ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৪)

সংখ্যা: ১০৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

          প্রসঙ্গঃ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খালিছ সন্তুষ্টি-রেযামন্দি পাওয়ার জন্যই স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে হাদিয়া বা নজরানা দিবে। (গত সংখ্যার পর)     ফক্বীহুল উম্মত হয়ে তিনি কিভাবে হিন্দু গাঁজাখোদের ব্যবসার উন্নতির জন্য তাবিজ দিলেন! এভাবে দীর্ঘ সাতদিন অতিবাহিত হলো। হিন্দু গাঁজাখোরের দল অনেক মিষ্টি হাদিয়া স্বরূপ নিয়ে উপস্থিত হলো। যা ফক্বীহুল উম্মত, শাইখুল ইসলাম, রঈসুল মুহাদ্দিসীন হযরত শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর খিদমতে পেশ করলো। সাথে সাথে তাঁর প্রদত্ত তাবিজটিও ফেরৎ দিলো। শায়খুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহি তাদেরকে কিছু না বলে হাদিয়াগুলো খানকা শরীফের এক পার্শ্বে রাখতে বললেন। গাঁজাখোরের দল তাঁর হুকুম যথাযথ পালন করতঃ চলে গেলো।   শাইখুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এরূপ অবস্থা দেখে খানকা শরীফে অবস্থানরত মুরীদ-মুতাকিদগণ আরো গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হলেন। কারণ হিন্দু গাঁজাখোরদের দেয়া হাদিয়া স্বয়ং ফক্বীহুল উম্মত, শাইখুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহি গ্রহণ করলেন। আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই কোথা হতে অপর একদল মুশরিক তথা হিন্দু আসলো। তারা এসে শাইখুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহিকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলো, “হুযূর! আপনার দরবার শরীফে অনেক তাবারুক বিতরণ হয়। কাজেই আমাদেরকে কিছু দান করুন।” শাইখুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহি তখন গাঁজাখোরদের দেয়া সে হাদিয়ার দিকে ইঙ্গিত করলেন। তাদেরকে হিন্দু গাঁজা খোরদের দেয়া সে হাদিয়ার মিষ্টি প্রদান করলে তারা সেগুলো খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে চলে গেলো। পরে শাইখুল ইসলাম, রঈসুল মুহাদ্দিসীন হযরত শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি খানকা শরীফে অবস্থানরত মুরীদ-মুতাকিদগণের সামনে গাঁজাখোরদের দেয়া তাবিজটি খুলে দেখালেন। সেখানে লিখা আছে, “হে দিল্লীর গাঁজাখোরেরা! তোমরা যারা গাঁজা খাও তারা এখান থেকে খেও।” পিরে এর হাক্বীকত বুঝতে পেরে মুরীদ-মুতাকিদ ও খলীফাগণ গভীরভাবে অনুতপ্ত হলেন।

উল্লেখ্য যে, হাদিয়া যে পথে আসে সে পথেই চলে যায়। সুতরাং হালাল উপার্জিত সম্পদই হাদিয়া হিসেবে দেয়া উচিত। আর গ্রহীতারও উচিত হাদিয়া গ্রহণের সময় হালাল-হারামের তাহ্কীক্ব বা যাচাই-বাছাই করা। কেননা, ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ্, কুতুবুল আলম, আফযালুল বাশার, খিয়ারুল উম্মাহ্, আত্কান্ নাছ, খাইরুল বারিয়াহ্, আজওদুন্ নাছ, শাইখুল আলম, আওলাদে রসূল, রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেন, “হালাল- হালালের দিকে আকর্ষণ করে এবং হারাম- হারামের দিকে আকর্ষণ করে থাকে।” অর্থাৎ হালাল পন্থায় অর্জিত সম্পদ ভোগ করলে হালাল কাজের রাস্তা খুলে যায়। নেক আমলের প্রতি মন আকৃষ্ট হয়। হারাম বা অবৈধ কাজের প্রতি ঘৃণা পয়দা হয়। আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফত ও মুহব্বত হাছিলের জজ্বা তৈরী হয়। পক্ষান্তরে হারাম পথে উপার্জিত সম্পদের দ্বারা, হারাম, নাজায়িয তথা গুণাহ্র প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। নফ্স বা প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং খারাপ কাজের প্রেরণা জন্মে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের অজান্তে অতি সংগোপনে হারাম বা অবৈধ কাজে মশগুল হয়।

এ প্রসঙ্গে তিনি একটি ওয়াকেয়া বর্ণনা করেন, “জনৈক বুযূর্গ ব্যক্তির একজন মুরীদ ছিলো। সে অনেক অর্থ-সম্পদের মালিক ছিলো। তার ব্যবসা ছিল বিরাট। সে বিভিন্ন ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহ্বত লাভের উদ্দেশ্যে খান্কা শরীফে হাযির হতো।

খানকা শরীফের নিকটবর্তী সে সদর রাস্তার মোড়ে কিছু গরীব ও অন্ধ ভিক্ষুক জীবিকা অর্জনের জন্য সমবেত হতো। একদিন তাদের মধ্যে এক অন্ধ ব্যক্তিকে দেখে তার দয়ার উদ্রেক হলো। নিজের পকেট হতে পাঁচটি টাকা বের করে তাকে দান করতঃ তিনি ছোহ্বত বা সংসর্গের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। যথারীতি পরের দিন উক্ত মুরীদ স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার ছোহ্বতে আসার সময় খানকা শরীফের নিকটবর্তী হলে ঐ স্থানেই উক্ত অন্ধ ফকীরের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পতিত হলো। তিনি শুনতে পেলেন, উক্ত অন্ধ অপর একজন অন্ধ ব্যক্তিকে বলছে, দেখ, গতকাল এক ব্যক্তি আমাকে পাঁচ টাকা হাদিয়া স্বরূপ দিয়েছে। যা নিয়ে আমি শরাবখানায় গিয়েছি। শরাব পান করেছি এবং আনুষঙ্গিক খারাপ কাজগুলো করেছি। তা শুনে মুরীদ আশ্চর্য হলো কিন্তু তাকে কিছু না বলে ঘটনাটি স্বীয় পীর ছাহেবকে জানালো। পীর ছাহেব শুনে কিছু না বলে অন্য প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর পীর ছাহেব উক্ত মুরীদকে একটি কাঁচা টাকা দিয়ে বললেন, “তুমি বাড়ীতে চলে যাও। পথে ঐ মোড়ের মধ্যে দেখতে পাবে এক ব্যক্তি চাদর পরিহিত অবস্থায় রাস্তা অতিক্রম করতেছে। তাকে এই টাকাটি দিবে এবং তাকে অনুসরণ করে তার গতিবিধি লক্ষ্য করবে।”

পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর আদেশ পেয়ে ঐ মুরীদ বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো এবং পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর বর্ণনা মত মোড়ের মধ্যে এক ব্যক্তিকে গায়ে চাদর জড়ানো অবস্থায় রাস্তা অতিক্রম করতে দেখতে পেলো। তখন সে দ্রুত গতিতে তার নিকটবর্তী হলো এবং পীর ছাহেবের কথা মত উক্ত কাঁচা টাকাটি তাকে দিলো। টাকাটি হাতে নিয়ে উক্ত ব্যক্তি তাকে কিছু না বলেই স্বীয় গন্তব্য পথে যাত্রা শুরু করলো। কিছু দূর গিয়ে এক জঙ্গলের নিটকবর্তী হলো এবং চাদরের ভিতর হতে কি যেন বের করে ফেলে দিলো। অতঃপর স্বীয় লক্ষ্য পানে আবার চলতে লাগলো। কিছু দূর গিয়ে এক বাজারে ঢুকে ঐ টাকা দিয়ে খাদ্য-সামগ্রী এবং প্রয়োজনীয় কেনা-কাটা করে বাড়ীর দিকে পথ ধরলো। আর মুরীদ, পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর কথামত কিছু না বলে সবকিছু দেখেই চললো। লোকটি একটি বাড়ীর নিকটবর্তী হলে সে তার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “হে ব্যক্তি! তুমি তোমার চাদরের ভিতর হতে কি বের করে জঙ্গলে ফেলে দিলে? আর কেনই বা তুমি এতো দ্রুত গতিতে রাস্তা অতিক্রম করলে?” তখন লোকটি বললো, “দেখ! আমি আজ তিনদিন হতে অনাহারে। অনেক কোশেশ করেও জীবন ধারণের জন্য কোন প্রকার খাবারের ব্যবস্থা করতে পারিনি বিধায় পথে পরে থাকা একটি মরা হাঁস পেয়ে তুলে নিলাম। ভাবলাম, এমতাবস্থায় জীবন রক্ষার্থে আমার জন্য মরা হাঁসের গোশ্ত খাওয়া মোবাহ্। তবে ব্যাপরটি কোন লোকের গোচরীভূত হওয়া সঙ্গত মনে করলাম না। গোপনীয়তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই চাদরের নীচে রেখে অতি দ্রুত গতিতে রাস্তা অতিক্রম করছিলাম; কিন্তু আপনি যখন হাদিয়া দিলেন তখন সে ওজর বা অক্ষমতার অবসান হলো এবং মৃত হাঁসের গোশ্ত খাওয়া জায়িয হবে না বিধায় তা জঙ্গলে ফেলে দিলাম এবং বাজার হতে খাদ্য-দ্রব্য কিনে নিলাম।”

 লোকটির মুখে এরূপ জাওয়াব শুনে তাকে আর কিছু বলা সমীচীন মনে করলেন না। সুতরাং তাকে কিছু না বলে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মুরীদ পরের দিন আবার পীর ছাহেবের ছোহ্বতে এলেন। পীর ছাহেব তাকে দেখে বললেন, “তুমি গতকাল “কি দেখতে পেলে।” তখন সে মুরীদ আদ্যোপান্ত ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে পীর ছাহেব বললেন, “কিছু বুঝতে পেরেছ?” মুরীদ বললো, “পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারিনি।” পীর ছাহেব বললেন, “দেখ তোমার টাকা ছিল হারাম পন্থায় উপার্জিত। এ জন্যই সে হাদিয়া অন্ধ ফকিরক্ষèকে হারাম তথা গুণাহ্র কাজের প্রতি প্রেরণা যুগিয়েছে। আর আমার উক্ত টাকা ছিলো হালাল পন্থায় উপার্জিত। যার ফলে উক্ত ব্যক্তিকে হারাম খাওয়া হতে বিরত রেখে হালালের পথে সাহায্য করেছে। বিধায় সে হারাম থেকে বেঁচে গেছে।

কাজেই হাল জামানায় যে সমস্ত তথাকথিত মুফতী-মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদীস, শাইখুত্ তাফসীর, নামধারী ছূফী-দরবেশ, পীর-মাশায়িখ তাবত্ হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছে তা যে সে হারাম পন্থায় অর্জিত সম্পদ তথা হারাম হাদিয়া ভোগের কারণে তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। টীকা ঃ প্রদত্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে কারো মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে যে, তাবিজে যে লিখা ছিলো,  “হে দিল্লীর গাঁজাখোরেরা! তোমরা যারা গাঁজা খাও তারা এখান থেকে খেও।”এ কথার দ্বারা প্রকারান্তরে গাঁজা খাওয়াকে সমর্থন করা হলো কিনা? এর উত্তরে বলতে হয়, হাকীমগণের কোন কাজই হিকমত থেকে খালি নয়।

অতীতেও অনেক ওলীআল্লাহ্র জীবনে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে যা দৃশ্যতঃ বেমানান কিন্তু তা প্রকৃতপক্ষে ছিল ফায়দাকর। যেমন, হযরত বায়েজীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি খারাপ-মহিলার কাছে গিয়ে তাকে আল্লাহ্ ওয়ালীতে পরিণত করেছিলেন। এখানে আরো উল্লেখ্য যে ওলীআল্লাহ্গণের নেক ছোহবতের কারণে অতীতেও অনেক গাঁজাখোর, শরাবখোর ওলীআল্লাহ্ হয়েছিলো। ঠিক একই উদ্দেশ্যে ফক্বীহুল উম্মত শাহ্ আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি হিন্দু গাঁজাখোরদের ক্ষেত্রে উক্ত আচরণ করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল তার নেক ছোহবতের মাধ্যমে তাদের হিদায়েত করা। পাশাপাশি প্রদত্ত নছীহত কেবল নিশ্চিত হিন্দু গাঁজাখোরদের জন্যই বলা হয়েছিল নতুন কাউকে নয়। যাদের জন্য ইসলামী শরীয়ত প্রযোজ্য নয়, গাঁজা সেবনে যারা দায়িমীভাবে অভ্যস্ত, যাদের জন্য সেই মুহূর্তে গাঁজা পরিত্যাগ সম্ভব নয় তাদের জন্যই।

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৫)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৬)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৭)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৮)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৫৯)