ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৩)

সংখ্যা: ১১৫তম সংখ্যা | বিভাগ:

প্রসঙ্গঃ প্রত্যেক সালিক বা মুরীদের উচিত সকল কাজের উপর স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দেয়া ওযীফাকেই প্রাধান্য দেয়া। দিন-রাতের যে কোন সময়ই হোকনা কেন প্রথমে ওযীফা পাঠ করবে অতঃপর অন্যান্য কাজ করবে।  সাইয়্যিদুল মুজাহিদীন, ফখরুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ হযরত আহমদ ইবনে র্হাব রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এক রাতে আমার একজন প্রতিবেশী আমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসলো। আমরা তা খেলাম। আর সে রাতে আমি এমন নিন্দ্রামগ্ন হয়েছিলাম যে, সে রাতে ওযীফা তথা কোন ইবাদত-বন্দিগী, যিকির-ফিকিরই করার সুযোগ পাইনি। পরের দিন ভোরে আমি খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেলাম, বাদশাহ্র বাড়ী থেকে আমার সেই প্রতিবেশীকে খাবার দেয়া হয়েছিলো।  অর্থাৎ সন্দেহযুক্ত খাবারই ছিলো আমার নিয়মিত ওযীফা আদায়ে প্রতিবন্ধক।    উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফত-মুহব্বত তথা নৈকট্য লাভের দু’টি পথ- একটি জজ্বা, অপরটি হচ্ছে সুলূক। মাজ্জুব সালিক তথা স্বয়ং আল্লাহ্ পাক কর্তৃক আকর্ষিত মুরাদের তরবিয়ত (লালন-পালন) মহান আল্লাহ্ পাক স্বীয় খাছ মুহব্বতের দ্বারা সম্পন্ন করে থাকেন এবং পূর্ণ রহমত-অনুগ্রহের দ্বারা নিজের পবিত্র দরবারের দিকে তাকে টেনে নেন। আর সালিক মাজ্জুব অর্থাৎ যারা সুলূক তথা দশটি মাকামে পূর্ণ ফানা-বাঁকা লাভের পর যাদের জজ্বা বা আকর্ষিত হয়। তাদেরকে মুরীদ বলা হয়। (মা’য়ারিফে লাদুন্নিয়া) প্রথম শ্রেণী, যারা মাজ্জুব সালিক (মুরাদ, মাহবুব) তারা যেহেতু খাছভাবে তরবিয়ত প্রাপ্ত, আল্লাহ্ পাক অসীম অনুগ্রহ দ্বারা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন সেহেতু তারা সাধারণভাবে বিকর্ষণ মুক্ত। কাজেই তারা সহসাই  সুলূক শেষ করতঃ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিপূর্ণ মারিফাত-মুহব্বত তথা নৈকট্য লাভ করে থাকেন।

কিন্তু সালিক মাজ্জুব (মুহিব, মুরীদ) রীতিমত ওযীফা আদায় তথা যিকির-ফিকির, কঠোর রিয়াজত-মুশাক্কাত করার পর খাছ জজ্বা হাছিল করে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ পাক কর্তৃক আকর্ষিত হয়। মুরীদ হচ্ছে আশিক। সুতরাং মাশুকের সন্তুষ্টির জন্য পূর্ণ ফানা হওয়া আবশ্যক। এক মুহূর্তের জন্য আল্লাহ্ পাক যেন অসন্তুষ্ট না হন তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়। যদি কোন কারণে আল্লাহ্ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সালিকের প্রতি অসন্তুষ্ট হন তবে তার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে সর্বপ্রথম ওযীফা আদায়ের ক্ষেত্রে বিঘœ ঘটা।

“বাহজাতুল আছরার” কিতাবের ২১৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

خدمت وظائف کے بجالانے سے تیرا اعراض کرنا اس سے اعراض کر نے کا سبب ہے.

অর্থঃ- “তোমার নিয়মিত ওযীফা আদায়ের ক্ষেত্রে বিরক্তি বা বিমূখতা আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিমূখতা বা অসন্তুষ্টির কারণ।”

অনুরূপভাবে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা যদি কোন কারণে মুরীদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন তাহলেও মুরীদের ওযীফা আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

কাজেই মুরীদ যদি কোন সময় এরূপ অবস্থার সম্মুখীন হয় তাহলে তার উচিত স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে বিষয়টি অবহিত করা। খালিছ তওবা-ইস্তিগ্ফার ও রোনাজারি করা। অন্যথায় বিষয়টি আরো ঘনীভূত হয়ে চরম আকার ধারণ করে। আর আওয়ামুন্ নাছ (সাধারণ লোকের) ক্ষেত্রে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে তাদের অন্তর হতে আউলিয়া-ই-কিরামগণের প্রতি মুহব্বত, শ্রদ্ধাবোধ উঠে যাওয়া।

রঈসুল মুহাদ্দিসীন, ইমামুল মুহাক্কিক্বীন, মাহবুবে ইলাহী হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহিকে একদা জিজ্ঞাসা করা হলো যে, সালিক বা মুরীদ কি সুলূকের পথে কখনও প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়?”

জাওয়াবে মাহবুবে ইলাহী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে। মুরীদও সুলূকের পথে ঐ সময় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় যখন তার আনুগত্য তথা স্বীয় ওযীফা, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাতের মধ্যে ত্রুটি দেখা দেয় কিংবা তার ওযীফা তার কাছে বিস্বাদযুক্ত হয়। তবে যদি সেই অবস্থায় তওবা-ইস্তিগ্ফার করে তাহলে আবার সুলূকের পথযাত্রী হয়। সঠিকভাবে সুলূকের পথে চলতে শুরু করে। তবে সেক্ষেত্রে তার সে অবস্থার উন্নতি নাও হতে পারে।  তিনি আরো বলেন, জেনে রাখা আবশ্যক যে, দু’জন বন্ধু। যারা পরস্পর আশিক এবং মাশুক। একজন অন্যজনের মুহব্বতে সর্বদা গরক বা বিমোহিত। এমতাবস্থায় আশিকের তরফ হতে যদি এমন কোন বিষয় জাহির (প্রকাশ) হয় যা সুখ-শান্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক ও বন্ধুর অপছন্দনীয়, যার ফলশ্রুতিতে বন্ধু স্বীয় মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে আশিকের জন্য ওয়াজিব হয়ে যায় যে, অতি সত্ত্বর ক্ষমা প্রার্থনা করা। কেননা, ক্ষমা প্রার্থনা করলেই বন্ধু খুশি হয়ে যান, অসন্তুষ্টিও দূরীভূত হয়। কিন্তু ঐ আশিক যদি সে ভুল ইস্রার (বার বার) করে এবং ক্ষমা প্রার্থনাও না করে তাহলে উক্ত اعراض (ই’রাজ) বিরক্তিভাব حجاب (হিযাব) পর্দায় রূপান্তরিত হয়ে  যায় এবং মাশুক মুখ দেখানো বন্ধ করে দেন।

মাহবুবে ইলাহী খাজা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি তার উদাহরণ দিতে গিয়ে স্বীয় (জামার) আস্তিন মুবারক  নিজ  চেহারা মুবারকে দিয়ে বললেন, মাশুক এভাবে পর্দা করেন। সে সময় আশিকের একান্ত কর্তব্য হচ্ছে স্বীয় অপরাধের জন্য ওজরখাহী এবং তওবা-ইস্তিগ্ফার করা। কিন্তু যদি তা না করে তাহলে حجاب (হিযাব) পর্দা تفاصل (তাফাসুল) এর মধ্যে পরিগণিত হয়। অর্থাৎ আস্তে আস্তে জুদায়ী দেখা দেয়। আর সে অবস্থায়ও যদি ক্ষমা প্রার্থনা না করে তাহলে سلب مزيد (সল্বে মযিদ) এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অর্থাৎ আনুগত্যতা এবং ওযীফা, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাত তথা অতিরিক্ত আমল এবং তার অতিরিক্ত স্বাদ বিনষ্ট হয়ে যায়। সে অবস্থায়ও যদি ক্ষমাপ্রার্থী না হয় তাহলে سلب قديم (সল্বে কদীম) দেখা দেয়। অর্থাৎ মৌলিক ইবাদত-বন্দিগী তথা ফরয ও ওয়াজিব আমল এবং তার মূল স্বাদই বিনষ্ট হয়ে যায়।

সুতরাং সে অবস্থায় যদি হাক্বীক্বীভাবে তওবা-ইস্তিগ্ফার, ওজরখাহী না করে তাহলে ছলবে কাদিম تسلى (তাসাল্নী) তে পরিণত হয়। অর্থাৎ মাশুকের বিচ্ছেদাবস্থা তার সহনীয় হয়ে যায়। মাশুকের কোন খেয়ালই তার অন্তরে উদয় হয়না। আর এ অবস্থাতেও যদি সে ক্ষমাপ্রার্থী না হয় তাহলে عدوات (আদাওয়াত) বা  শত্রুতা পয়দা হয়ে যায়। অর্থাৎ তখন উক্ত মুহব্বত শত্রুতায় রূপান্তরিত হয়। (নাউযুবিল্লাহ্) (ফাওয়ায়িদুল ফুয়াদ ১ম/১৭-১৮)

মূলতঃ এভাবে সময় যত অতিবাহিত হয় দূরত্ব তথা গোমরাহী ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ইমামুল আইম্মা, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, আওলাদে রসূল, হাবীবুল্লাহ্, সাইয়্যিদুনা মামদুহ্ হুযূর ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী উক্ত বিষয়টির আরো সহজবোধ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেন, “যখন কোন লোকের উপর হতে আল্লাহ্ পাক-এর রহমত উঠে যায় তখন তার আমল তথা ওযীফা, যিকির-ফিকির, রিয়াযত-মুশাক্কাত এবং স্বীয় কর্তব্য কাজের মধ্যে গাফলতি (অলসতা) আসে। সে অবস্থায় যদি তারা খালিছভাবে তওবা-ইস্তিগফার না করে তাহলে কোন মহিলা অথবা আমরাদ (قريب البلوغ) তথা বালেগের নিকটবর্তী কোন ছেলের প্রতি আসক্ত (আকর্ষিত) হয়।”

তিনি আরো বলেন, “মহিলা ও আমরাদ এ দু’টির মাধ্যমে ছূফীরা সবচেয়ে বেশী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।” (নাউযুবিল্লাহ্)

সে সময় যদি তাদের খালিছ তওবা নসীব না হয় তাহলে স্বীয় পীর ছাহেব এবং অপরাপর আউলিয়া-ই-কিরামগণ থেকে তার সুধারণা নষ্ট হয়ে যায়। আউলিয়া-ই-কিরামগণের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। তারপরেও যদি তওবা-ইস্তিগফারে মনোনিবেশ না করে তাহলে নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ হতে সুধারণা উঠে যায়। তাঁদের শান-মান, মর্যাদা-মর্তবার খিলাফ কথা-বার্তা বলতে শুরু করে। সে অবস্থায় যদি তওবা-ইস্তিগফার না করে তাহলে আল্লাহ্ পাক-এর শানে আজেবাজে কথা বলে তার নাফরমানিতে লিপ্ত হয়। ফলে ধীরে ধীরে চরম গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে মুরতাদ হয়ে যায়। (নাউযুবিল্লাহ)

তবে মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওযীফা তরককারী এবং অনিয়মিতভাবে ওযীফা আদায়কারীদের সচেতনতা ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক ক্ষেত্রে সতর্ক করে থাকেন।

মূলতঃ আল্লাহ্ পাকই হচ্ছেন তাদের একমাত্র বন্ধু। আর বন্ধুর কাজ হচ্ছে বন্ধুকে সতর্ক করা।

আল্লাহ্ পাক বলেন,

الله ولى الذين امنوا يخرجهم من الظلمت الى النور.

অর্থঃ- “আল্লাহ্ পাক হচ্ছেন মু’মিনদের বন্ধু। সুতরাং তাঁদেরকে অন্ধকার তথা গোমরাহী থেকে আলো তথা হিদায়েতের দিকে ফিরিয়ে আনেন।” (সূরা বাক্বারা/২৫৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬০)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬২)

পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৪)

ফিক্বহুল হাদীস ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৬৫)