-পীরে কামিল, হাফিয, ক্বারী, মুফতী, আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মুহম্মদ শামসুদ্দোহা
ما كان اه ليطلعكم على الغيب ولكن الله يجتبى من رسله من يشاء فامنوا بالله ورسله وان تؤمنوا وتتقوا فلكم اجر عظيم.
তরজমাঃ অদৃশ্য সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা আল্লাহ্ পাক-এর কাজ নয়, তবে আল্লাহ্ পাক তাঁর রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের মধ্যে যাঁকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল আলাইহিমুস্ সালামকে বিশ্বাস কর। তোমরা বিশ্বাস করলে ও সাবধান হয়ে চললে তোমাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার।” (সূরা আলে ইমরান/১৭৯)
শানে নুযূলঃ একবার আখিরী রসূল, ইমামুল মুরসালীন, উম্মী (অক্ষরজ্ঞানের অমুখাপেক্ষী) নবী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, “যেভাবে সাইয়্যিদুনা হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর কাছে সমস্ত রূহ পেশ করা হয়েছিলো তেমনি সবকিছু সৃষ্টির পূর্বে আমার সম্মুখেও আমার সমস্ত উম্মত (উম্মতে দাওয়াত)কে আপনাপন চেহারায় উপস্থিত করা হয়েছিলো। আমি সকলের পরিচয় জেনে নিয়েছি। এমনকি কে আমার উপর ঈমান আনবে, কে আনবেনা তাও আমাকে জানানো হয়েছে।” তাঁর একথা মুবারক শুনে মুনাফিক গোষ্ঠী উপহাস করে বলতে লাগলো যে, মুহম্মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাবী করেছেন যে, যারা এখনো জন্মলাভ করেনি তাদের মধ্যে কারা ঈমানদার হবে, কারা হবে না সে বিষয় তিনি বলে দিতে পারেন। অথচ আমরা তাঁর সাথে থাকি বাহ্যিকভাবে মুসলমান হয়ে, ঈমানদার সেজে, অন্তরে কুফরী গোপন করে ভন্ডামী করছি তিনি আমাদেরকেই চিনতে পারেননি!
মুনাফিকদের এই কথোপকথনের সংবাদ শুনে মাযবায়িল ইল্মি ওয়াল হিকাম, সাইয়্যিদুল আরবে ওয়াল আজম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বর শরীফে দন্ডায়মান হলেন। আল্লাহ্ পাক-এর হামদ ও ছানা বর্ণনা করলেন। তারপর বললেন, “তারা আমার জ্ঞান সম্পর্কে সন্দিহান। তোমরা এখন ক্বিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিতব্য যে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করতে পার, আমি জবাব দিতে পারব।” সাইয়্যিদুনা হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে হুযাফাহ্ সাহসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দাঁড়ালেন। প্রশ্ন করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা কে? রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, হুযাফাহ্। সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়া রসূলুল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমরা আল্লাহ্ পাককে আমাদের প্রভু পালনকর্তা মেনে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা ইসলামের অনুসারী হয়ে, কুরআন শরীফকে বিশ্বাস করে এবং আপনাকে নবী ও রসূল হিসেবে পেয়ে পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্ত। আপনি ক্ষমাপ্রাপ্ত, আমাদেরকেও ক্ষমা করে দিন।” হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, “তোমরা কি করে এসেছ? সত্যের দিকে কি প্রত্যাবর্তনকারী হয়েছ?” মিম্বর শরীফ থেকে নেমে এলেন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তখন এই আয়াত শরীফ নাযিল হয়। তাশরীহ্ঃ আল্লাহ পাক জাল্লা জালালুহু-এর কুদরতী নিয়ম এই যে, তিনি মানুষের মনের ঐকান্তিকতা ও কপটতার চিত্র নিখুঁতভাবে অনুধাবনের জন্য নবী ও ওলী আল্লাহ্দের মুনাওওয়ার অন্তর ও ফিরাসাতকে মনোনীত করেন।
যেমন, হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে,
اتقوا عن فراست المؤمن فانه ينظر بنور الله.
অর্থাৎ- “তোমরা কামিল মু’মিনের অন্তর্দৃষ্টিকে ভয় কর। কারণ তিনি আল্লাহ্ পাক প্রদত্ত নূর দিয়ে দেখেন।”
আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন,
علماء امتى كانبياء بنى اسرائيل.
অর্থাৎ- “আমার উম্মতের সত্যবাদী আলিমগণ বণী ইসরাঈলের পয়গম্বর তুল্য।”
এ স্থলে অবশ্য, অবশ্যই আলিমের অর্থ সাধারণ আলিম নয়; তাহলে হাদীস শরীফের মর্ম বিপরীত হয়ে যায়। কেননা, এ জামানার অনেক নামধারী আলিমই অপকর্মে লিপ্ত। তারা কি করে পয়গম্বরের তুল্য হবে? সুতরাং এই আলিম অর্থে আধ্যাত্মিক আলিম অর্থাৎ আ’রিফবিল্লাহ্, যাদের যাহির ও বাতিন পূর্ণ নূরানী ও আলোকিত যা ইলহাম ধারণের উপযোগী। হিজরী শতকের পরিক্রমায় মানুষের মাঝে ফিৎনা-ফাসাদ ব্যাপক হয়ে পড়ে। তখন বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ পূর্ণ ইলম সম্পন্ন কোন এক বুযূর্গের আবির্ভাব হয়। যার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় উক্ত তমসা বিদূরীত হয়ে ইসলাম নতুন আলোকপ্রাপ্ত ও পুনর্জীবিত হয়। উক্ত মহান ব্যক্তিকেই ‘মুজাদ্দিদে মিয়াত’ বা শতকের সংস্কারক বলা হয়।
বলা বাহুল্য যে, মুজাদ্দিদ তো তাঁকেই বলে, যিনি এতটা রূহানী ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে থাকেন, এতটা ঈলমে গায়েবে সমৃদ্ধ হয়ে থাকেন যে, যুগের মুনাফিকদেরকে সোজাসুজি বলে দিতে সক্ষম যে, “তোমার ঈমানে খালাল বা ত্রুটি আছে, সাবধান হও! তওবা কর।” যেমন,
مطلع على الغيب.
হওয়ার জন্যই আখিরী রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের অবস্থা, প্রত্যেকের ঈমান বা কুফরী, ঈমানদারদের ঈমানের শ্রেণী বিভাগ, কাফিরদের কুফরীর ধাপসমূহের খবর জানতে পারতেন। কিন্তু বিশেষ মুসলিহাত বা বিচক্ষণতার কারণে মুখ খুলতেন না। যেমন, দেখুন, তিনি সু-সংবাদ দিয়েছেন,
১. সাইয়্যিদুনা হযরত হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং সাইয়্যিদুনা হযরত হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জান্নাতী যুবকদের সর্দার।
২. সাইয়্যিদাতুনা হযরত ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা জান্নাতী মহিলাদের প্রধান।
৩. সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীকে আকবর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ফারুকে আযম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জান্নাতে আমার সাথী থাকবেন ইত্যাদি।
অর্থাৎ রোগীর দেহের ভিতর রোগ যন্ত্রণার খবর চিকিৎসক যেমন তার চিকিৎসা জ্ঞানের জোরে রোগীর হাতের শিরা টিপে বলে দেন তেমনি ওহীর জ্ঞান ও প্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞানের জোরে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোটা দুনিয়ার মানুষের ঈমানী শিরার উপর তাঁর হাত মুবারক রেখে সব বলে দেন।
আয়াতে কারীমায় উল্লিখিত
ولكن الله يجتبى من رسله
অংশ দ্বারা ঐ অতলান্তিক জ্ঞানের গভীরতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বৈকি। অতএব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞান প্রদানকে অস্বীকার করা বা বিদ্রুপ করা মূলতঃ মুনাফিকদের স্বভাব, যা শানে নুযূল দ্বারা বুঝা যাচ্ছে।
কিন্তু উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাসহ সকল হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম-এর আক্বীদা এই ছিলো যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে আসমান-যমীনের কোন জিনিসই গোপন ছিলোনা। তাছাড়া বিবেকও বলছে যে, যে চোখ মুবারক স্বয়ং খালিক্ব আল্লাহ্ পাককে দেখে নিয়েছেন সেই চোখ মুবারক মাখলুককে দেখতে সক্ষম হবেনা কেন? সুতরাং একবার সাইয়্যিদাতুনা হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আরজ করলেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এমন কোন ব্যক্তি আছে কি যার নেকীসমূহ আসমানের অগণন তারকারাজীর সমান হয়েছে?” সাথে সাথে নবীয়ে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, তিনি হলেন, হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।”
বুঝা গেল যে, আসমানের তারকারাজীর সাথে সম্পর্কিত প্রশ্ন তাঁকেই করা হয়েছে যিনি তাঁর খবর ও জ্ঞান রাখেন। তবে একথা সত্য যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক গায়েবী বিষয়ে অবহিত হওয়া, ভবিষ্যতের এবং অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে তথ্য প্রদান তাঁর উজ্জ্বলতার মুযিজা সমূহের অন্যতম। সত্ত্বাগতভাবে ইলমে গায়েব অবশ্য একমাত্র আলিমুল গাইব ওয়াশ্শাহাদাহ্ আল্লাহ্ পাক-এর জন্যই নির্দিষ্ট। তিনিই একমাত্র আল্লামুল গুয়ূব। আর শাফিয়ে মাহ্শার, সাকিয়ে কাওছার, ত্ববীয়ে ছফর, নূরে আবছার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যবান মুবারক থেকে এবং তাঁর কোন কোন ওয়ারিস বা প্রকৃত অনুসারীগণের কাছ থেকে যে বিস্ময়কর আগাম ইলমসমূহ প্রকাশ পেয়েছে চাই ওহীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকুক অথবা ইলহামের মাধ্যমে। সে সম্পর্কে আক্বীদা বিশুদ্ধ রাখার জন্য হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা ইরশাদ করেছেন তার উপর ঈমান রাখাই যথেষ্ট। তিনি বলেছেন,
والله انى لا اعلم الا ما علمنى ربى.
অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক-এর শপথ! আমি নিজে থেকে কিছু জানি না। তবে আমার প্রতিপালক রব আমাকে জানিয়ে দেন।” অতএব, বলতেই হয় যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গায়েবী ইল্ম আল্লাহ্ পাক-এর মহান দান অর্থাৎ
مطلع على الغيب.
তাঁর গায়েবী ইলমের বিষয়টি সর্বজন বিদিত। গায়েবী সংবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে। তন্মধ্যে মশহুর একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন সাইয়্যিদুনা হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তিনি বলেছেন, রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন খুৎবা প্রদান করলেন। সেই খুৎবায় তিনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিতব্য সকল খুঁটি-নাটি বিষয় জানিয়ে দিলেন। ঐ সব কথা কারো কারো স্মরণে আছে, আবার কেউ ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়ার বিষয়গুলো এ রকম। যেমন, সাধারণভাবে আমরা কোন বিষয় ভুলে যাই। আবার সেই বিষয়ের মুখোমুখী হলে দ্রুত তা স্মরণ হয়ে যায়। যেমন, কেউ কিছুকাল অনুপস্থিত থাকলে তার কথা ভুলে যাই। আবার সামনে এলে দ্রুত চিনতে পারি। সাইয়্যিদুনা হযরত হুযায়ফা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি এরূপ মনে করি না যে, আমার সাথীগণ জেনে- শুনে, বুঝে স্বেচ্ছায় ভুলে গেছেন বরং আল্লাহ্ পাক-এর কছম! তাঁদেরকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্বিয়ামত পর্যন্ত দ্বীনের মধ্যে যেসব ফিৎনা দেখা দিবে তার পরিস্কার বিষয় বর্ণনা প্রদান করেছেন। এমনকি ফিৎনাবাজদের নাম, পিতার নাম এবং বাসস্থানের নাম পর্যন্ত বলে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, প্রাথমিক অবস্থায় ফিৎনাবাজদের সংখ্যা তিন’শ পর্যন্ত হবে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের অনুসারীদের সংখ্যা হবে অনেক। সাইয়্যিদুনা হযরত আবু যর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রকম সব বিষয়েরই আলোচনা করেছেন। এমনকি আকাশের শুন্যে যে পাখিটি পাখা মেলে উড়ে যায় তার সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়েছেন। দাজ্জালের আলোচনায় সাইয়্যিদুনা ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি সাইয়্যিদুনা হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার সাইয়্যিদুনা হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মা’কে বলেছিলেন, তোমার গর্ভে পুত্র সন্তান রয়েছে। সে জন্মগ্রহণ করলে তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। শিশু জন্ম নিলে তাঁর মহান খিদমতে আনা হলো। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন ঐ শিশুর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইক্বামত দিলেন এবং মুখের লালা মুবারক শিশুর মুথে (তাহনীক) দিলেন। তারপর তার নাম রাখলেন আব্দুল্লাহ্ এবং বললেন, এ শিশু আবু খোলাফা হবে।
আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্রা স্ত্রীগণের একজন সম্পর্কে বলেছিলেন যে, তিনি যখন মক্কা শরীফ ও বসরার মধ্যবর্তী ‘হাওয়াব’ নামক স্থানে পৌঁছবেন তখন কুকুরদের আওয়াজ করে কিছু বলতে শুনবেন এবং সেখানে নিহতদের স্তুপ হয়ে যাবে।
মূলতঃ জঙ্গে জামালের সময় সাইয়্যিদাতুনা আম্মাজান হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা যখন মক্কা শরীফ থেকে বসরার দিকে যাচ্ছিলেন তখন উক্ত স্থানে ঐ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো।
সাইয়্যিদুনা হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমার ব্যাপারে লোকেরা আক্ষেপ করবে আর তুমিও লোকদের তৎপরতায় আক্ষেপ করবে।” কট্টর জালিম হাজ্জাজ ইবনে ইউছুফ-এর নির্দেশে তাঁর সাথে সে রকম আচরণই করা হয়েছিলো। সাইয়্যিদুনা হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, তোমার দৃষ্টি শক্তিকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং ক্বিয়ামতের দিন ফিরিয়ে দেয়া হবে।
ক্বরনা-ন্ নামক এক ব্যক্তি সম্পর্কে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মন্তব্য করলেন, সে জাহান্নামী। ফলে সে লোকটি এক যুদ্ধে বীরত্ব দেখানো সত্ত্বেও পরিশেষে দেখা গেল, সে যখমের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিজের তলোয়ার দিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিলো। লোকেরা এ সংবাদ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন,
اشهد ان لا اله الا الله وانى رسول الله.
অর্থঃ- “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ পাক ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই এবং অবশ্যই আমি আল্লাহ্ পাক-এর রসূল।”
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
لاتسبوا قريشا فان عالمها يملا طباق الارض علما.
অর্থঃ- “তোমরা কুরাঈশদের গালি দিওনা। কেননা, কুরাঈশ বংশের একজন আলিম সমস্ত জাহানকে ইলমে ভরপুর করে দিবেন। ইমাম আহমদ প্রমূখ আলিমগণ মনে করেন, উক্ত আলিম বলতে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম শাফী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে বুঝানো হয়েছে।”
যুরকানী সাইয়্যিদুনা হযরত আনাছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে একখানা হাদীস শরীফ বর্ণনা করেছেন, যাতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
يكون فى امتى رجل يقال له ابو حنيفة هو سراج امتى.
অর্থঃ- “আমার উম্মতের মধ্যে এক ব্যক্তির নাম হবে আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহি আলাইহি।) তিনি আমার উম্মতের আলোকবর্তিকা হবেন।” আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছেন, উম্মতের মধ্যে নবীনরা প্রবীণদেরকে মন্দ বলবে। আধুনিকরা পূর্ববর্তীগণের সমালোচনা করবে।” রাফিজীরা সেই রকমই করে থাকে। তিনি আরো বলেছেন, “দ্বীনের সাহায্যকারী কমে যাবে। আটার মধ্যে নূনের পরিমাণ যেমন কম হয় তেমনি দ্বীনদারের সংখ্যাও কমে যাবে। উম্মতের মধ্যে সর্বদাই বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা বিরাজ করবে। এ বিভেদ ও ফেরক্বাবাজী থেকে কোন দলই বাঁচতে পারবে না। শাসকরা শাসন ক্ষমতা দখল করে নেবে। নিজেদের লোকদের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করবে, অন্যদের সাথে সেরূপ আচরণ করবে না। আখিরী যামানার (অর্থাৎ এক হাজার হিজরীর পর) মানুষ চূড়ান্ত সীমার নিকটবর্তী হবে। তারা আমার অনুসারী আলিমদেরকে প্রাণে মেরে ফেলবে, চোর-ডাকাতদের যেভাবে মেরে ফেলে। তখন মুনাফিককে বলা হবে আলিম, আর আলিমকে বলা হবে মুনাফিক। তখন পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে। নারীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনকি পঞ্চাশজন নারীর দায়িত্বভার একজন পুরুষের উপর ন্যস্ত হবে। সেই সময় সম্পদ কমে যাবে। ফিৎনা বৃদ্ধি পাবে। সে সময়ের (অধিকাংশ) আলিম (নামধারী)রা হবে আকাশের নীচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক। কারণ, তাদের দ্বারাই নিত্য নতুন ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি হবে। তবে তাদের সৃষ্টি ফিৎনায় তারাই জড়িয়ে পড়বে। নিজেরা গোমরাহ্ হবে অপরকেও গোমরাহ্ করবে। তখন হারামকে ব্যাপকভাবে অনুশীলন করা হবে। নতুন নতুন নাম পরিবর্তন করে, হিকমত বা কৌশল হিসেবে কালচার বা শিল্পকলার ছদ্মাবরণে হারামের প্রসার ঘটে।”
সূরা জ্বীনের শেষের দিকেও ইলমে গায়েবের আলোচনা আছে। সেখানেও দুটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। একটি হলো, আল্লাহ্ পাক-এর খাছ বা বিশেষ গায়েব। আর দ্বিতীয়টি হলো গায়েব সম্পর্কে অন্য কাউকে জ্ঞাত করানো। গায়েব মূলতঃ দু’প্রকার। এক প্রকার হলো, যা দলীল দ্বারা সমৃদ্ধ। যেমন, আল্লাহ্ পাক-এর অস্তিত্ব ও তাঁর ছিফত বা গুণাবলী। দ্বিতীয় প্রকার যা দলীল দ্বারাও জানা সম্ভব নয়। প্রথম প্রকারের গায়েবী ইলম নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ ব্যতীত অন্যরাও জানতে পারেন।
যেমন, আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেছেন,
يؤمنون بالغيب.
অর্থঃ- “তারা গায়েবের উপর ঈমান এনেছে।” আর দ্বিতীয় প্রকার গায়েব যাকে غيبه স্বীয় গায়েব বলা হয়েছে তা রসূলগণ ব্যতীত আর কাউকে প্রদান করা হবে না।
অতএব, কুরআন শরীফের যে আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক ব্যতীত কেউ গায়েব জানে না বলা হয়েছে, সেখানে বুঝতে হবে যে, তা মূল এবং জাত বা সত্ত্বাগত ইলমের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পক্ষান্তরে যেখানে (আমাদের আলোচ্য উদ্বৃতাংশ ও সূরা জ্বীনে ইত্যাদি) ইলমে জাত বা সত্ত্বাগত ইলমকে রহিত করে অন্যকে ইত্তিলা বা অবগত করানো হচ্ছে। সেখানে আল্লাহ্ পাক ছাড়াও আল্লাহ্ পাক খাছ করে যাঁকে তাঁর বিশেষ ইলমে গায়েব প্রদান করেছেন তিনিও শামিল হবেন। এরূপ উদাহরণ কুরআন শরীফে অনেক আছে। যেমন, আল্লাহ্ পাক বলেছেন,
ان الحكم الا لله.
অর্থাৎ- “আল্লাহ্ পাক ব্যতীত আর কারও হুকুম নেই।” আবার অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
فابعثوا حكما من اهله وحكما من اهلها.
অর্থাৎ- “যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয় তখন তা সমাধানের জন্য তোমরা স্বামীর পরিবার হতে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার হতে একজন হাকিম নিযুক্ত কর।”
আরোও ইরশাদ হয়েছে,
ان العزة لله جميعا.
অথঃ- “সমস্ত ইজ্জত-সম্মান একমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর জন্য।”
আবার এও ইরশাদ হয়েছে,
ولله العزة ولرسوله وللمؤمنين.
অর্থঃ- “ইজ্জত-সম্মান আল্লাহ্ পাক-এর জন্য। তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য এবং মু’মিনদের জন্য।” (সূরা মুনাফিকুন/৮) অতএব, এ আয়াত শরীফ গুলোর অর্থ এই যে, হুকুমত এবং ইজ্জত সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর জন্য। কিন্তু আল্লাহ্ পাক প্রদান করার কারণে মুসলমানগণ হুকমতও লাভ করেছেন, মান-সম্মানও অর্জন করেছেন।
বলা বাহুল্য যে, এভাবে ইলমে গায়েবও। তবে কি পরিমাণ ইলমে গায়েব আল্লাহ্ পাক তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদান করেছেন তা তিনিই জানেন। আর যিনি গ্রহণ করেছেন তিনিও জানেন বৈকি। তবে আমরা যা বুঝি তা হলো, লওহে মাহ্ফুজকে উম্মুল কিতাব বলা হয়। সেখানে সমস্ত জ্ঞান লিপিবদ্ধ আছে। আর লওহে মাহ্ফুজ কোথায় আছে তা খুঁজাখুঁজির না করে বরং যিনি লওহে মাহ্ফুজের সৃষ্টিকর্তা সেই মহিয়ান, গরিয়ান আল্লাহ্ পাক কোথায় আছেন তা যদি জানা যায়। তাহলে লওহে মাহ্ফুজের খবর এমনিতেই পাওয়া যাবে। আল্লাহ্ পাক তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে বলেন, انك باعيننا.অর্থঃ- “হে বন্ধু আমার! নিশ্চয়ই আপনি আমার কুদরতি চোখের সামনেই রয়েছেন।” (সূরা তুর/৪৮) এবার আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, রহমতুল্লিল আলামীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জ্ঞানের পরিধি পরিমাপ করুন। কাছিদায়ে বুরদায় যথার্থই আশেকে রসূল কবি লিখেছেন,
ومن علومك علم اللوح والقلم.
অর্থঃ- “লওহে এবং কলমের ইলম ও আপনার ইল্মের অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। হে মনের রাজা, চিরতাজা আঁকা মাওলা রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার।”
তাফসীরুল কুরআন: উলামায়ে ‘ছূ’ বা ইলমধারী মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিণতি