হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার
শরীফে অবস্থানের আদব
একমাত্র আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খালিছ সন্তুষ্টি রেযামন্দি হাছিলের উদ্দেশ্যে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহ্বত ইখতিয়ার করবে কিংবা তাঁর দরবার শরীফে অবস্থান করবে। দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্য তার মধ্যে রাখবেনা।
হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
ان رجلا زار اخاله فى قرية اخرى فارصد الله له على مدرجته ملكا قال اين تريد قال اريد اخالى فى هذه القرية قال هل لك عليه من نعمة تربها قال لاغير انى احببته فى الله قال فانى رسول الله اليك بان الله قداحبك كما احببته فيه.
অর্থঃ- “আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন কোন ব্যক্তি তার (মুসলমান) ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে অন্য গ্রাম বা দূরবর্তী দেশের অভিমূখে বের হয় তখন আল্লাহ্ পাক তাকে (সু-সংবাদ প্রদানের জন্য) তার গমন পথে একজন অপেক্ষমান ফেরেশ্তা নিয়োগ করেন। (লোকটি উক্ত ফেরেশ্তার নিকটবর্তী হলে) উক্ত ফেরেশ্তা তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা করছ? সে জাওয়াবে বলে, অমুক গ্রামে আমার একজন (মুসলমান) ভাই আছেন, তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য যাচ্ছি। ফেরেশ্তা জিজ্ঞেস করেন, তার নিকট তোমার দুনিয়াবী কোন ফায়দা লাভের উদ্দেশ্য আছে কি? তখন সে বলে, না, বরং আমি তাকে একমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টির জন্য মুহব্বত করি (তাই তার সাক্ষাতে যাচ্ছি)। তখন উক্ত ফেরেশ্তা তার উদ্দেশ্যে বলেন, আমি আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ হতে তোমাকে এই সু-সংবাদ দেয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি যে, আল্লাহ্ পাক তোমাকে অনুরূপ মুহব্বত করেন যেরূপ তুমি আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টির জন্য তাকে মুহব্বত কর। (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ/৪২৫)
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ পাক এবং আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি-রেযামন্দী হাছিলের জন্য সাধারণ কোন মুসলমান ভাইয়ের সাথে তায়াল্লুক, নিসবত (সম্পর্ক) রাখলে যদি এরূপ সন্তুষ্টি-রেযামন্দী, মর্যাদা-মর্তবার অধিকারী হয় তাহলে আল্লাহ্ পাক-এর খালিছ বান্দা যারা আউলিয়া-ই-কিরাম তাঁদের ছোহ্বত ইখতিয়ার করলে, তাঁদের সাথে তায়াল্লুক, নিসবত (সম্পর্ক) স্থাপন করলে আল্লাহ্ পাক এবং আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কিরূপ সন্তুষ্টি-রেযামন্দী হাছিল হবে, সেই ব্যক্তির মর্যাদা-মর্তবা কতটুকু অর্জিত হবে তা সহজেই অনুমেয়।
হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, একদা আমি আখিরী নবী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছিলাম, তখন তিনি বললেন,
ان فى الجنة لعمدا من ياقوت عليها غرف من زبرجد لها ابواب مفتحة تضئ كما يضئ الكوكب الدرى فقالوا يا رسول الله صلى الله عليه وسلم من يسكنها قال المتحابون فى الله والمتجالسون فى الله والمتلاقون فى الله.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই জান্নাতের যবরজদের (মূল্যবান পাথর) অনেক বালাখানা আছে যার স্তম্ভসমূহ হচ্ছে ইয়াকুত পাথরের। তার দরজাসমূহ সর্বদা খোলা যা উজ্জ্বল তারকারাজীর মত চকচক করছে। হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ্, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তাতে কারা বাস করবেন? তিনি বললেন, ঐ সমস্ত লোক সেখানে বাস করবেন যারা একমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টির জন্যে পরস্পর মুহব্বত রাখে, আল্লাহ্ পাক-এর মুহব্বতে একত্রে উপবেশন করে এবং আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টির জন্যে পরস্পর সাক্ষাৎ করে।”(শুয়াবুল ঈমান, মিশকাত/৪২৭) উল্লেখ্য, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মক্কা শরীফে অবস্থান করাকালীন সময়ে হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের পরস্পর সাক্ষাৎ-মুলাকাত এবং কুশলাদী আদান-প্রদান হতো “দারুল আরকামে”। দরবারে নববী শরীফকে কেন্দ্র করে এই জমায়েত হতো। কেননা তখন দরবারে নববী শরীফ ছিল “দারুল আরকাম” যা “দারুল ইসলাম” নামেও প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ দারুল আরকাম ছিল আরকাম ইবনে আবদে মান্নাফ আল মাখযুমী রদ্বিয়াল্লাহ্ তায়ালা আনহু-এর বাড়ী। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের প্রথম দিকে এ বাড়ী থেকে রিসালতের সকল প্রকার কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ প্রত্যহ সেখানে হাজির হতেন এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফয়েজ, তাওয়াজ্জুহ্ হাছিল করতেন। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে হিজরত করার পর দরবারে নববী প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদে নববী শরীফে। সেখানে তিনি আজও রফীকে আ’লার সাথে পরম দীদারে মশগুল। হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ প্রতিনিয়ত সেই দরবারে নববী শরীফে হাজির হতেন। সমস্ত উম্মাহ্কে আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মতে ও পথে পরিচালনা করার ফয়েজ, তাওয়াজ্জুহ এবং জয্বা বা প্রেরণা দান করা হত।
আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্দা করার পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন হক্কানী উলামা-ই-কিরাম তথা আউলিয়া-ই-কিরাম। ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ্ এবং জয্বা বা প্রেরণা দানের উত্তরাধিকারী হন তাঁরা। সুতরাং এ কারণে উত্তরকালে তাঁদের দরবার শরীফকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আল্লাহ্ পাক-এর খালিছ বান্দা তথা ছূফীয়ানে কিরামগণের মজলিস। আর কিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের মাধ্যমেই ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ্ এবং মা’রিফত-মুহব্বত হাছিলের জয্বা বা অনুপ্রেরণা পেয়ে উম্মাহ্ দ্বীনের ছহীহ্ ও সঠিক দিক নির্দেশনা পাবে, হিদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, গোমরাহী থেকে হিফাজত হবে এবং হক্ব-নাহক্বের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারবে। কাজেই হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ যেমন খালিছভাবে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টির জন্য পরস্পর পরস্পরকে মুহব্বত করতেন সেই মুহব্বতের ধারা হযরত আউলিয়া-ই-কিরামগণের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে তারাও লাভ করবেন সীমাহীন মর্যাদা-মর্তবা। আর তাঁদের প্রতি ইঙ্গিত করেই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
ان من عباد الله لاناسا ماهم بانبياء ولاشهداء يغبطهم الانبياء والشهداء يوم القيامة بمكانهم من الله قالوا يا رسول الله صلى الله عليه وسلم تخبرنا من هم قال هم تحابوا فى الله بروح الله على غير ارحام بينهم ولا اموال يتعاطونها فوالله ان وجوههم لنور وانهم لعلى نور لايخافون اذا خاف الناس ولايحزنون اذا حزن الناس.
অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক-এর বান্দাগণের মধ্যে এমন কতিপয় খাছ লোক (আউলিয়া-ই-কিরাম) আছেন যাঁরা নবীও নন এবং শহীদও নন; কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তাঁদের মর্যাদা-মর্তবা, নৈকট্য প্রাপ্তি দেখে স্বয়ং আল্লাহ্ পাক-এর নবী আলাইহিমুস্ সালাম এবং শহীদগণ পর্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হবেন। হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাদেরকে তাঁদের পরিচয় দান করুন। তিনি বলেন, তাঁরা এমন এক সম্প্রদায় যাঁরা শুধুমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে মুহব্বত করেন। অথচ তাঁদের মধ্যে কোন প্রকারের আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। এবং উনাদের মাঝে ধন-সম্পদের লেনদেনও নেই। অর্থাৎ পার্থিব কোন উদ্দেশ্যে নেই। মহান আল্লাহ পাক উনার কসম! উনাদের চেহারা হবে নূরে নূরান্বিত এবং উনারা উপবিষ্ট হবেন নূরের উপর। উনারা তখনও কোন প্রকার ভীত-সন্ত্রস্ত হবেননা যখন সকল মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হবে। আর উনারা দুশ্চিন্তাগ্রস্থও হবেননা যখন সকল মানুষ দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে।
অত:পর তিনি এই পবিত্র আয়াত শরীফ পাঠ করলেন যে,
الا ان اولياء الله لا خوف عليهم ولاهم يحزنون.
“নিশ্চয়ই যারা মহান আল্লাহ পাক উনার বন্ধু উনাদের কোন ভয় নেই এবং উনারা দুশ্চিন্তাগ্রস্থও হবেন না।” (মিশকাত শরীফ/৪২৬)
অর্থাৎ আউওলিয়ায়ে কিরামগণ উনাদের ছোহবত বা সাহচর্য হচ্ছে আহলুল্লাহ বা আল্লাহওয়ালাগণ উনাদের বিশেষ আমল। যার মাধ্যমে সীমাহীন মর্যাদা-মর্তবা লাভ হয়ে থাকে। তবে তা হতে হবে খালিছভাবে মহান আল্লাহ পাক এবং মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি-রেযামন্দী হাছিলের উদ্দেশ্যে।
ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৬)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৯)
হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৬১) বিশুদ্ধ নিয়ত এবং তার ফযীলত ও গুরুত্ব (৫)