিফ বরদাস্ত করেছেন। আর বলার অপেক্ষা রাখেনা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হিদায়েত ও তা’লীমের পদ্ধতি ছিল কুরআন শরীফে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী। যেমন তাঁর হিদায়েতের পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ ফরমান,
ادع الى سبيل ربك بالحكمة والموعظة احسنة وجاد لهم بالتى هى احسن.
“হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি মানুষকে আল্লাহ্ পাক-এর রাস্তায় হিকমত এবং উত্তম নছিহতের মাধ্যমে আহবান করুন। আর তাদের সাথে (যদি প্রয়োজন হয়) আলোচনা করুন, কিন্তু উত্তম পন্থায়।” (সূরা নহল/১২৫)
আল্লাহ্ পাক-এর রাস্তা বলতে দ্বীন ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন শরীফের নিয়ম-নীতি তর্জ-তরীকা অর্থাৎ ঈমান ও আকাঈদের ইল্ম যা পরবর্তীকালে মুতাকাল্লেমিনগণ প্রচার করেছেন। আহকামে ফিক্বাহ অর্থাৎ আল্লাহ্ তায়ালার আদেশ ও নিষেধ সমূহ যা পরবর্তীতে ফক্বীহগণ প্রচার করেছেন এবং ইল্মে তাছাউফ যা পরবর্তীতে সূফীয়া-ই-কিরাম ও শায়েখগণ প্রচার করেছেন। অর্থাৎ পূর্ণ শরীয়ত এবং তরীক্বতের তাবলীগ করেছেন। অর্থাৎ যে দ্বীন আমরা আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ইমাম-মুজতাহিদ, আলিম-উলামা, মাশায়েখ কর্তৃক প্রাপ্ত হয়েছি, সে দ্বীনের দিকে আহবান করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক তিনটি বিষয় নির্দেশ করেছেন। (১) দাওয়াত বিল-হিকমত, (২) উত্তম ওয়াজ-নসীহত দ্বারা দাওয়াত (৩) উৎকৃষ্ট পদ্ধতিতে বাহাস ও আলোচনার মাধ্যমে দাওয়াত। প্রধানতঃ দুটি বিষয়ের প্রয়োজন হয়। একটি হল, নিজের দাবীকে দলীল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা। অন্যটি হল প্রতিপক্ষের দাবীর অসারতা প্রমাণ করা। আর তৃতীয় জিনিস হল উত্তম পন্থায় ওয়াজ-নসীহত করা। এর মূল হল মানুষের প্রতি দয়া-মায়া, মুহব্বত। দাওয়াত বিল হিকমার উদাহরণ হিসাবে বলা যায় হুদায়বিয়ার সন্ধির পর অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই শান্তিপূর্ণ হয়ে যায়। এ সুযোগে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর বিভিন্ন শাহানশাহ, সম্রাট ও আরবের আমীর-উমরা বরাবর অত্যন্ত হিকমতের সাথে বিজ্ঞ পন্থায় ইসলামের দাওয়াত দেন। এজন্য তিনি বেশ আয়োজন করেন এবং প্রত্যেক সম্রাটের জন্য এমন দূত নির্বাচন করেন যাঁরা তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা মুতাবিক কথাবার্তা বলতে পারেন এবং সে সকল দেশের ভাষা (যেমন রোমক, পারসিক, কিবতী ও আবিসীনিয়) অধিকন্তু দেশের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরজ করেন যে, এসব দেশের শাসকবর্গ এমন কোন পত্র গ্রহণ করেন না যার উপর মোহরাঙ্কিত না করা হয়। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য একটি বিশেষ মোহর (সিল) তৈরী করেন যার বৃত্ত ছিল রৌপ্যের এবং মাঝখানে محمد رسول الله এভাবে অংকিত ছিল। উত্তম পন্থায় বাহাস ও আলোচনা উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, নাযরানের খৃষ্টান আলিমদের সাথে বাহাস, যার ফলে তারা পরবর্তীতে ইসলাম কবুল করেছিলেন। আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ভাবে ওয়াজ-নছীহত করতেন যাতে শ্রোতারা খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারে। তিনি স্পষ্টভাবে, ধীরে ধীরে এমনকি কোন কোন কথা তিনবারও বলতেন। হাদীস শরীফে রয়েছে,
ويتكلم بجوامع الكلم كلامه فضلا لا فضول ولا تقصير.
“এমন শব্দ প্রয়োগ করতেন, যা অল্প হলেও ব্যাপক অর্থবোধক। একটি কথা অপরটি থেকে পৃথক থাকত। বক্তব্যে অপ্রয়োজনীয় বিষয় স্থান পেতনা, আবার প্রয়োজনের চেয়ে কমও হতো না।” ওয়াজ-নছীহতের ব্যাপারে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষা হল কৃত্রিমতা ও ছন্দ রচনা বর্জন করা এবং ওয়াজ-নছীহতের প্রতি মানুষকে বিতৃষ্ণা না করা। ওয়াজকারীর জন্য কুরআন শরীফের নীচের তিনটি আয়াতের উপর আমল থাকা জরুরী।
اتامرون الناس بالبر ةتنسون انفسكم
“তোমরা কি মানুষকে সৎকাজের উপদেশ দাও এবং নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও।” (সূরা বাক্বারা/৪৮)
لم تقولون ما لاتفعلون.
“তোমরা নিজেরা যা করনা, তা অপরকে করতে বল কেন?” (সূরা ছফ/২)
ما اريد ان اخالفكم الى ما انهكم عنه.
“আমি চাইনা, যেসব মন্দ কাজ করতে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করি, সেগুলো করার জন্য নিজে এগিয়ে যাই।” (সূরা হুদ/৮৮)