ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬০)

সংখ্যা: ১১২তম সংখ্যা | বিভাগ:

      প্রসঙ্গঃ দৃঢ়ভাবে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর তরীক্বার অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য মাশায়িখগণের তরীক্বার প্রতি লক্ষ্য করবে না। (মাকতুবাত শরীফ)

          অদ্যবধি যত ছিলছিলার বিলুপ্তি ঘটেছে, গোমরাহী দেখা দিয়েছে তার সবগুলোর পিছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার তরীক্বার অনুসরণের অভাব। স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার তরীক্বার উপর ইস্তিকামত বা অবিচল না থাকার কারণে কত শত ছিলছিলার যে বিলুপ্তি ঘটেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। মুরীদ যতক্ষণ পর্যন্ত স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার তরীক্বার উপর ইস্তিকামত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত ছিলছিলার পূর্ববর্তী মাশায়িখ হতে বাতিনী নিয়ামত তথা ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ্ পেতে থাকে।

          পক্ষান্তরে যখন কেউ স্বীয় পীর ছাহেবের তরীক্বার অনুসরণ কিংবা আদর্শ বা নীতিমালা হতে সরে পড়ে তখনই বাতিনী নিয়ামতের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে পূর্ববর্তীগণ হতে প্রাপ্ত নিয়ামতের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়।

          সুতরাং স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার তরীক্বার অনুসরণের উপর যারা যত বেশী ফানা (বিলীন) হবে তাদের বাকা বা স্থায়ীত্ব তত বেশী হবে। অর্থাৎ তাদের দ্বারা হিদায়েতের পথ তত বেশী প্রসারিত হবে।

          উল্লেখ্য যে, ‘সূলুক’ (আল্লাহ্ পাক প্রাপ্তির পথ) হচ্ছে সমস্ত ইচ্ছা বা কামনা-বাসনাকে ফানা বা বিলীন করার নাম। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে,

السلوك الارادة للجل الفناء فان المريد من يفنى ارادته فى ارادة الشيخ فمن عمل برأيه امرا فهو ليش بمريد.

অর্থঃ- “সূলুক হচ্ছে সমস্ত ইরাদা বা ইচ্ছাকে ফানা (বিলীন) করার নাম। সুতরাং প্রকৃত মুরীদ ঐ ব্যক্তি যে তার ইরাদা বা ইচ্ছাকে স্বীয় পীর ছাহেবের ইরাদা বা ইচ্ছার নিকট ফানা (বিলীন) করে দেয়। সুতরাং যে ব্যক্তি স্বীয় ইচ্ছানুরূপ আমল করে সে ব্যক্তি মুরীদ হতে খারিজ হয়ে যায়।” (তাফসীরে রুহুল বয়ান-৪/৬২)

          সঙ্গতকারণে যারা স্বীয় পীর ছাহেবের তরীক্বার অনুসরণে ফানা হতে পারেনা তারা নফসের ধোকা, শয়তানের ষড়যন্ত্র হতে মুক্ত থাকতে পারেনা। তারা অপরাপর মাশায়িখগণের তরীক্বার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আর শয়তান সে তরীক্বার চাকচিক্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি খুব সুন্দর করে তার সামনে তুলে ধরে আর সে সেটাকে সঠিক মনে করতঃ সেদিকেই ধাবিত হয়। কিন্তু পরে সে পরিপূর্ণভাবে ঐ তরীক্বাও হাছিল করতে পারেনা। যা হাছিল করে তার সবটাই স্বীয় নফসানিয়ত বা প্রবৃত্তির দাসত্বে পরিণত হয়।

          পক্ষান্তরে স্বীয় পীর ছাহেব হতে ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ্ বন্ধ হওয়ার কারণে হিদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেনা। যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিনের সাধনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

          ইমামুল আলাম, জামিউ বাইনাল বাতিন ওয়াজ্ জাহির, ফরীদুল আওয়ান, কুতুবুজ্জামান, মাওলার রূম, শায়খ ইসমাঈল হাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,

فمن جاهد فى طريق الحق فقد سعى فى الحلق نفسه بزمرة الاولياء ومن اتبع الهوى فقد اجتهد فى الالتحاق بفرته الاعداء.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ পাক-এর রাস্তায় কোশেশ করে (আল্লাহ্ পাক-এর মারিফাত-মুহব্বতের প্রত্যাশি) তার উচিত আউলিয়া-ই-কিরামের মজলিস বা সান্নিধ্যের জন্য নিজেকে পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত করা। (তাঁদের আদর্শে আদর্শিত হওয়া) কেননা, যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে মূলতঃ সে শত্রুদলের সাথে মিলিত হওয়ারই কোশেশ (চেষ্টা) করে।” (তাফসীরে রুহুল বয়ান- ৪/৬২)

          সুতরাং স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার তরীক্বার অনুসরণ কিংবা পীর ছাহেব ক্বিবলার অনুমোদন ব্যতীত স্বীয় ইচ্ছানুরূপ যত উত্তম এবং যত বেশীই আমল করা হোক না কেন তার দ্বারা আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বতের আশা করা সুদূর পরাহত।

          স্মর্তব্য যে, আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বত হাছিলের জন্য প্রত্যেক তরীক্বার একটি নির্দিষ্ট মাধ্যম তথা কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। প্রত্যেক সালিক বা মুরীদের সে অনুযায়ী আমল করা কর্তব্য। পূর্ববর্তী সকল আউলিয়া-ই-কিরামের আমল সেরূপই ছিলো।

          ইমামে রব্বানী, আফজালুল আউলিয়া, শাইখুশ শুয়ূখ, মুজতাহিদ ফিল মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন, গাউসে সাকালাইন হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন বিশিষ্ট খলীফা হযরত মির্জা হোসামুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে এক পত্রে লিখেন, ‘আপনি সঙ্গীত শুনতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন, যা মীলাদ শরীফে পাঠ করা হয়। অর্থাৎ সঙ্গীতসহ মীলাদ শরীফ পাঠ নিষেধ করেছেন। (উল্লেখ্য যে, এটা হচ্ছে ঐসব তথাকথিত মীলাদ অনুষ্ঠান যাতে ঢোল, তবলা, হারমনি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে হামদ, নাত, কাছিদা পাঠ করা হয়।)

          কিন্তু ভাই মীর মুহম্মদ নো’মান এবং অন্যান্য বন্ধুগণ স্বপ্নে দেখেছেন যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ মীলাদ মাহ্ফিলের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। অতএব, তাদের জন্য উক্ত মীলাদ শরীফের মাহ্ফিল পরিত্যাগ করা দুস্কর।’

          ইমামে রব্বানী, গাউসে সাকালাইন, আফজালুল আউলিয়া, হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার জাওয়াবে লিখেন, “হে স্নেহাস্পদ! যদি স্বপ্নের কোন মূল্য থাকতো তবে মুরীদদের জন্য পীর ছাহেবের কোন আবশ্যক হতোনা এবং কোন মুরীদকে কোন তরীক্বত গ্রহণের প্রয়োজন ছিলোনা। যেহেতু প্রত্যেক মুরীদ স্বীয় স্বপ্নানুযায়ী আমল করত এবং তদানুরূপ জীবিকা নির্বাহ করত। উক্ত স্বপ্নাদি তার পীর ছাহেবের তরীক্বার অনুকূল হোক বা না হোক এবং তাতে পীর ছাহেব ক্বিবলা সন্তুষ্ট থাকুন বা না থাকুন। আর এরূপ হলে পীর-মুরীদি ছিলছিলার মধ্যে বিরাট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো এবং প্রত্যেক নির্বোধ, মুর্খ লোকেরা স্বয়ং স্বাধীন হতো।

          আর প্রকৃত মুরীদ ঐ ব্যক্তি যে স্বীয় পীর ছাহেবের বর্তমানে শত-সহস্র স্বপ্নের মূল্য প্রদান করেনা এবং সরল চিত্ত ত্বলিব বা মুরীদ ঐ ব্যক্তি যে তার পীর ছাহেবের উপস্থিতি সৌভাগ্য লাভ করলে স্বপ্নাদিকে মূল্যহীন বলে জানে ও তৎপ্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করেনা।

          জেনে রাখা আবশ্যক, শয়তান লয়ীন আমাদের পরম শত্রু। শেষ মর্তবায় উপনীত ব্যক্তিগণও তার চক্রান্ত হতে নিশ্চিন্ত নন। বরং সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত। প্রাথমিক বা মধ্যবর্তী মর্তবায় উন্নীত ব্যক্তিগণ সম্পর্কে আর কি বলব! অবশ্য মুন্তাহী বা শেষ মর্তবায় উপণিত ব্যক্তিগণ শয়তানে মকর বা ষড়যন্ত্র হতে মাহ্ফুজ বা সুরক্ষিত কেননা,

ومن شرط الولى ان يكون محفوظ كما ان من شرط النبى ان يكون معصوما.

অর্থঃ- “নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের যেমন মা’ছূম বা নিস্পাপ হওয়া শর্ত তেমনি ‘ওলী’গণের মাহ্ফুজ বা সংরক্ষিত হওয়া শর্ত।” (সিরাজুত্ ত্বলিবীন শরহে মিনহাজিল আবেদীন- ১/১৬)

          কিন্তু প্রাথমিক ও মধ্যবর্তীগণ তদ্রুপ নয়। অতএব, তাদের স্বপ্ন নির্ভরযোগ্য নয় এবং শয়তানের চক্রান্ত হতে মাহ্ফুজ বা সুরক্ষিত নয়। তিনি আরো বলেন, এটাও হতে পারে যে, হামদ, না’ত, কাছিদা পাঠক এবং শ্রোতাদের অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস যে প্রশংসাকারীগণের প্রতি প্রশংসিত ব্যক্তিগণ যেরূপ সন্তুষ্ট। তদ্রুপ এই কাজে তাদের প্রতি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সন্তুষ্ট। এই বিশ্বাস তাদের ধারণায় বদ্ধমূল হয়ে গেছে। সুতরাং হতে পারে যে, স্বপ্নে তাদের ধারণাস্থিত ঐ আকৃতিই তারা স্বপ্নে দেখেছে।

          অর্থাৎ আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন, নিজের চেহারা দেখায় তেমনি রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তারা নিজের আমল অনুযায়ী দেখেছে। তিনি আরো বলেন, স্বীয় তরীক্বার মুখালিফ বা বিরোধী বিধায় কঠোরভাবে নিষেধ করেছি। প্রত্যেক তরীক্বার একটি নির্দিষ্ট মতলব বা উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়ার পথ আছে, এই তরীক্বার মতলবে উপনীত হওয়া উক্ত কাজগুলো পরিত্যাগ করার উপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি এই তরীক্বার মতলব বা উদ্দেশ্যে পৌঁছার আশা রাখে তার উচিত, এটার মুখালিফ বা বিরোধীতা হতে বিরত থাকা এবং অন্য তরীক্বার মতলবের প্রতি লক্ষ্য না রাখা।

          কারণ, ইমামুদ্ দুনিয়া ফি ইল্মিল ফিক্বাহ্ ওয়াত্ তাছাউফ, মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ্ দ্বীন হযরত বাহাউদ্দীন নক্শবন্দ বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে, আমরা একাজ (সামা তথা হামদ, নাত, কাছীদা বিশেষ যার মধ্যে কোন প্রকার বাদ্যযন্ত্র থাকেনা) করিনা এবং এটার প্রতি ইন্কার বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করিনা। অর্থাৎ এটা আমাদের তরীক্বার খিলাফ বা বিরোধী। কাজেই আমরা করিনা এবং যখন অন্যান্য তরীক্বার বুযূর্গ মাশায়িখগণ করেন সেজন্য তা আমরা ইনকার বা দোষারোপ করিনা। কেননা, প্রত্যেক ব্যক্তির একটি লক্ষ্যস্থল আছে তার প্রতি তারা লক্ষ্য করে থাকে। (মাকতুবাত শরীফ)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬২)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৩)

পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৪)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৫)