মুহম্মদ আলী
সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম
সুওয়ালঃ ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’-এ বলা হয়েছে, “হযরত আদম আলাইহিস সালাম ব্যতীত আর কোন মানুষই সরাসরি মাটির তৈরী নন। সকলেই কুদরতীভাবে তৈরী।”
কিন্তু কেউ কেউ ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’-এর এই বক্তব্যের ইখতিলাফ করে বলে, “হযরত আদম আলাইহিস সালাম যেভাবে মাটির তৈরী অন্যান্য মানুষও সে একইভাবে তৈরী। দলীলস্বরূপ তারা নিম্নোক্ত আয়াত শরীফসমূহ পেশ করে থাকে- (১) সূরা আ’রাফ/১২, (২) সূরা বণী ইসরাঈল/৬১, (৩) সূরা ছোয়াদ/৭৬, (৪) সূরা ছফফাত/৭৬, (৫) সূরা কাহফ/৩৭, (৬) সূরা রূম/২০, (৭) সূরা গাফির/৬৭, (৮) সূরা মু’মিনূন/১২, (৯) সূরা ফাতির/১১, (১০) সূরা আনআম/২।” প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত আয়াতে কারীমাসমূহে ‘হযরত আদম আলাইহিস সালামসহ সকল মানুষই মাটির তৈরী’ এ কথা বলা হয়েছে কি-না? ব্যাখ্যা ও দলীলসহ জানতে বাসনা রাখি।
জাওয়াবঃ মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’-এ যা বলা হয়েছে অর্থাৎ যে ফতওয়া প্রদান করা হয়েছে সে ফতওয়াই ছহীহ, দলীলভিত্তিক এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া। এর বিপরীত কোন বক্তব্য বা ফতওয়া ছহীহ এবং গ্রহণযোগ্য নয়। তা সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহর খিলাফ।
যারা ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’-এর প্রদত্ত ফতওয়া সম্পর্কে ইখতিলাফ বা মতবিরোধ করেছে তারা নিজেদের কিল্লতে ইলম ও কিল্লতে ফাহম অর্থাৎ অল্প জ্ঞান ও অল্প বুঝের কারণে করেছে। যার ফলে তাদের জিহালতীরই প্রকাশ ঘটেছে। কারণ তারা যে সকল আয়াত শরীফের কথা বলেছে সে সকল আয়াত শরীফের অর্থ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে তারা নেহায়েতই অজ্ঞ ও বকদরে নেছাব। কেননা, উক্ত আয়াত শরীফসমূহে হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য মানুষের সৃষ্টির কথা নয়। আয়াত শরীফগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা কি? তা আলোচনা করলেই বিষয়টি পরিস্ফুটিত হবে। (১) ‘সূরা আ’রাফ’-এর ১১-১২ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
قلنا للمئكة اسجدوا لادم فسجوا الا ايليس لم يكن من السجدين قال ما منعك الا تسجد اذا امرتك قال انا خير منه خلقتنى من نار وخلقته من طين.
অর্থঃ- “অতঃপর আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছি, তোমরা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করো, তখন ইবলিস ব্যতীত সবাই সিজদা করেছে। সে সিজদাকারীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। আল্লাহ পাক বললেন, আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি তখন তোকে কিসে সিজদা করতে বারণ করলো? সে বললো, আমি উনার (হযরত আদম আলাইহিস সালাম) চাইতে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং উনাকে অর্থাৎ হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা।” এ আয়াত শরীফে স্পষ্টভাবে হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর কথা উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং এর ব্যাখ্যা নিস্প্রয়োজন। (২) ‘সূরা বণী ইসরাঈল’-এর ৬১ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
واذ قلنا للملئكة اسجدوا لادم فسجدوا الا ابليس قال ءاسجد لمن خلقت طينا.
অর্থঃ- “আর যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করো; তখন ইবলিস ব্যতীত সকলেই সিজদা করলো। ইবলিস বললো, আমি কি এমন ব্যক্তিকে সিজদা করবো যাঁকে (হযরত আদম আলাইহিস সালাম) আপনি মাটির দ্বারা সৃষ্টি করেছেন?” এ আয়াত শরীফেও স্পষ্টভাবে হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর কথা উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং তা ব্যাখ্যা করার অবকাশ রাখেনা। (৩) ‘সূরা ছোয়াদ’-এর ৭৫-৭৬ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
قال يابليس ما منعك ان تسدد لما خلقت بيدى استكبرت ام كنت من العالين قال انا خير منه خلقتنى من نار وخلقته من طين.
অর্থঃ- “আল্লাহ পাক বললেন, হে ইবলিস! আমি স্বহস্তে যাঁকে সৃষ্টি করেছি উনার সম্মুখে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাঁধা দিলো, তুমি অহংকার করলে? না, তুমি তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন? সে বললো, আমি উনার (হযরত আদম আলাইহিস সালাম) চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুনের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন আর উনাকে অর্থাৎ হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা।” এ আয়াত শরীফেও স্পষ্টভাবে হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর কথা বলা হয়েছে। সুতরাং ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। (৪) ‘সূরা ছফফাত’-এর ১১ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
انا خلقنهم من طين لازب.
অর্থঃ- “নিঃসন্দেহে আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এঁটেল মাটি থেকে।”
আল্লামা আবুল লাইছ সামারকান্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি “তাফসীরে সামারকান্দী”-এর ৩য় জিঃ, ১১২ পৃষ্ঠায় লিখেন,
انا خلقناهم من طين لازب يعنى خلقنا ادم عيه السلام.
অর্থঃ- “(নিঃসন্দেহে আমিই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এঁটেল মাটি থেকে) অর্থাৎ আমি হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছি এঁটেল মাটি থেকে।” অনুরূপ তাফসীরে খাযিন, রহুল বয়ান, কাদেরী ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে। (৫) ‘সূরা কাহফ’-এর ৩৭ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
قال له صاحبه وهو يحاوره اكفرت بالذى خلقك من تراب ثم من نطفة ثم سوك رجلا.
অর্থঃ- “তার সঙ্গী তাকে কথা প্রসঙ্গে বললোঃ তুমি উনাকে অস্বীকার করছো যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর নুতফা থেকে, অতঃপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন তোমাকে মানবাকৃতিতে।”
মুহইস সুন্নাহ আল্লামা আলাউদ্দীন আলী ইবনে মুহম্মদ ইবনে মুহম্মদ ইবনে ইব্রাহীম বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে খাযিন”-এর ৩য় জিঃ, ১৯৯ পৃষ্ঠায় লিখেন,
(خلقك من تراب) اى خلق اصلك من تراب لان خلق اصله سبب فى خلقه.
অর্থঃ- “(তোমাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন) অর্থাৎ তোমার আছল হযরত আদম আলাইহিস সালামকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। কেননা উনার আছলের সৃষ্টি উনার সৃষ্টির কারণ।” অনুরূপ তাফসীরে রুহুল মায়ানী, মাযহারী, সামারকান্দী, রুহুল বয়ান ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে। (৬) ‘সূরা রূম’-এর ২০ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
ومن ايته ان خلقكم من تراب ثم اذا انتم بشر تنتشرون.
অর্থঃ- “উনার নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি নিদর্শন এই যে, তিনি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এখন তোমরা মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছো।” আল্লামা ছানাউল্লাহ পানীপথী রহমতুল্লাহি আলাইহি “তাফসীরে মাযহারী”-এর ৭ম জিঃ, ২২৯ পৃষ্ঠায় লিখেন,
ان خلقكم اى خلق اصلكم ادم من تراب.
অর্থঃ- “তিনি তোমাদেরকে অর্থাৎ তোমাদের আছল হযরত আদম আলাইহিস সালামকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” অনুরূপ তাফসীরে খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, কাদেরী, সামারকান্দী ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে। (৭) ‘সূরা গাফির’-এর ৬৭ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
هو الذى خلقكم من تراب ثم من نطفة ثم من علقة ثم يخرجكم طغلا.
অর্থঃ- “ঐ আল্লাহ পাক যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর নুতফা থেকে, অতঃপর জমাঁ রক্ত থেকে, অতঃপর তোমাদেরকে বের করেন শিশুরূপে।”
আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি “তাফসীরে রুহুল বয়ান”-এর ৮ম জিঃ, ২০৭ পৃষ্ঠায় লিখেন,
(هو الذى خلقكم من تراب) ….. المعنى خلق اصلكم ادم من تراب.
অর্থঃ “(ঐ আল্লাহ পাক যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন)….এ আয়াত শরীফের সঠিক অর্থ হলো মহান আল্লাহ পাক তোমাদের আছল হযরত আদম আলাইহিস সালামকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।”
অনুরূপ তাফসীরে খাযিন, বাগবী, মুদ্বিহুল কুরআন, কাদেরী ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে। (৮) ‘সূরা মু’মিনূন-এর ১২ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
ولقد خلقنا الانسان من سللة من طين.
অর্থঃ- “আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি।”
আল্লামা বাগবী রহমতুল্লাহি আলাইহি “তাফসীরে বাগবী”-এর ৪র্থ জিঃ, ৭৭ পৃষ্ঠায় লিখেন,
(هو الذى خلقكم) اى اصلكم (من تراب)
অর্থঃ- “ঐ আল্লাহ পাক যিনি তোমাদেরকে অর্থাৎ তোমাদের ‘আছল’কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” অনুরূপ তাফসীরে মাযহারী, কুরতুবী, খাযিন, মুদ্বিহুল কুরআন, সামারকান্দী ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে। (৯) ‘সূরা ফাতির’-এর ১১ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
والله خلقكم من تراب ثم من نطفة ثم جعلكم ازواجا.
অর্থঃ- “আল্লাহ পাক তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর নুতফা থেকে, তারপর করেছেন তোমাদেরকে যুগল।”
আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে আহমদ আনছারী কুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি “তাফসীরে কুরতুবী” -এর ৭ম জিঃ, ৩৩২ পৃষ্ঠায় লিখেন,
(والله خلقكم من تراب) قال سعيد عن قتادة قال يعنى ادم عليه السلام والتقدير على هذا خلق اصلكم من تراب.
অর্থঃ- “(মহান আল্লাহ পাক! তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন) হযরত সাঈদ হযরত কাতাদা থেকে বর্ণনা করে বলেন, অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক হযরত আদম আলাইহিস সালামকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আয়াত শরীফে “اصل” (মূল) শব্দ উহ্য রয়েছে।” অনুরূপ তাফসীরে সামারকান্দী, খাযিন, বাগবী, মুদ্বিহুল কুরআন, কাদেরী ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে। (১০) ‘সূরা আনআম’-এর ২ নং আয়াত শরীফ ও তার ব্যাখ্যা,
هو الذى خلقكم من طين ثم قضى اجلا واجل مسمى عنده ثم انتم تمترون.
অর্থঃ- “সেই আল্লাহ পাক যিনি তোমাদেরকে মাটির থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর নির্দিষ্টকাল নির্ধারণ করেছেন। আর এক নির্দিষ্টকাল আল্লাহ পাক উনার নিকট রয়েছে, তথাপি তোমরা সন্দেহ করো?” ফখরুল ওলামা মৌলভী ফখরুদ্দীন ছাহেব “তাফসীরে কাদেরী”-এর ১ম জিঃ, ২৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেন,
(ھو الذی خلقکم) وھی ھے جس نے پیدا کیا تمھارے باپ کو “من طین” مٹی سے یا ابتداء کی تمھاری خلقت مٹی سے یعنی حضرت ابو البشر ادم علیہ السلام کو اس سے پیدا کیا.
অর্থঃ- “ঐ আল্লাহ পাক যিনি তোমাদের পিতাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অথবা মাটি দিয়ে তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অর্থাৎ আবুল বাশার হযরত আদম আলাইহিস সালামকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।” অনুরূপ তাফসীরে বাগবী, মাযহারী, খাযিন ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে।
অতএব, উপরোক্ত আয়াত শরীফ সমূহের ভিত্তিতে যারা বলে, “সকল মানুষই সরাসরি মাটি হতে সৃষ্টি” তাদের সে বক্তব্য ভুল এবং তাফসীর বির রায়ের অন্তর্ভুক্ত।
‘তাফসীর বির রায়’ সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
من فسر القران برايه فقد كفر.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের মনগড়া তাফসীর করলো সে কুফরী করলো।”
আরো ইরশাদ হয়েছে,
من قال فى القران برايه فليتبوأ مقعده من النار وفى رواية من قال فى القران بغير علم فليتبوأ مقعده من النار.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের মনগড়া ব্যাখ্যা করে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।”
অপর রিওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তি ইলম ব্যতীত, না জেনে কুরআন শরীফের ব্যাখ্যা করে সেও যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী, মিশকাত, মিরকাত, মায়ারিফুস সুনান ইত্যাদি)
উল্লেখ্য, মুফতী, মাওলানা, মৌলভীদের প্রদত্ত ভুল ফতওয়া, ব্যাখ্যা সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
من افتى بغير علم كان اثمه على من افتاه.
অর্থঃ- “যাকে ইলম ব্যতীত ফতওয়া দেয়া হলো তার সমূদয় গুণাহ ফতওয়া দানকারীর উপর বর্তাবে।” (আবূ দাউদ, মিশকাত, বযলুল মাযহুদ, মিরকাত) মূলকথা হলো, কুরআন শরীফের যে সকল আয়াত শরীফে ‘মানুষ’ মাটির তৈরী বলা হয়েছে সে সকল আয়াত শরীফে উল্লিখিত ‘মানুষ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো “হযরত আদম আলাইহিস সালাম।” কারণ শুধুমাত্র হযরত আদম আলাইহিস সালামকেই মহান আল্লাহ পাক সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন যা আল্লাহ পাক উনার কালাম কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ দ্বারা সরাসরি ও কুরআন শরীফের বিশ্ববিখ্যাত “তাফসীর গ্রন্থ” সমূহের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। হযরত আদম আলাইহিস সালাম ব্যতীত অন্য কেউ সরাসরি মাটি থেকে তৈরী নন। বরং মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরতে প্রত্যেকেই তার মার রেহেম শরীফে কুদরতীভাবে তৈরী। আর সে সম্পর্কে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
ذلك علم الغيب والشهادة العزيز الرحيم الذى احسن كل شىء خلقه وبدا خلق الانسان من طين ثم جعل نسله من سللة من ماء مهين.
অর্থঃ- “তিনিই দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু যিনি উনার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তিনি উনার বংশধর সৃষ্টি করেন সম্মানিত পানির নির্যাস থেকে।” (সূরা সাজদা/ ৬, ৭, ৮)
هو الذى خلق من الماء بشرا فجعله نسبا وضهرا وكان ربك قديرا.
অর্থঃ- “তিনি পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন মানবকে অতঃপর তাকে রক্তগত, বংশ ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। আপনার পালনকর্তা সবকিছু করতে সক্ষম।” (সূরা ফুরক্বান/৫৪)
الم نخلقكم من ماء مهين.
অর্থঃ- “আমি কি তোমাদেরকে সম্মানিত পানি হতে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা মুরসালাত/২০)
فلينظر الانسان من خلق خلق من ماء دافق.
অর্থঃ- “এতএব, মানুষের দেখা উচিত, সে কি বস্তু হতে সৃষ্টি হয়েছে। সে সৃষ্টি হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে।” (সূরা ত্বারিক্ব/৫, ৬)
هو الذى يصوركم فى الارحام كيف يشاء.
অর্থঃ- “আল্লাহ পাক তোমাদের আকৃতি গঠন করে থাকেন মায়ের রেহেম শরীফে যেভাবে ইচ্ছা।” (সূরা আলে ইমরান/৬)
অতএব প্রমাণিত হলো যে, সকল মানুষ কুদরতীভাবে মায়ের রেহেম শরীফে সৃষ্টি হয়ে থাকেন। কেউই সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি হননা। যারা বলে, ‘সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি হয়’ তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহর খিলাফ যা তাফসীর বির রায় হওয়ার কারণে সম্পূর্ণরূপে কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কোন মুসলমান কুফরী করলে সে কাফির ও মুরতাদ হয়ে যায়। শরীয়তে মুরতাদের হুকুম ও ফায়সালা হচ্ছে, “মুরতাদের স্ত্রী তালাক হয় যদি সে বিবাহিত হয়ে থাকে, হজ্ব বাতিল হয় যদি সে হজ্ব করে থাকে; এবং সে কাফির হয়। অর্থাৎ তার সকল নেক আমল বিনষ্ট হয়ে যায়, তওবা না করা পর্যন্ত সে ঈমানদার হবেনা। বিবাহ না দোহরালে স্ত্রীর সাথে সংসার করা যাবেনা। যদি সংসার করে তবে যিনাকারীর গুনাহ হবে। সন্তান হলে তা হালাল হবেনা। যদি হজ্বের সামর্থ থাকে তবে পুনরায় তাকে হজ্ব করতে হবে, যদিও সে পূর্বে হজ্ব করে থাকে। তা না করলে কবীরা গুনাহ হবে। তার ওয়ারিশ সত্ত্ব বাতিল হয়ে যাবে। তাকে তিন দিন সময় দেয়া হবে তওবা করার জন্য। যদি তওবা করে, তবে ক্ষমা করা হবে। অন্যথায় তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
কেননা হাদীস শরীফে রয়েছে, “তিন কারণে মৃত্যুদন্ড দেয়া জায়িয। যথা- (ক) ঈমান আনার পর কুফরী করলে অর্থাৎ মুরতাদ হলে। (খ) ঐ যিনাকার বা যিনাকারিনী, যারা বিবাহিত বা বিবাহিতা। (গ) যে অন্যায়ভাবে কাউকে কতল করে।” (তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনদে শাফিয়ী, মুসনদে বাজ্জার, মুস্তাদরিকে হাকিম)
উল্লেখ্য, মুরতাদ মারা যাবার পর যারা এদের জানাযার নামায পড়ে বা পড়ায় বা জানাযার নামাযে সাহায্য-সহযোগিতা করে, তাদের সকলের উপরই মুরতাদের হুকুম বর্তাবে এবং এ সকল মুরতাদ মরলে বা নিহত হলে তাকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না। এমনকি মুসলমানের ন্যায়ও দাফন করা যাবে না। বরং তাকে কুকুরের ন্যায় একটি গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখতে হবে। [এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ৮২তম সংখ্যা পাঠ করুন]
{দলীলসমূহঃ (১) আহকামুল কুরআন, (২) কবীর, (৩) মায়ালিম, (৪) খাযিন, (৫) বাগবী, (৬) কুরতুবী, (৭) মাযহারী, (৮) ইবনে জারীর, (৯) নিশাপুরী, (১০) ওয়াহিদী, (১১) আযীযী, (১২) হাক্কানী, (১৩) খুলাছাতুত তাফসীর, (১৪) রুহুল মায়ানী, (১৫) সিরাজুম মুনীর, (১৬) দুররে মানছুর, (১৭) হাশিয়ায়ে শায়খ যাদাহ, (১৮) রুহুল বয়ান, (১৯) ইবনে কাছীর, (২০) বায়যাবী, (২১) কাশশাফ, (২২) তাবারী, (২৩) ইবনে আব্বাস, (২৪) যাদুল মাছীর, (২৫) ক্বাদিরী, (২৬) সামারকান্দী, (২৭) মুদ্বিহুল কুরআন, (২৮) মা’আরিফুল কুরআন, (২৯) ইবনে আরাবী, (৩০) মাদারিক (৩১) হুসাইনী, (৩২) ফতহুল ক্বাদির (৩৩) ত্বাহিরী, (৩৪) হাসান বছরী, (৩৫) মাজিদী, (৩৬) আহমদী, (৩৭) বয়ানুল কুরআন, (৩৮) উছমানী, (৩৯) কিছাছূল কুরআন, (৪০) ক্বাসিমী, (৪১) তাফসীরে আব্দুল হাকীম, (৪২) তাফসীরে আবুল হাসান, (৪৩) তাফসীরে হামদানী, (৪৪) ছফওয়াতুত তাফাসীর, (৪৫) তাফসীরে ইয়াকুত ওয়াল মারজান, (৪৬) জালালাইন, (৪৭) কামালাইন, (৪৮) আবূ দাউদ, (৪৯) তিরমিযী, (৫০) মা’আরিফুস সুনান, (৫১) মিশকাত, (৫২) বযলুল মাযহুদ, (৫৩) আউনুল মা’বুদ, (৫৪) মিরকাত, (৫৫) তুহফাতুল আহওয়াযী, (৫৬) আশয়াতুল লুময়াত, (৫৭) লুময়াত, (৫৮) শরহুত ত্বীবি, (৩৯) তালিকুছ ছবীহ, (৬০) মুযাহিরে হক্ব ইত্যাদি}
ডাঃ মুহম্মদ হাবীবুর রহমান পানছড়ি সদর, খাগড়াছড়ি
সুওয়ালঃ সম্প্রতি আমাদের এলাকায় রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর মাহফিলকে কেন্দ্র করে বিলিকৃত চিঠিতে উল্লেখকৃত ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ শব্দ নিয়ে ওহাবী-খারিজী, রেযাখানীরা সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এখন আমার সুওয়াল হলো, ক্বায়িম-মক্বাম’ অর্থ কি? ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ বলতে কি বুঝায়? এটি কোন ক্ষেত্রে বা কাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়? এটি ব্যবহার করা শরীয়ত সম্মত কি-না? দয়া করে জানাবেন। জাওয়াবঃ ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর অর্থ হলো প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী, স্থলাভিষিক্ত ইত্যাদি। এটি দ্বীনি-দুনিয়াবী, পুরুষ-মহিলা সকল ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। আর এটি ব্যবহার করা জায়িয ও শরীয়তসম্মত। ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর তাহকীক্ব বা বিশ্লেষণ ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ আলাদা দু’টি শব্দ। ‘ক্বায়িম’ একটি শব্দ এবং ‘মক্বাম’ একটি শব্দ। উভয় শব্দই আরবী। শব্দ দু’টি যদিও আলাদা কিন্তু তার মাদ্দাহ (শব্দমূল) এবং মাছদার (ক্রিয়ামূল) এক ও অভিন্ন। মাদ্দাহ হচ্ছে قوم (ক্বওম অর্থাৎ ক্বাফ, ওয়াও, মীম)। আর মাছদার হচ্ছে قوما (ক্বওমান), قومة (ক্বওমাতান), قياما (ক্বিয়ামান) ও قامة(ক্বামাতান)। এর অর্থ হলো দাঁড়ান বা খাড়া হওয়া। قائم ‘কায়িম’ শব্দটি نصر (নাছারা) বাব থেকে ইসমে ফায়িল (কর্তাবাচক বিশেষ্য)-এর পুং লিঙ্গ, এক বচনের শব্দ। বহুবচন-
قيم، قيام، قوم، قيم، قوام،
(কুওওয়াম, কুইয়াম, কুওয়ম, কুইয়াম, ক্বিইয়াম)। অর্থ- দন্ডায়মানকারী। مقام ‘মক্বাম’ শব্দটি ইসমে যরফ (স্থানবাচক) এক বচনের শব্দ। বহুবচন مقامات (মক্বামাত)। অর্থ দাঁড়ানোর স্থান।
লুগাত বা অভিধান শাস্ত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার ‘ক্বায়িম’ শব্দটির অর্থ যদিও দন্ডায়মানকারী কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর বিভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। যেমন- প্রথমতঃ قائم السيف (ক্বায়িমুস সাইফ) অর্থ ‘তরবারির হাতল।’ অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে ‘সাইফ’ শব্দটি ইযাফত বা সংজোযিত হওয়ার কারণে তার অর্থ হয়েছে “হাতল”।
দ্বিতীয়তঃ قائم الماء (ক্বায়িমুল মায়ি) অর্থ- ‘পানির ট্যাংক।’ অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে যখন ‘মায়ূন’ শব্দটি ইযাফত হবে তখন তার অর্থ হবে ‘ট্যাংক।’ তৃতীয়তঃ قائم الدبة (ক্বায়িমুদ দাব্বাহ) অর্থ- ‘পশুর পা’। অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে যখন ‘দাব্বাহ’ শব্দটি ইযাফত হবে তখন তার অর্থ হবে ‘পা।’
চতুর্থতঃ قائم السرير (ক্বায়িমুস সারীর) অর্থ- ‘খাটের পায়া।’ অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে যখন ‘সারীর’ শব্দটি ইযাফত হবে তখন তার অর্থ হবে ‘পায়া।’ পঞ্চমতঃ যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তা হলো قائم مقام (ক্বায়িম-মক্বাম) অর্থাৎ ‘ক্বায়িম’ শব্দটির সাথে ‘মক্বাম’ শব্দটির ইযাফতকালে তার অর্থ হবে প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী, স্থলাভিষিক্ত, মুখপাত্র, সহকারী, প্রতিভূ, নায়িব, মিছদাক, জামিন, বদলী, অনুকল্প, যিম্মাদার, কারো পরিবর্তে কাজ করার জন্য নিযুক্ত ব্যক্তি, দ্বীন ইসলামের প্রচারক ও বিশেষজ্ঞ, অন্যের স্থান বা পদে অধিষ্ঠিত ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, قائم مقام (ক্বায়িম মক্বাম) শব্দটির সমার্থবোধক আরো কতিপয় আরবী শব্দ হচ্ছে وارث (রসূল), رسول (ওয়ারিছ),نائب (নায়িব), خليفة (খলীফা), مبعوث (প্রেরিত) ইত্যাদি।
ক্বাওয়ায়িদ বা ব্যাকরণ শাস্ত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার
উপমহাদেশের সকল দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অপরিহার্য পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ‘হিদায়াতুন নাহু’ আরবী ক্বাওয়ায়িদ কিতাবের অনেক স্থানে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন-
(১)
نائب فاعل(নায়িবে ফায়িল) এর সংজ্ঞায় বর্ণনা করা হয়েছে,
وهو كل مفعول حذف فاعله واقيم هو مقامه نحو ضرب زيد.
অর্থঃ- “এমন সব মাফউল (কর্মপদ) যার ফায়িল বা কর্তাকে বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং মাফউলকে ফায়িলের ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ করা হয়েছে। যেমন- যায়িদ প্রহৃত হয়েছে।” (২) حرف نداء (হরফে নেদা) বা আহবান সূচক অব্যয়-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,
حرف النداء قائم مقام ادعو واطلب.
অর্থঃ- “আহবানসূচক অব্যয় ادعوا (আদউ) অথবা اطلب (আত্বলুবু) ফে’ল বা ক্রিয়ার ‘ক্বায়িম মক্বাম’ বা স্থলাভিষিক্ত।”
(৩) غير منصرف (গায়রে মুনছরিফ)-এর সংজ্ঞায় বর্ণিত হয়েছে,
غير منصرف وهو مافيه سببان او واحد منها يقوم مقامهما.
অর্থঃ- “গায়রে মুনছরিফ ঐ ইসম যার মধ্যে নয় সববের দু’টি সবব অথবা দু’সববের ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ একটি সবব বিদ্যমান থাকবে।”
(৪)
التانيث بالالف المقصورة والممدودة.
(হ্রস্ব আলিফযুক্ত ও দীর্ঘ আলিফযুক্ত স্ত্রীলিঙ্গ) শব্দ সমূহ গায়রে মুনছরিফ। তার সবব সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,
لان الالف قائم مقام السببين التانيث.
অর্থঃ- “কেননা, আলিফটি দু’টি সববের ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ একটি হলো স্ত্রীলিঙ্গ আর অপরটি হলো স্ত্রীলিঙ্গ অপরিহার্যভাবে হওয়া।” (৫)
جمع منتهى الجموع.
(চূড়ান্ত বহুবচন) শব্দগুলো যে গায়রে মুনছরিফ তার শর্ত বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে,
وهو ايضا قائم مقام السببين الجمعية و لزومها.
অর্থঃ- “আর তাও দু’টি সববের ‘ক্বায়িম-মক্বাম।’ সবব দু’টি হচ্ছে (১) বহুবচন হওয়া, (২) বহুবচন অপরিহার্য হওয়া।” কুরআন শরীফে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে সকল শব্দ ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর অনুরূপ অর্থ প্রদান করে তাহলো خليفة (খলীফা), رسول (রসূল), وارث (ওয়ারিছ),نائب (নায়িব),مبعوث (প্রেরিত) ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক উনার কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
انى جاعل فى الارض خليفة.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমি যমীনে খলীফা (প্রতিনিধি) প্রেরণ করব।” (সূরা বাক্বারা/৩০)
يداود انا جعلنك خليقة فى الارض فاحكم بين الناس بالحق.
অর্থঃ- “হে দাউদ আলাইহিস সালাম! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে যমীনে খলীফা (প্রতিনিধি) মনোনীত করেছি। অতএব আপনি মানুষের মাঝে ন্যায়-সঙ্গত ভাবে ফায়সালা করুন।” (সূরা ছোয়াদ/২৬)
فهب لى من لدنك وليا يرثنى ويرث من ال يعقوب.
অর্থঃ- (আল্লাহ পাক উনার নিকট হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম-এর দোয়া, “আয় আল্লাহ পাক! আমাকে আপনার তরফ থেকে একজন ওলী দান করুন যিনি আমার এবং ইয়াকুব বংশের স্থলাভিষিক্ত হবেন।” (সুরা মরিয়ম/৬)
لقد بعثنا فى كل امة رسولا.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য একজন রসূল (প্রতিনিধি) পাঠিয়েছি।” (সূরা নহল/৩৬)
وارسلنك للناس رسولا وكفى بالله شهيدا.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমি আপনাকে রসূল (প্রতিনিধি) করে পাঠিয়েছি। এর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ পাকই যথেষ্ট।” (সূরা নিসা/৭৯)
وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا
অর্থঃ- “কোন সম্প্রদায়ের মাঝে রসূল (প্রতিনিধি) না পাঠানো পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা হবেনা।” (সূরা বণী ইসরাইল/১৫)
ما كان محمد ابا احد من رحالكم ولكن رسول الله وخاتم النبين.
অর্থঃ- “মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পুরুষের পিতা নন। বরং তিনি হলেন আল্লাহ পাক উনার রসূল এবং সর্বশেষ নবী।” (সূরা আহযাব/৪০) স্মরণীয়, রসূল শব্দটি একাধিক অর্থের জন্য ব্যবহৃত হয়। তার মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ‘প্রতিনিধি।’ হাদীস শরীফে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
عليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين المهدين تمسكوا بها وعضوا عليها بنواجذ.
অর্থঃ- “ তোমাদের প্রতি আমার সুন্নত এবং হিদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফা-ই-রাশিদীনগণের সুন্নত পালন করা ওয়াজিব।” (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত) এ হাদীস শরীফে খুলাফা-ই-রাশিদীন- (১) হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, (২) হযরত উমর ফারুক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, (৩) হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, (৪) হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, (৫) হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, (৬) হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলীফা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, তিনি হচ্ছেন,
خليفة رسول الله صلى الله عليه وسلم.
অর্থাৎ- “আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খলীফা।” উনার সম্পর্কে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
ابو بكر رضى الله عنه وزيرى يقوم مقامى.
অর্থঃ- “হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমার উজির এবং তিনি আমার ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ বা স্থলাভিষিক্ত।” (দায়লামী, জামউল জাওয়াম, মাজমাউয যাওয়ায়িদ, কানযুল উম্মাল) হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, স্বয়ং আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
او كان بعدى نبى لكان عمر بن الخطاب رضى الله تعالى عنه.
অর্থঃ- “আমার পর যদি কেউ নবী হতো তাহলে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নবী হতেন।” অর্থাৎ এ হাদীস শরীফ দ্বারা বুঝা যায় যে, হযরত উমর ফারুক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মধ্যে নবী হওয়ার যোগ্যতা ছিলো। কিন্তু যেহেতু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আখিরী নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাই উনার পর উনাকে নবী করা হয়নি বরং উনার নায়িব তথা ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি নায়িবী নবী ও ক্বায়িম-মক্বামে নবী। অপর এক বর্ণনায় এসেছে,
وهو اول خليفة دعى بامير المؤمنين.
অর্থঃ- “তিনিই প্রথম খলীফা যাকে ‘আমীরুল মু’মিনীন হিসেবে সম্বোধন করা হয়।”(মিশকাত, মিরকাত) এবং খলীফা হিসেবে তিনি ছিলেন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম।’ হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে ইন্তিকালের পূর্বেই খলীফা নিযুক্ত করে যান।” হযরত মুয়ায বিন জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সম্পর্কে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
الحمد لله الذى وفق رسول رسول الله بمأ يرضى به رسوله.
অর্থঃ- “সমস্ত প্রসংশা সেই আল্লাহ পাক উনার জন্য যিনি উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতিনিধিকে এমন সিদ্ধান্তে আসার তাওফীক দিয়েছেন যাতে উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুশী হন।” (আহমদ, বায়হাক্বী, মিশকাত) মূলতঃ হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম প্রত্যেকেই আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ ছিলেন। এ মর্মে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
اصحابى كالنجوم بايهم اقتديتم اهتديتم.
অর্থঃ- “আমার প্রত্যেক ছাহাবীই নক্ষত্র সাদৃশ্য। উনাদের যে কাউকে অনুসরণ করলে হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে।” (মিশকাত)
তিনি আরো ইরশাদ করেন,
اصحابى كلهم كالنجوم بايهم اقتديتم اهتديتم.
অর্থঃ- “আমার ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম সকলেই তারকা সাদৃশ্য। উনাদের যে কাউকে অনুসরণ করলে হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে।”(রযীন)
এছাড়া যারা হক্কানী আলিম-উলামা উনারা প্রত্যেকেই রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়ারিছ, নায়িব তথা ‘ক্বায়িম-মক্বাম।’ এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
ان العلماء ورثة الانبياء وان الانبياء لم يورثوا دينارا ودرهما انما ورثوا العلم فمن اخذه اخذ بحظ وافر.
অর্থঃ- “আলিমগণ হচ্ছেন নবীগণের ওয়ারিছ। নবীগণ কোন দীনার-দিরহাম মীরাছ রেখে যাননা। তারা মীরাছরূপে রেখে যান শুধুমাত্র ইলম। সুতরাং যে ব্যক্তি ইলম গ্রহণ বা অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারিমী)
অপর এক হাদীস শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
علماء امتى كانبياء بنى اسرائيل.
অর্থঃ- “আমার উম্মতের আলিমগণ বণী ইসরাঈলের নবীগণের ন্যায় মর্যাদাবান।” (কানযুল উম্মাল)
কাজেই পুরুষ হোক , মহিলা হোক যিনিই ইলম অর্জন করবেন, তিনিই নবীর ওয়ারিছ, নায়িব বা ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হবেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবত এবং দ্বীনি তা’লীম-তরবীয়তের মাধ্যমে পুরুষ ছাহাবী এবং মহিলা ছাহাবী সকলেই হাক্বীক্বী আলিম ও আলিমা হয়েছিলেন। অর্থাৎ উনারা প্রত্যেকেই ছিলেন নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নায়িব বা ‘কায়িম-মক্বাম।’ আবার উনাদের মধ্যে যারা খাছ ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ ছিলেন উনারা কেবল পুরুষই ছিলেন তা নয় বরং মহিলাও ছিলেন। যেমন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা।
উল্লেখ্য, নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের খাছ ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ মেয়েদের শানে কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
ليس الذكر كالانثى.
অর্থঃ- “হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালাম এমন এক মহিলা যার সমকক্ষ পুরুষও নন।” (সূরা আলে ইমরান/৩৬) আর হাদীস শরীফে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর শানে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
خذوا نصف دينكم من هذه الحميراء.
অর্থঃ- “তোমরা দ্বীনের অর্ধেক শিক্ষা গ্রহণ করবে হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে।” (দাইলামী, কানযুল উম্মাল) অর্থাৎ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে ইলম (ফিক্বাহ ও তাছাউফ) শিক্ষা দানকারীনী তথা দ্বীন প্রচারকারীনী রূপে খিলাফত দান করেন বা খলীফা মনোনীত করেন।
সত্যিই আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিদায়ের পর হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা দ্বীনের ব্যাপক খিদমত করেছেন।
অপর এক বর্ণনায় এসেছে, একদা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা! তুমি যেহেতু আমার পর হাদী হবে সেহেতু তিনটি জিনিষ তুমি ব্যবহার করতে পারবেনা, যদিও অন্যান্য মহিলাদের জন্য তা ব্যবহার করা জায়িয রয়েছে। (১) লাল রংয়ের কাপড়, (২) রেশমি কাপড়, (৩) স্বর্ণালংকার। তখন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, হে আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি তো মেয়ে মানুষ, আমি কি অলংকার পড়বনা? হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তুমি অলংকার পড়তে পারবে তা হলো রূপার অলংকার। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, রূপার অলংকার কি স্বর্ণের পানিতে রং করতে পারব? হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, রং করতে হলে স্বর্ণের পানিতে করা যাবেনা বরং জাফরানের পানিতে রং করে নিতে হবে।
কারণ
حسنات الابرار سيئات المقربين.
“সাধারণ লোকের জন্য যা নেকী খাছ লোকের জন্য তা পাপ।” (মাআরিফুল কুরআন)
উল্লিখিত বর্ণনা হতে বুঝা গেল, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা মেয়ে মানুষ হওয়া সত্বেও তিনি আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ ছিলেন।
পরবর্তী যুগেও উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হিসেবে দ্বীনি খিদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন অনেক মহিলা। উনাদের মধ্যে হযরত রাবিয়া বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহা এবং আরো অনেকে। এবং বর্তমানে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হিসেবে দ্বীনি খিদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন যামানার মুজতাহিদ ও ইমাম, ইমামুল আইম্মা, মুহইস সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদুয যামান, আওলাদুর রসূল, রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর সহধর্মিনী সাইয়্যিদাতুন নিসা, হাবীবাতুল্লাহ হযরত আম্মা হুযূর ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহাল আলীয়া। এই হচ্ছে দ্বীনি ক্ষেত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর বর্ণনা। আর দুনিয়াবী ক্ষেত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার। যেমন পিতার অবর্তমানে সাধারণতঃ বড় ছেলে পিতার ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হয়ে থাকেন এবং মাতার অবর্তমানে সাধারণত ‘ক্বায়িম মক্বাম’ হন বড় মেয়ে। এমনিভাবে রাজা-বাদশা, আমীর-উমরা সকলের ক্ষেত্রে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হতে দেখা যায় বা হয়ে থাকে।
বালাগাত শাস্ত্রে ‘কায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার
বালাগাত বা অলংকার শাস্ত্র যে তিনটি শাখার সমন্বয়ে গঠিত তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো ‘ইলমুল বয়ান।’ যার মাধ্যমে বক্তা একই বক্তব্য বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। আর ‘ইলমুল বয়ান’-এর অন্যতম অধ্যায় হচ্ছে ‘তাশবীহ’। এটি যে অর্থে ও যে উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় তার সাথে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর অর্থ ও উদ্দেশ্যের সাথে যথেষ্ট মিল রয়েছে।
তাশবীহ এর আভিধানিক অর্থঃ এর আভিধানিক অর্থ তুলনা করা, অনুরূপ হওয়া, উপমা দেয়া ইত্যাদি। আর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায় ‘দুরুসুল বালাগাত’ শাস্ত্রের মুছান্নিফ বলেন,
التشبيه الحاق امر بامر فى وصف باداة لغرض.
অর্থঃ- “কোন উদ্দেশ্যে একটি বস্তুকে অন্য একটি বস্তুর সাথে কোন গুণের দিক বিবেচনায় তাশবীহ-এর যে কোন একটি হরফের মাধ্যমে সম্পৃক্ত করাকে ‘তাশবীহ’ বলে।” এটিই তাশবীহ-এর প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা বলে কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবনে আবুল আসবাহ তাশবীহ-এর সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন এভাবে,
هو اخراج الاغمض الى الاظهر.
অর্থাৎ- “একটি অপ্রসিদ্ধ ও অপ্রকাশ্য বিষয়কে অপর একটি প্রসিদ্ধ ও প্রকাশ্য বিষয়ের দিকে নিয়ে আসা।”
কারো কারো মতে তাশবীহ-এর সংজ্ঞা এরূপ-
هوان تشبت للمشبه حكما فى احكام المشبه به.
অর্থাৎ- “মুশাব্বাহ বিহী-এর কোন হুকুম মুশাব্বাহ-এর জন্য সাব্যস্ত করাকে তাশবীহ বলে।
মূলতঃ কোন বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মিল থাকার কারণে একটি বস্তুর সাথে অন্য একটি বস্তুকে তুলনা করার নামই তাশবীহ।
তাশবীহ-এর রোকন চারটি। যথা- (১) মুশাব্বাহ (যাকে তাশবীহ দেয়া হয়), (২) মুশাব্বাহ বিহী (যার সাথে তাশবীহ দেয়া হয়), (৩) ওয়াজহে তাশবীহ (তাশবীহ-এর কারণ), (৪) আদাতে তাশবীহ (তাশবীহ প্রদানের মাধ্যম)।
যেমন,
العلم كالنور فى الهداية.
অর্থঃ- “ইলম পথ দেখানোর ব্যাপারে আলোর ন্যায়।” সুতরাং ‘ইলম’ মুশাব্বাহ, ‘আন নূর’ মুশাব্বাহ বিহী, ‘হিদায়াত’ ওয়াজহে তাশবীহ এবং ‘কাফ’ আদাত বা হরফে তাশবীহ। উল্লেখ্য, ‘মুশাব্বাহ ও মুশাব্বাহ বিহী’ এ দু’টিকে তাশবীহ-এর দুই তরফ বা পার্শ্ব বলা হয়। কেননা, এ দু’টি হলো তাশবীহ-এর স্তম্ভ। যাদের উপর ভিত্তি করে তাশবীহ বাস্তবে আসে। তাশবীহ-এর এ উভয় পার্শ্ব হিসসী তথা ইন্দ্রিয়ানুভূত হবে। যেমন,
الورف كالحرير فى النعومة.
অর্থঃ- “পাতা কমলতার দিক থেকে রেশমের মত।” এখানে মুশাব্বাহ ‘পাতা’ এবং মুশাব্বাহ বিহী ‘রেশম’ উভয়টি ইন্দ্রিয়ানুভূত।” অথবা, উভয় পার্শ্ব আক্বলী তথা জ্ঞানানুভূত হবে।
যেমন, الجهل كالموت.
অর্থঃ- “অজ্ঞতা মৃত্যু তুল্য।”
এখানে মুশাব্বাহ ‘অজ্ঞতা’ এবং মুশাব্বাহ বিহী ‘মউত’ কোনটিই ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করার জিনিস নয়। বরং জ্ঞান দ্বারা অনুভব করা যায়।
অথবা, একটি অপরটির বিপরীতও হতে পারে। অর্থাৎ মুশাব্বাহ আক্বলী হলে মুশাব্বাহ বিহী হিসসী হবে। আর মুশাব্বাহ হিসসী হলে মুশাব্বাহ বিহী আক্বলী হবে। যেমন,
خلقه كالعطر.
(তার চরিত্র আতর তুল্য) এবং
طبيب السوء كالموت
(খারাপ ডাক্তার মৃত্যু তুল্য)। প্রথম উদাহরণে ‘চরিত্র’ আক্বলী যা মুশাব্বাহ এবং ‘আতর’ হিসসী যা মুশাব্বাহ বিহী। আর দ্বিতীয় উদাহরণে মুশাব্বাহ ‘খারাপ ডাক্তার’ হিসসী এবং ‘মউত’ মুশাব্বাহ বিহী যা আক্বলী। ওয়াজহে তাশবীহ (তাশবীহ-এর কারণ)ঃ এটি ঐ বিশেষ গুণকে বলে যার মধ্যে মুশাব্বাহ ও মুশাব্বাহ বিহী উভয়ই জড়িত। অর্থাৎ উভয়ের মধ্যে সেই বিশেষ গুণটি পাওয়া যায়। যেমন,
العلم كالنور فى الهداية.
অর্থঃ- “হিদায়েতের দিক থেকে ইলম আলো তুল্য।” এখানে ‘হিদায়েত’ বিশেষ গুণটি ইলম এবং নূর উভয়ের মধ্যে পাওয়া গেছে এবং এ বিশেষ গুণের দিক হতে তাশবীহ হয়েছে।
স্মরণীয় যে, ওয়াজহে তাশবীহ অর্থাৎ তাশবীহ-এর কারণের দিক হতে তা চার প্রকার। যথা-
(১) তামছীলঃ ঐ তাশবীহকে বলে যার মধ্যে তাশবীহ-এর কারণটি কয়েকটি বিষয় থেকে নেয়া হয়েছে। যেমন,
وقد لاح فى الصبح الثريا كماترى+
كعنقود ملاحية حين نورا.
অর্থঃ- “তুমি দেখবে যে, ভোর বেলা সুরাইয়া তারকার উজ্জ্বলতা এমন, যেন তা উজ্জল কাঁচা আঙ্গুরের থোকা।”
এখানে সুরাইয়া তারকাগুলোর দৃশ্যকে উজ্জ্বল কাঁচা আঙ্গুরের থোকার দৃশ্যের সাথে তাশবীহ বা তুলনা দেয়া হয়েছে। আর তুলনার একাধিক দিকগুলো হচ্ছে- কতগুলো একত্রিত হওয়া, উজ্জ্বল হওয়া, থোকাবদ্ধ হওয়া, বেশী ঘন না হওয়া।
(২) গায়রে তামছীলঃ ঐ তাশবীহকে বলে যার তাশবীহ-এর কারণ বিভিন্ন বিষয় হতে নেয়া হয়নি বরং মাত্র একটি বিষয় থেকে নেয়া হয়েছে। যেমন,
زيد كالاسد فى الشجاعة.
অর্থঃ- “যায়িদ সাহসিকতার দিক থেকে সিংহের মতো।” এখানে ওয়াজহে তাশবীহ বা তুলনার দিক বা কারণ হলো শুধু মাত্র একটি তা হলো সাহসিকতা। (৩) মুফাচ্ছলঃ ঐ তাশবীহকে বলে যার মধ্যে ওয়াজহে তাশবীহ উল্লেখ করা হয়। যেমন,
وثغره فى صفاء وادمعى كاللالى.
অর্থঃ- “কবির প্রেমিকার দাঁত এবং আমার অশ্রু পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক হতে মুক্তার মত।” এখানে প্রেমিকার দাঁত এবং আমার অশ্রুকে মুক্তার সাথে তাশবীহ দেয়া হয়েছে।
(৪) মুজমালঃ ঐ তাশবীহকে বলে যার মধ্যে ওয়াজহে তাশবীহ-এর উল্লেখ হবেনা। যেমন,
النحو فى الكلام كالملح فى الطعام.
অর্থঃ- “ভাষার মধ্যে ব্যাকরণ অনুরূপ যেরূপ খাবারের মধ্যে লবণ।” এখানে ইলমে নাহুকে খাবারের লবণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর এই তুলনার কারণ হলো ‘প্রয়োজনীয়তা’ যা আলোচ্য তাশবীহে উল্লেখ করা হয়নি। اداة (আদাতে) তাশবীহ-এর বর্ণনাঃ বালাগাত শাস্ত্রবিদগণ আদাতে তাশবীহ বলতে حروف (হুরূফ) اسماء (আসমা) ও افعال (আফয়াল) প্রত্যেক শ্রেণীকে বুঝিয়েছেন। হুরূফ বা অব্যয়সমূহ। যেমন, كان (কাফ) ও كان (কাআন্না) যথা- زيد كالاسد. “যায়েদ সিংহের মত।” তদ্রুপ كأن زيدا اسد. “যায়েদ যেন সিংহ।” আসমা বা বিশেষ্যসমূহ। যেমন, مثل (মিছলু বা মাছালু) যথা-
زيد مثل عمرو فى الشجاعة.
“যায়েদ বীরত্বের দিক থেকে আমরের ন্যায়।”
আফয়াল বা ক্রিয়াসমূহ। যেমন, يخيل (ইয়ূখইয়িলু) অর্থাৎ সে (অনুরূপ) খেয়াল করলো। يحسب (ইয়াহসিবু) অর্থাৎ সে (অনুরূপ) মনে করলো ইত্যাদি।
মূলতঃ ‘আদাত’ বলতে রূব্জল্প (কাফ) বা অনুরূপ অর্থের হরফ বা ইসম বা ফে’লকে বুঝায়। আর ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ উক্ত অর্থও দান করে থাকে। তাশবীহ-এর উদ্দেশ্যঃ প্রকাশ থাকে যে, প্রত্যেক বিষয়ের যেরূপ কোন না কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে তদ্রুপ একটি বিষয়কে অন্য বিষয়ের সাথে তাশবীহ বা তুলনা করারও কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ‘বালাগাত শাস্ত্রবিদগণ’ বলেন,
والغرض منه تأنيس الناس باخراجها من خفى الى جلى وادنى البعيد من القريب ليفيد بيانا.
অর্থঃ- “তাশবীহ-এর উদ্দেশ্য হলো কোন মানুষকে এইভাবে পরিচিত করা যে, তাকে কোন অস্পষ্ট বিষয় হতে স্পষ্ট বিষয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং দূরের কোন বিষয়কে নিকটবর্তী কোন বিষয়ের সাথে জড়িত করা যাতে বর্ণনা ও স্পষ্টতার উপকারে আসে।” তাশবীহ-এর উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরূপ: (১) মুশাব্বাহ-এর সম্ভাব্যতা বর্ণনা করা। (২) মুশাব্বাহ-এর অবস্থা বর্ণনা করা। (৩) মুশাব্বাহ-এর অবস্থার পরিমাণ বর্ণনা করা। (৪) মুশাব্বাহ-এর অবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। (৫) মুশাব্বাহ-এর সৌন্দর্য বর্ণনা করা। (৬) মশাব্বাহ-এর দুর্ণাম বর্ণনা করা। প্রথমতঃ তাশবীহ দ্বারা ‘মুশাব্বাহ’-এর সম্ভাব্যতা বর্ণনা সম্পর্কে কবি মুতানাব্বি-এর উক্তিঃ
فان تفق الانام وانت منهم+
فان المسك بعض دم الغزال.
অর্থঃ- “এখানে কবি মুতানাব্বী তার যুগের বাদশাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে বলেন, ‘হে আমার প্রশংসিত (বাদশাহ)! তুমি সৃষ্টিকুলের একজন হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞানে গুণে সকল সৃষ্টের তুলনায় শ্রেষ্ঠ হলেও এটা আশ্চর্যের কিছু নয় বরং এটা সম্ভব। কেননা, মেশক হরিণের রক্তের একাংশ হওয়া সত্ত্বেও এটা হরিণের সকল অঙ্গের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব রাখে।”
দ্বিতীয়তঃ তাশবীহ দ্বারা ‘মুশাব্বাহ’-এর অবস্থা বর্ণনা করা সম্পর্কে কবি নাবেগায়ে জুবয়ানীর উক্তিঃ
كانك شمس والملوك كواكب+
اذا طلعت لم يبد منهن كوكب.
অর্থঃ- “(হে নো’মান!) তুমি জগতের সূর্যতুল্য। আর অন্যান্য বাদশাহগণ যেন তোমার তুলনায় তারকা। যখন সূর্য উদিত হয় তখন তারকারাজি ম্লান হয়ে যায়।” আলোচ্য ছন্দে কবি বাদশাহ নো’মানকে সূর্যের সাথে তাশবীহ দিয়েছেন আর অন্যান্য বাদশাহগণকে তারকার সাথে তাশবীহ দিয়েছেন। সুতরাং এখানে দু’টি তাশবীহ-এর প্রথম তাশবীহ-এর মধ্যে বাদশাহ নো’মান আর দ্বিতীয় তাশবীহ-এর মধ্যে অন্যান্য বাদশাহগণ এবং এই তাশবীহ দ্বারা মুশাব্বাহ-এর অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যে, বাদশাহ নো’মান বাদশাকুলের মধ্যে জ্ঞানে, গুণে ও ঐতিহ্যে এত উজ্জ্বল যে, তার তুলনায় অন্যান্য বাদশাহগণ যেন ম্লান ও আলোবিহীন অর্থাৎ তার ঐতিহ্যের সম্মূখে অন্যান্যদের কোন ঐতিহ্যই নেই।
অনুরূপ দ্বিতীয় তাশবীহ-এর মধ্যেও মুশাব্বাহ-এর অবস্থা বর্ণিত হয়েছে যে, অন্যান্য বাদশাহগণকে তারকার সাথে তাশবীহ দেয়া হয়েছে। সুতরাং অন্যান্য বাদশাহগণের অবস্থা হলো তুলনামূলকভাবে তাদের বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য খুবই কম ও নগণ্য। যা বাদশাহ নো’মানের তুলনায় অস্তিত্বহীন।
তৃতীয়তঃ তাশবীহ দ্বারা ‘‘মুশাব্বাহ”-এর অবস্থার পরিমাণ বর্ণনা উদ্দেশ্য। যেমন, কবির উক্তিঃ
فيها اثنتان واربعون حلوبة+
سوداء كحافية الغراب الاسحم.
অর্থঃ- “সেই বংশে ৪২টি দুধ দানকারিনী কালো বর্ণের উটনী রয়েছে। যারা কালোত্বের দিক থেকে পাহাড়ী কালো কাকের পাখার রংয়ের ন্যায়।”
আলোচ্য তাশবীহ দ্বারা কবি মুশাব্বাহ তথা উটনীর অবস্থা যে কালো তার পরিমাণ তথা অতি কালো হওয়া বর্ণনা করেছেন। এটাই এখানে তাশবীহ-এর উদ্দশ্যে। চতুর্থতঃ ‘মুশাব্বাহ’-এর অবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে তাশবীহ দেয়া হয়। যেমন, কবির উক্তিঃ
ان القلوب اذا تنافر ودها+
مثل الزجاجة كسرها لايجبر.
অর্থঃ- “অন্তরের ভালবাসায় যখন ফাঁল ধরে তখন তা যেন সীসার ন্যায় যার ভগ্নাংশ লাগেনা।”
কবি এখানে ভগ্ন অন্তরকে সীসার সাথে তুলনা দিয়ে ভগ্ন অন্তরের অবস্থা শ্রোতার মানসপটে বুঝিয়ে দিয়েছেন। অন্তরের এই ফাঁল সংশোধিত হয়ে অন্তর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে যাওয়ার মত নয়। আর অন্তরের ভগ্ন অবস্থা এখানে মুশাব্বাহ যার অবস্থা এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
পঞ্চমতঃ ‘মুশাব্বাহ’-এর সৌন্দর্য বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে তাশবীহ দেয়া। যেমন, কবির কবিতার ছন্দঃ
سوداء واضحة الجبين+
كمقلة الظبى العزيز.
অর্থঃ- “কবির প্রিয় ব্যক্তি কালো চক্ষু এবং উজ্জ্বল কপাল বিশিষ্ট। তার প্রিয় চক্ষু হরিণের প্রিয় চক্ষুর ন্যায়।” কবি এখানে তার প্রিয় ব্যক্তির কালো চক্ষুকে হরিণের কালো চক্ষুর সাথে তুলনা করে প্রিয় ব্যক্তির চক্ষুর সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। আর এখানে চক্ষু হলো মুশাব্বাহ। সুতরাং তার সৌন্দর্য প্রমাণিত হলো। ষষ্ঠতঃ ‘মুশাব্বাহ’-এর দোষ ও দুর্ণাম বর্ণনার উদ্দেশ্য তাশবীহ দেয়া হয়। যেমন, কবির উক্তিঃ
اذا اشار محدثا فكانه+
قرد يقهقه اوعجوز تلطم.
অর্থঃ- “আমি যার দুর্নাম করছি তার অবস্থা এই যে, যখন সে কথা বলার জন্য ইঙ্গিত করে তখন যেন সে এমন বানর যে অট্টহাসি হাসে। অথবা যেন সে এমন বৃদ্ধা নারী, যে নিজের গালে নিজে চপেটাঘাত করে।” কবি এখানে উনার দুর্নামকৃত ব্যক্তিকে অট্টহাসিদাতা বানর বা নিজের গালে নিজে চপটাঘাত কারিনী বৃদ্ধার সাথে তুলনা করে তার দুর্নাম, বিশ্রী চেহারা প্রকাশ করেছেন। আর এখানে কবির দুর্নামকৃত ব্যক্তি হলো মুশাব্বাহ। সুতরাং তারই বিশ্রী আকৃতি হওয়া বুঝানো হয়েছে। কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে তাশবীহ-এর উদাহরণ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
الم تر كيف ضرب الله مثلا كلمة طيبة كشجرة طيبة.
অর্থঃ- “আপনি কি লক্ষ্য করেননি? অর্থাৎ করেছেন যে, আল্লাহ পাক পবিত্র কলেমা শরীফের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন, পবিত্র একটি গাছের সাথে?” (সূরা ইবরাহীম/২৪)
فمثله كمثل الكلب.
অর্থঃ- “তার মেছাল একটা কুকুরের মেছালের মত।” (সূরা আ’রাফ/১৮৬)
এ আয়াত শরীফে বালআম বিন বাউর যে নবীর বিরোধীতা করার কারণে তার প্রতি লা’নত বর্র্ষিত হয়েছিল তাকে কুকুরের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
وجعلنا الليل لباسا.
অর্থঃ- “আমি রাত্রিকে পোশাকের ন্যায় আচ্ছাদিত করেছি।” (সূরা নাবা/১০) আর আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
ان الولادى كسفينة نوح.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই আমার আওলাদগণ হযরত নূহ আলাইহিস সালাম-এর কিস্তির মত।” (সিররুশ শাহাদাতাইন, হাশিয়ায়ে মিশকাত)
علماء امتى كانبياء بنى اسرائيل.
অর্থঃ- “আমার উম্মতের আলিমগণ বণী ইস্রাঈলের নবীগণের মত।” (কানযুল উম্মাল)
من زار عالما فكانما زارنى.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আলিমকে দেখলো, সে যেন আমাকে দেখলো।” ইত্যাদি। এমনিভাবে তাশবীহ-এর উদাহরণ আরো বহু আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফে রয়েছে। তাশবীহ-এর উপরোক্ত নাতিদীর্ঘ আলোচনা দ্বারা আশাকরি ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ব্যবহার ও প্রয়োগের বৈধতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হাছিল হবে। মূলতঃ সারকথা হলো এই যে, ‘মুশাব্বাহ’ অর্থাৎ যাকে তুলনা করা হয় এবং ‘মুশাব্বাহ বিহী’ অর্থাৎ যার সাথে তুলনা করা হয় এ উভয়টি হুবহু বা সব দিক থেকে এক নয়। বরং এক বা একাধিক ওয়াজহে তাশবীহ অর্থাৎ èম্বল্প বা গুণের ভিত্তিতে মুশাব্বাহকে মুশাব্বাহ বিহীর সাথে তাশবীহ বা তুলনা করা হয় বা দেয়া হয়। ঠিক একইভাবে ‘ক্বায়িম-মক্বাম’-এর ক্ষেত্রেও তাই। অর্থাৎ যিনি ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ হন এবং যার ক্বায়িম-মক্বাম হন উভয় ব্যক্তি এক নন। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে অর্থাৎ ছিফত বা গুণের দিক হতে এক। আর তার নামই হচ্ছে ‘ক্বায়িম-মক্বাম।’ উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, ‘ক্বায়িম-মক্বাম’ পুরুষ-মহিলা সকলের জন্যই ব্যবহার করা কেবল জায়িযই নয় বরং সুন্নতেরও অন্তর্ভুক্ত।
{দলীলসমূহঃ (১) তাফসীরে আহকামুল কুরআন, (২) কুরতুবী, (৩) মাযহারী, (৪) তাবারী, (৫) কবীর, (৬) খাযিন, (৭) বাগবী, (৮) দুররে মনছূর, (৯) মাআরিফুল কুরআন (১০) আহমদ, (১১) তিরমিযী, (১২) আবূ দাউদ, (১৩) ইবনে মাযাহ, (১৪) দারিমী, (১৫) মিশকাত, (১৬) রযীন, (১৭) জামউল জাওয়াম, (১৮) মাজমাউয যাওয়ায়িদ, (১৯) কানযুল উম্মাল, (২০) বায়হাক্বী, (২১) মিরকাত (২২) আশয়াতুল লুময়াত, (২৩) লুময়াত, (২৪) শরহুত ত্বীবী, (২৫) মুযাহিরে হক্ব, (২৬) তুহফাতুল আহওয়াযী, (২৭) আউনুল মা’বুদ, (২৮) বজলুল মাজহুদ, (২৯) কামূছ আল মুহীত, (৩০) ওয়াসীত, (৩১) জাদীদ, (৩২) লিসানুল আরব, (৩৩) মুনজিদ আরবী, (৩৪) মুনজিদ উর্দূ, (৩৫) মিছবাহুল লুগাত, (৩৬) লুগাতে হীরা, (৩৭) গিয়াছুল লুগাত, (৩৮) লুগাতে সাঈদী, (৩৯) বয়ানুল লিসান, (৪০) আল কামূসুদ দরসী, (৪১) মিছবাহুল মুনীর, (৪২) নিহায়া, (৪৩) আল মু’জামুল ওয়াজীয, (৪৪) মু’জামু মাক্বায়ীসুল লুগাত, (৪৫) মাগরিব, (৪৬) আল মু’জামুল বুলদান, (৪৭) আল মুহীত ফিল লুগাত, (৪৮) আল মানার, (৪৯) লুগাতে কিশওয়ারী, (৫০) তাজুল আরুস, (৫১) ইফরাতুল মাওয়ারীদ, (৫২) ফরহাঙ্গ-ই-রব্বানী, (৫৩) কারীমুল লুগাত, (৫৪) আরবী ও বাংলা অভিধান, (৫৫) আর রইদ, (৫৬) ক্বামুসুল কুরআন, (৫৭) ফিরুজুল লুগাত, (৫৮) ফরহাঙ্গে আমেরা, (৫৯) আল ক্বামুসুল জাদীদ, (৬০) হিদায়াতুন নাহু, (৬১) দুরুসুল বালাগাত, (৬২) বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, (৬৩) সরল বাঙ্গালা অভিধান, (৬৪) আধুনিক বাংলা অভিধান, (৬৫) সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, (৬৬) বাংলা ভাষার অভিধান ইত্যাদি। }
মাওলানা মুহম্মদ মুহসিনুর রহমান
মাওলানা মুহম্মদ মাছূম বিল্লাহ
মুহম্মদ আসাদুর রহমান,
মুহম্মদ মাইজুর রহমান ভোলাহাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
সুওয়ালঃ আমরা মাসিক আল বাইয়্যিনাত ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম এই তিনটি সংখ্যায় ৩৫৩টি অকা্যঁ দলীলের ভিত্তিতে প্রদত্ত আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত-এর অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ, মুহাক্কিক-মুদাক্কিক ও হক্কানী উলামা-ই-কিরামগণের ফতওয়া মুতাবিক জানতে পারলাম যে, “প্রাণীর ছবি তৈরী করা বা করানো, ঘরে রাখা সর্বাবস্থায় হারাম।”
অথচ রেযাখানী মুখপত্র নভেম্বর/২০০১ ঈসায়ী সংখ্যায় ছবি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ফতওয়া প্রকাশ করেছে। যা কিনা মানুষের ঈমান-আমল বিনষ্ট হওয়ার কারণ। রেযাখানীদের ছবি সম্পর্কিত বক্তব্যের যে বিষয়গুলো আপত্তিকর সেগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো- (ক) রেযাখানীরা ছবি তোলাকে বৈধ বলেছে; কিন্তু দলীল হিসেবে পেশ করেছে ঘরে ছবি রাখা সম্পর্কিত হাদীসসমূহকে।
(খ) .. কতেক উলামা যেসব ছবির শরীর ও ছায়া নেই সেসব ছবিকে বৈধ বলেছেন।
(গ) হুজুর আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুরুর দিকে ছবি তৈরী করা ও সংরক্ষণ করাকে নিষেধ করেছিলেন; কিন্তু পরবর্তীতে অনুমতি দেন।
(ঘ) পূর্ববর্তীদের কেউ কেউ এবং হাম্বলী, শাফেয়ী, মালেকী এমনকি হানাফীদেরও কেউ কেউ নাকি (গায়রে মুজাসসাম) শরীরবিহীন ছবিকে বৈধ বলেছেন।
(ঙ) সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কারণে বিশেষ প্রয়োজনে ছবি তোলা বৈধ যা যুগের চাহিদাও।
(চ) প্রত্যেক যুগের ফক্বীহ, মুফতী, কাজী ও আলিমগণ যুগের চাহিদা অনুযায়ী ফতওয়া দিয়েছেন এবং দেয়া উচিত।
(ছ) ছবি হারাম হওয়ার মূলে হলো গায়রুল্লাহর সম্মান ও ইবাদত।
(জ) প্রয়োজনীয় রেকর্ডের জন্য ফাইল বন্দি ছবিসমূহ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকট জ্ঞান ও ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য জানার নিমিত্তে সরকারী-বেসরকারী যাদুঘর বা বিশেষ প্রতিষ্ঠানসমূহে পূর্বের নানা মনীষীগণের ছবি সংরক্ষণ/ধারণ করে রাখা বিশেষ প্রয়োজনে মাকরূহ হবেনা। এছাড়াও আরো বহু আপত্তিকর বিষয় তাদের উক্ত ছবি সম্পর্কিত বক্তব্যে স্থান পেয়েছে। কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে তাদের উল্লিখিত আপত্তিকর বক্তব্যগুলোর শরয়ী ফায়সালা কামনা করি। জাওয়াবঃ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن ابى هريرة رضى الله تعاى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يكون فى اخر الزمان دجالون كذابون يأتونكم من الاحاديث بما م تسمعوا انتم ولا اباؤكم فاياكم واياهم لايضلونكم.
অর্থঃ- “হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আখিরী যামানায় কিছু সংখ্যক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে, তারা তোমাদের নিকট এমন সব (মিথ্যা-মনগড়া) কথা উপস্থাপন করবে, যা তোমরা কখনো শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি, সাবধান! তোমরা তাদের কাছ থেকে দূরে থাকবে, তবে তারা তোমাদেরকে গোমরাহ করতে পারবে না এবং ফিৎনায় ফেলতে পারবেনা।” (মুসলিম শরীফ)
উল্লিখিত হাদীস শরীফের পূর্ণ মিছদাক বা নমুনা হচ্ছে রেযাখানীরা। তারা ছবির ব্যাপারে এমন সব বক্তব্য প্রদান করেছে যা কিতাবে দেখা তো দূরের কথা কেউ কোনদিন শুনেওনি। মূলতঃ রেযাখানীরা নিজেদেরকৃত বদ আমলকে ধামা-চাপা দেয়ার উদ্দেশ্যেই মনগড়াভাবে ছবিকে জায়িয করার অপচেষ্টা করেছে।
(ধারাবাহিক)
প্রাণীর ছবি সম্পর্কে প্রশ্নে উল্লিখিত রেযা-খানীদের আপত্তিকর ও প্রতারণামূলক বক্তব্য সমূহের খন্ডন মূলক জবাব- (১)
উল্লেখ্য, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ১০৮ ও ১০৯তম সংখ্যায় বর্ণিত ছহীহ হাদীস শরীফ দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, পর্দা, চাদর বা যে কোন কাপড়ে প্রাণীর ছবি অঙ্কন করা হারাম এবং তা ঘরে প্রদর্শন করাও হারাম-নাজায়িয। অথচ রেযাখানীরা নিজেদের ভ্রান্ত মত প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এবং নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার কু-উদ্দেশ্যে উল্লিখিত হাদীস শরীফসমূহ সম্পূর্ণরূপে গোপন রেখে নিজেদেরকে হাদীস শরীফ কারচুপিকারী হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। রেযাখানীরা এখানেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, তারা নিজেদের বাতিল মতকে ছাবিত করার পক্ষে উল্লিখিত হাদীস শরীফে বর্ণিত,
الا رقما فى ثوب.
বাক্যের সঠিক ও গ্রহণযোগ্য অর্থ বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ মনগড়া অর্থ করেছে। যেমন, তারা উক্ত বাক্যের অর্থ করেছে এভাবে, “তিনি কাপড়ের উপর অঙ্কিত ছবিকে পূর্বের হুকুম থেকে পৃথক করে থাকেন।” হাদীস শরীফে বর্ণিত উক্ত বাক্যের সঠিক ও গ্রহণযোগ্য অর্থ হলো, “তিনি কাপড়ের উপর অঙ্কিত গাছপালা, তরুলতা অর্থাৎ প্রাণহীন বস্তুর ছবিকে পূর্বের হুকুম থেকে পৃথক করে থাকেন।” অর্থাৎ উক্ত হাদীস শরীফের মূল মাফহুম হলো, হযরত যায়িদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রাণীর ছবি তৈরী করা ও ঘরে রাখাকে নাজায়িয মনে করেন। আর প্রাণহীন বস্তুর ছবি তৈরী করা ও তা ঘরে রাখাকে জায়িয মনে করেন। এখন তা যেখানেই হোকনা কেন। হোক কাপড়ে, হোক কাগজে, হোক পাথরে, হোক দেয়ালে, যেখানেই হোক না কেন প্রাণীর ছবি হলে তা অঙ্কন করা ও রাখা উভয়টাই হারাম ও নাজায়িয। আর প্রাণহীন বস্তু যেমন গাছপালা, তরুলতা, পাহাড়পর্বত ইত্যাদি তা তৈরী করা ও ঘরে রাখা জায়িয।
সুতরাং হাদীস শরীফে বর্ণিত,
الا رقما فى ثوب.
এর অর্থ হলো, “কাপড়ে গাছপালা, তরুলতা ইত্যাদি প্রাণহীন বস্তুর ছবি ব্যতীত।” অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও মুহাদ্দিসীন-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণও হাদীস শরীফে বর্ণিত উক্ত বাক্যের এরূপ অর্থ করেছেন। নিম্নে বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিসগণের নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ হতে কতিপয় প্রমাণ পেশ করা হলো-
বিখ্যাত মুহাদ্দিস, হাফিযে হাদীস, ইমাম আহমদ ইবনে আলী ইবনে হাজর আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মশহুর ও নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ফাতহুল বারী শরহে বুখারী”-এর ১০ জিঃ ৩৯০ পৃষ্ঠার
الا رقما فى ثوب.
এর ব্যাখ্যায় লিখেন,
” الا رقما فى ثوب” قال النووى يجمع بين الاحاديث بان المراد باستناء الرقم فى الثوب ما كانت الصورة فيه من غير ذوات الارواح كصورة الشجر ونحوها.
অর্থঃ- “(“কাপড়ের ছবি ব্যতীত) …. ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, উক্ত হাদীস শরীফে যে কাপড়ের উপর অঙ্কিত ছবিকে বাদ দেয়া হয়েছে অর্থাৎ জায়িয বলা হয়েছে তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, প্রাণহীন বস্তুর ছবি যেমন, গাছপালা, তরুলতা ইত্যাদি।” শাইখুল ইসলাম, তাজুল মুহাদ্দিসীন, ইমাম আল্লামা বদরুদ্দীন আবূ মুহম্মদ মাহমূদ ইবনে আইনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জগতখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ “উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী”-এর ২২ জিঃ ৭৪ পৃষ্ঠায় الارقما” এর ব্যাখ্যায় লিখেন,
الا رقما” بفتح الراء وسكون القاف وفتحها النقش والكتابة وقال الخطابى المصور هو الذى يصور اشكال الحيوان والنقاش الذى ينقش اشكا الشجرونحوها.
অর্থঃ- “ “الارقما” ‘রা’-এর উপর যবর, ‘ক্বাফ’-এর সাকিন বা যবর দ্বারা “رقم” শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘নকশা’ বা লিখা। ইমাম খাত্তাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর আকৃতি তৈরী করে তাকে বলে “مصور” মুছাব্বির। আর যে ব্যক্তি গাছপালা ইত্যাদির আকৃতি বানায় তাকে বলে “نقاش” নাক্কাশ। অর্থাৎ “رقم” শদ্বের অর্থ হচ্ছে গাছপালা বা প্রাণহীন বস্তুর আকৃতি। অনুরূপ “শরহে কিরমানী”তে উল্লেখ আছে।” ইমামুল মুহাদ্দিসীন, আল্লামা আবুল আব্বাস শিহাবুদ্দীন আহমদ ইবনে মুহম্মদ কুস্তলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সুপ্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ইরশাদুস সারী শরহে বুখারী”-এর ৮ম জিঃ ৪৮৩ পৃষ্ঠায় লিখেন,
(الارقما) اى نقشا (فى ثوب) …. قال النووى…….. بان المراد استثناء ارقم فى الثوب ما كانت الصورة فيه من غير ذواب الارواح كصورة الشجر ونحوها.
অর্থঃ- “(কাপড়ের অঙ্কিত ছবি অর্থাৎ কাপড়ে অঙ্কিত (গাছপালার) নকশা ব্যতীত) … ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
الارقما فى الثور.
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, প্রাণহীন বস্তুর ছবি। যেমন, গাছপালা ইত্যাদি।”
ছহীহ ‘মুসলিম শরীফের’ ব্যাখ্যাগ্রন্থ “শরহুল উবাই ওয়া সিনূসী”-এর ৭ম জিঃ ২৫৬ পৃষ্ঠায়
“الارقما فى ثورب”
-এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে,
يحتج به من يجيز الرقم مطلقا وجوابنا وجواب الجمهور انه محمول على رقم مالا روح فيه.
অর্থঃ- “যারা সাধারণভাবে কাপড়ের উপর অঙ্কিত ছবিকে জায়িয বলে তারা এ হাদীস শরীফকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। কিন্তু আমাদের এবং জমহুর উলামাদের ফতওয়া হলো উক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা মূলতঃ প্রাণহীন বস্তুর ছবিকেই বুঝানো হয়েছে।” রঈসুল মুহাদ্দিসীন, আল্লামা ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি “শরহে মুসলিম”-এর ১৪ জিঃ ৮৫ পৃষ্ঠায় লিখেন,
(الارقما فى ثوب) هذا يحتج به من يدل باباحة ماكان رقما مطلقا كما سبق وجوابنا وجواب الجمهور عنه انه محمول على رقم على صورة الشجر وغيره ماليس بحيوان وقد قدمنا ان هذا جائز عندنا.
অর্থঃ- “যারা মতলক বা সাধারণভাবে কাপড়ে অঙ্কিত ছবিকে জায়িয বলেছে তারা এ হাদীস শরীফের উপর ভিত্তি করেই বলেছে। আর আমাদের ও জমহুর আলিমগণের ফতওয়া হলো- হাদীস শরীফে বর্ণিত ॥ল্ফহৃ দ্বারা গাছপালার অনুরূপ প্রাণহীন বস্তুর আকৃতিকেই বুঝানো হয়েছে। আর পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এরূপ গাছপালার ছবি আমাদের নিকট জায়িয।” মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ফাতহুল মুলহিম”-এর ৪র্থ জিঃ ১৫০ পৃষ্ঠায়
الارقما فى ثوب”
এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে,
واجاب عنه الجمهور بان المراد من “الرقم فى الثوب هو ماكان فيه من نقش الشجر ونحوه مما لاروح له.
অর্থঃ- হাদীস শরীফে বর্ণিত “الارقما فى ثوب” -এর ব্যাখ্যায় জমহুর উলামাগণ বলেন, হাদীস শরীফে বর্ণিত رقم শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গাছপালার নকশা, অনুরূপ প্রাণহীন বস্তুর আকৃতি।” অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ সমূহের বক্তব্য দ্বারা এটাই সুস্পষ্ট ও অকা্যঁভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, হাদীস শরীফে বর্ণিত الارقما فى ثوب এর অর্থ হলো, “কাপড়ে গাছপালা, তরুলতা ইত্যাদি প্রাণহীন বস্তুর ছবি ব্যতীত।” অতএব, রেযাখানীরা উক্ত বাক্যের মনগড়া অর্থ করে এবং উক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা প্রাণীর ছবিকে জায়িয করার অপচেষ্টা করে নিজেদের চরম জাহিল, গোমরাহ ও জালিয়াত হিসেবেই প্রমাণ করেছে। (চলবে)
সাইয়্যিদ মুহম্মদ মোক্তাদুল ইসলাম (মিলন)
রঈসুল মজলিশ- ছাত্র আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সুবহানীঘাঁ, সিলেট।
সুওয়ালঃ রেযাখানী মুখপত্র ডিসেম্বর/২০০০ ঈঃ সংখ্যায় “তাফসীরে রুহুল বয়ান, বুখারী, গুনিয়াতুত তালেবীন, রেজভীয়া” কিতাবের বরাত দিয়ে বলেছে, “সহীহ মুসলিম শরীফসহ” অনেক নির্ভরযোগ্য কিতাবে নফল নামায বিশেষতঃ ক্বদর ও বরাতের নফল নামায জামাত সহকারে আদায় করা বৈধ….।” আর আপনারা “মাসিক আল বাইয়্যিনাতে” লিখেছেন, “তারাবীহ, ছলাতুল কুছুফ (সূর্য গ্রহণের নামায), ছলাতুল ইস্তিস্কা (বৃষ্টির নামায) এই তিন প্রকার নামায ব্যতীত যেমন লাইলাতুল ক্বদর, লাইলাতুল বরাত, তাহাজ্জুদ, চাশত, আওয়াবীন ইত্যাদি নফল নামাযসমূহ ইমামের সাথে চারজন মুক্তাদীসহ জামায়াতে আদায় করা মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ।” কোনটি সঠিক?
আর “বুখারী, মুসলিম শরীফে” কি “ক্বদর” ও বরাতের” নফল নামায জামায়াতের সাথে আদায় করার কথা উল্লেখ আছে? দয়া করে জানাবেন। জাওয়াবঃ রেযাখানীরা তাদের মুখপত্রে “তাফসীরে রুহুল বয়ান, বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, গুনিয়াতুত তালেবীন এবং রেজভীয়া” কিতাবের বরাত দিয়ে নফল নামায বিশেষতঃ “শবে বরাত”, “শবে ক্বদরের” নফল নামায আযান-ইক্বামত ছাড়া জামায়াত সহকারে আদায় করা যে বৈধ বলেছে, তা আমরা আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যিনাত”-এর বিগত সংখ্যাগুলোতে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে প্রমাণ করেছি যে, “তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল, জিহালতপূর্ণ, জালিয়াতী ও প্রতারণামূলক।”
কেননা, রেযাখানীরা কিতাবের নাম দিয়ে যে বক্তব্য প্রদান করেছে, আসলে উক্ত কিতাবসমূহের বক্তব্য সে রকম নয়। বরং তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ, তারা কিতাবের ইবারত, সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে মনগড়া বক্তব্য প্রদান করেছে এবং ক্ষেত্র বিশেষ নিজের ভ্রান্ত মতকে টিকিয়ে রাখতে কিতাবের ইবারত কারচুপি করেছে।
(ধারাবাহিক)
বর্তমান সংখ্যায়রেযাখানীদের দলীলবিহীন ও মনগড়া বক্তব্য খন্ডন করা হলো
উল্লেখ্য, রেযাখানীরা বলেছে, “ঢালাওভাবে মাকরূহে তাহরীমার … ফতোয়া দিয়ে পীরানে পীর দস্তগীর আবদুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ অনেক মাশায়েখে কেরামের উপর মাকরূহে তাহরীমার অপবাদ দিয়ে নিজের খ্যাতি চমকানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, বিগত সংখ্যায় আমরা আমাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাতে দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণ করে দিয়েছি যে, “শবে বরাত, শবে ক্বদর, লাইলাতুর রাগায়িব, তাহাজ্জুদ” ইত্যাদি নফল নামায জামায়াতে আদায় করা মাকরূহ তাহরীমী। এ ফতওয়া দেয়ার কারণেই যদি তা পীরানে পীর দস্তগীর হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি অপবাদ হয়, তাহলে বলতে হয় যে, রেযাখানীদের বক্তব্য মুতাবিক হযরত বড়পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি মাকরূহ তাহরীমার প্রথম দরজার অপবাদ প্রদানকারী হলো তাদের গুরু রেযা খাঁ। আর দ্বিতীয় দরজার অপবাদ প্রদানকারী হলো মৌলভী আমজাদ আলী। সুতরাং হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি মাকরূহ তাহরীমীর অপবাদ দিয়ে রেযা খাঁ এবং মৌলভী আমজাদ আলী উভয়েই নিজেদের খ্যাতি চমকানোর অপচেষ্টা চালিয়েছিল। কেননা স্বয়ং রেযা খাঁ তার “রেজভীয়া” কিতাবে এবং মৌলভী আমজাদ আলী তার “বাহারে শরীয়ত” কিতাবে “শবে বরাত, শবে ক্বদর, রাগায়িব” ইত্যাদি নফল নামায জামায়াতের সহিত আদায় করা মাকরূহ তাহরীমী, বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ ও নাজায়িয বলে ফতওয়া দিয়েছে। তাছাড়া “বাহরুর রায়িক, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, খুলাছাতুল ফতওয়া, আদদুররুল মুখতার, গায়াতুল আওতার, রদ্দুল মুহতার, শামী, আল কুহেস্তানী, শরহুল মুনিয়া, শরহুন নিক্বায়া, শরহে ইলিয়াস, মিনহাতুল খালিক্ব, ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, হাশিয়ায়ে তাহতাবী আলা মারাকিউল ফালাহ, আইনী শরহে হিদায়া, হাশিয়ায়ে শরহে বিকায়া লি চলপী, ফতওয়ায়ে সা’দিয়াহ, জাওহারাতুন নাইয়ারাহ, মাবসূত লিস সারাখসী, মাছাবাতা বিস সুন্নাহ, কিতাবুল আছল, বাদায়েউছ ছানায়ে ফি তারতীবিশ শারায়ে, ফতহুল ক্বাদীর, কিতাবুল ফিক্বাহ, ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া, হিলইয়া, হাবিল কুদসী, ইলাউস সুনান, আহসানুল মাসায়িল, কিফায়া, নিহায়া, মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী, ফতওয়ায়ে সিরাজিয়া, গিয়াছিয়া, শাফিয়াহ, কিতাবুজ জিয়া, শরহে শামায়িল, গুনিয়াতুল মুছল্লী, ইমদাদুল আহকাম, ইলমুল ফিক্বাহ ইত্যাদি কিতাবের ভাষ্য হলো, তারাবীহ, ছলাতুল কুসূফ (সূর্য গ্রহণের নামায) ছলাতুল ইস্তেস্কা (বৃষ্টির নামায) এই তিন প্রকার নামায ব্যতীত অন্য যে কোন নফল নামায ইমামের সহিত চারজন মুক্তাদীসহ জামায়াতে আদায় করা সকল ইমাম, মুজতাহিদ ও ফুক্বাহা-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের ঐক্যমতে মাকরূহ তাহরীমী। যেমন,
وان اقتدى اربعة بواحد كره اتفاقا.
অর্থাৎ- “যদি ইমামের সাথে চারজন মুক্তাদী ইক্তিদা করে নফল নামায জামায়াতের সাথে পড়ে তাহলে সকল ইমাম, মুজতাহিদ ও ফুক্বাহা-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের সর্বসম্মত মতে মাকরূহ তাহরীমী।” কাজেই “শবে বরাত, শবে ক্বদর, রাগায়িব, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি নফল নামায জামায়াতে আদায় করা মাকরূহ তাহরীমী।” এ ফতওয়া দেয়ার কারণেই যদি পীরানে পীর, দস্তগীর হযরত বড়পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি মাকরূহ তাহরীমার অপবাদ হয় তাহলে বলতে হয় যে, উপরোক্ত সর্বজনমান্য, সর্বজন স্বীকৃত, বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহ ও ফওতয়ার কিতাবের মুছান্নিফ বা লিখক, ইমাম-মুজতাহিদ, ছলফে-সালিহীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণও কি রেযাখানীদের বক্তব্য মুতাবিক হযরত বড়পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি মাকরূহ তাহরীমীর অপবাদ দিয়েছেন? (নাউযুবিল্লাহ) মূলতঃ রেযাখানীরা রেযা খাঁ বাদে সকল বুযূর্গানে দ্বীনের প্রতি এরূপই ধারণা করে থাকে।
আরো উল্লেখ্য যে, শবে বরাত, শবে ক্বদর, রাগায়িব ইত্যাদি নফল নামায শুধু জামায়াতে আদায় করাই মাকরূহ তাহরীমী নয়; বরং শবে বরাত, শবে ক্বদর, রাগায়িব ইত্যাদি নফল নামায জামায়াতে আদায় করার জন্য ইক্তিদা করাও মাকরূহ তাহরীমী। যদি তাই হয় তাহলে যে সকল ইমাম মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ শবে বরাত, শবে ক্বদর, রাগায়িব ইত্যাদি নফল নামাযে ইক্তিদা করাই মাকরূহ তাহরীমীর ফতওয়া দিয়েছেন, সে সকল ইমাম মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের ক্ষেত্রে রেযাখানীরা কিছু বলবে কি?
যেমন, “ফতওয়ায়ে বাযযাযিয়াহ” কিতাবে উল্লেখ আছে,
كره الاقتداء فى صلاة الرغائب وصلاة البراءة ويلة القدر.
অর্থাৎ- “লাইলাতুল ক্বদর নামাযে, বরাতের নামাযে এবং রাগায়িবের নামাযে ইক্তিদা করা মাকরূহ তাহরীমী।” আদ দুররুল মুখতার কিতাবে উল্লেখ আছে,
يكره الاقتداء فى صلاة رغائب وبراءة وقدر.
অর্থাৎ- “ক্বদরের নামাযে, বরাতের নামাযে এবং রাগায়িবের নামাযে ইক্তিদা করা মাকরূহ তাহরীমী।” “গায়াতুল আওতার” কিতাবের ১ম খন্ডের ৩২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
مكروه ه… اقتداء كرنا صلوة رغائب ميى أور صلوة برائت اور صلوة قدر مي.
অর্থাৎ- “শবে ক্বদরের নামাযে, শবে বরাতের নামাযে এবং রাগায়িবের নামাযে ইক্তিদা করা মাকরূহ তাহরীমী।” সুতরাং রেযাখানীদের বক্তব্য মুতাবিক উপরোক্ত কিতাবের মুছান্নিফ বা লিখকগণও কি পীরানে পীর দস্তগীর হযরত বড়পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি মাকরূহ তাহরীমীর অপবাদ দিয়েছেন? (নাউযুবিল্লাহ) (চলবে) (উল্লেখ্য, রেযাখানীদের উপরোক্ত ভুলের সংশোধনীমূলক জাওয়াব মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ৮৬ তম সংখ্যাতে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৮৯ তম সংখ্যা হতে ধারাবাহিক ভাবে দেয়া হচ্ছে। )
মুহম্মদ ইরশাদুল আলম (সাজু)
সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত বাইমাইল শাখা, গাজীপুর।
সুওয়ালঃ মাসিক মদীনা আগস্ট/২০০২ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়। প্রশ্নঃ- আসর ও মাগরিবের নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে পবিত্র কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা যাবে কিনা? উত্তরঃ- উল্লেখিত সময়ে যে কোন ধরনের নামায পড়া মকরূহ। কোরআন তেলাওয়াত করা যেতে পারে। এখন আমার সুওয়াল হলো- মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? আর সত্যিই কি আছর ও মাগরিবের নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে যে কোন ধরণের নামায পড়া মাকরূহ এবং উল্লিখিত সময়ে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা যাবে কি? দলীল-আদিল্লাহসহ সঠিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন। জাওয়াবঃ আছর ও মাগরিবের নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ আছর নামাযের পর থেকে সূর্যের রং পরিবর্তন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই মধ্যবর্তী সময়ে যে কোন ধরণের নামায পড়া এবং কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা সম্পর্কে মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল, অশুদ্ধ এবং দলীলবিহীন হয়েছে। কারণ মাসিক মদীনার সম্পাদক জনাব মাহিউদ্দীন ছাহেব তার উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন দলীল-আদীল্লাহ পেশ করেনি। বরং দলীল বিহীন ও মনগড়া ভাবেই এধরণের ভুল বক্তব্য পেশ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ, সংশয় সৃষ্টি করেছে যা মূলতঃ ফিতনার কারণ। যেমন, প্রথমতঃ সে বলেছে, “উল্লিখিত সময়ে যে কোন ধরণের নামায পড়া মাকরূহ।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, মাসিক মদীনার সম্পাদক জনাব মাহিউদ্দীন ছাহেবের উক্ত বক্তব্য ডাহা মিথ্যা এবং বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবের সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরুদ্ধমত। কেননা, বিশ্বখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহে এটাই বলা হয়েছে যে, উল্লিখিত সময়ে অর্থাৎ আছর নামাযের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত বা সূর্যের রং পরিবর্তন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই মধ্যবর্তী সময়ে যে কোন ধরণের নামায পড়া মাকরূহ নয়। বরং উল্লিখিত সময়ে যে কোন ধরণের শুধুমাত্র নফল নামায পড়া মাকরূহ। সুতরাং আছর নামাযের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত এই মধ্যবর্তী সময়ে শুধুমাত্র নফল নামায ব্যতীত অন্যান্য নামায যেমন, ক্বাযা নামায অর্থাৎ ক্বাযায়ে আদার নামায, বিতর নামায, তিলাওয়াতে সিজদা এবং জানাযার নামায পড়া মাকরূহ নয়। যেমন, এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ফিক্বাহ-এর কিতাব “শরহে বিকায়া” কিতাবের ১ম খন্ডের ১৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
وكره النقل … بعد الصبح الا سنته وبعد اداء العصر الى اداء المغرب وصح الفوائت وصلوة الجنازة وسجدة التلاوة فى هذين اى بعد الصبح وبعد اداء العصر الى اداء المغرب.
অর্থঃ- “ছুবহে ছাদিক হওয়ার পর ফজর নামাযের সুন্নত ব্যতীত নফল নামায পড়া মাকরূহ এবং আছর নামায আদায় করার পর থেকে মাগরিবের নামায আদায় করার পূর্ব পর্যন্ত এই মধ্যবর্তী সময়ে নফল নামায পড়া মাকরূহ। তবে এই দু’য়ের মধ্যে অর্থাৎ ছুবহে ছাদিকের পর এবং আছর নামায আদায় করার পর থেকে মাগরিবের নামায আদায় করার পূর্ব পর্যন্ত এই মধ্যবর্তী সময়ে ক্বাযা নামায, জানাযার নামায এবং তিলাওয়াতে সিজদা আদায় করা ছহীহ বা বিশুদ্ধ হবে। অর্থাৎ ছুবহে ছাদিকের পর এবং আছর ও মাগরিব নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে ক্বাযায়ে আদার নামায, জানাযার নামায, তিলাওয়াতে সিজদা আদায় করা মাকরূহ নয়।”
“আল মুখতাছারুল কুদূরী” কিতাবের ৩১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ويكره ان يتنفل بعد صلوة الفجر حتى تطلع الشمس وبعد صلوة العصر حتى تغرب الشمس ولا بأس بان يصلى فى هذين الوقتين (اى بعد الفجر والعصر) الفوائت.
অর্থঃ- “ফজর নামাযের পর সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত এবং আছর নামাযের পর সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সর্বপ্রকার নফল নামায পড়া মাকরূহ। তবে এই দুই ওয়াক্তের মধ্যে অর্থাৎ ফজর নামাযের পর সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত এবং আছর নামাযের পর সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত এই দুই ওয়াক্তের মধ্যে ক্বাযা নামায পড়তে কোন অসুবিধা নেই। অর্থাৎ ফজর ও আছর নামাযের পর ক্বাযা নামায অর্থাৎ ক্বাযায়ে আদার নামায মাকরূহ নয়।” “বাহরুর রায়িক” কিতাবের ১ম খন্ডের ২৫১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
وعن التنفل بعد صلاة الفجر والعصر لاعن قضاء فائتة وسجدة تلاوة وصلاة جنازة أى منع عن التنفل فى هذين الوقتين.
অর্থঃ- “ফজর নামাযের পর এবং আছর নামাযের পর এই দুই ওয়াক্তের মধ্যে নফল নামায পড়া নিষেধ। তবে ফজর এবং আছর নামাযের পর ক্বাযা নামায, তিলাওয়াতে সিজদা এবং জানাযার নামায পড়া নিষেধ নয়।” একই বর্ণনা ফিক্বাহ ও ফতওয়ার নির্ভরযোগ্য সকল কিতাবেই উল্লেখ রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ মাসিক মদীনার সম্পাদক বলেছে, “উল্লিখিত সময়ে …… “কোরআন তেলাওয়াত করা যেতে পারে।” এর জবাবে বলতে হয় যে, মদীনার সম্পাদকের উক্ত বক্তব্যও সঠিক হয়নি। কারণ উল্লিখিত সময়ে অর্থাৎ আছর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত না করাই উত্তম। বরং আছর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত না করে দোয়া, দরূদ শরীফ, তাছবীহ-তাহলীল, যিকির-আযকার, মুরাকাবা-মুশাহাদা করাই উত্তম। কেননা, আছর এবং মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ে কিতাবাদী অধ্যয়ন না করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
যেমন, আমিরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন,
من احب كريمتيه فايكتبن بعد العصر.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি তার দু’চক্ষুকে মুহব্বত করে অর্থাৎ চোখের সুস্থতা কামনা করে, সে যেন আছরের পর লেখাপড়া না করে।”
কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করার উত্তম সময় উল্লেখ্য, হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
افضل العبادة تلاوة القران.
অর্থঃ- “(ফরয ইবাদতের পর নফল ইবাদতের মধ্যে) সর্বোত্তম (নফল) ইবাদত হলো কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা।” (কানযুল উম্মাল)
সুতরাং ফরয ইবাদতের পর কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করার উত্তম সময় রাত্র। আবার রাতের প্রথম ভাগ অপেক্ষা শেষ ভাগে তিলাওয়াত করা অধিক উত্তম। মাগরিব এবং ইশার মধ্যবর্তী সময়েও তিলাওয়াত করা ভাল। আর দিনের বেলায় কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করার উত্তম সময় হলো সূর্যোদয়ের ২৩ মিনিট পর থেকে।
উল্লেখ্য, আছর এবং মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত না করে দোয়া-দরূদ, তাছবীহ-তাহলীল, যিকির-আযকার, মুরাকাবা-মুশাহাদা করাই উত্তম। যেমন “বাহরুর রায়িক” কিতাবের ১ম খন্ডের, ২৫১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
الصلاة على النبى صلى الله عليه وسلم فى الاوقات التى تكره فيها الصلاة والدعاء والتسبيح افضل من قراءة القران.
অর্থঃ- “যে সকল ওয়াক্তে নামায পড়া মাকরূহ সে সকল মাকরূহ ওয়াক্ত সমূহে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করার চেয়ে তাছবীহ, দোয়া এবং দরূদ শরীফ পড়াই উত্তম।” অনুরূপ ‘দুররুল মুখতার, হাশিয়ায়ে মারাকিউল ফালাহ’ কিতাবে উল্লেখ আছে। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, উল্লিখিত সময়ে অর্থাৎ আছর নামাযের পর থেকে সূর্যের রং পরিবর্তন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়ে ক্বাযা নামায অর্থাৎ ক্বাযায়ে আদার নামায, বিতর নামায, তিলাওয়াতে সিজদা এবং জানাযার নামায পড়া মাকরূহ নয়। সুতরাং মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন যে বলেছে, “উল্লিখিত সময়ে যে কোন ধরনের নামায পড়া মাকরূহ। কোরআন তেলাওয়াত করা যেতে পারে।” তার এ বক্তব্য ভুল বলেই প্রমাণিত হলো। {দলীলসমূহঃ (১) ফতওয়ায়ে নাওয়াযিল, (২) আল মুখতাছারুল কুদূরী, (৩) হিদায়া, (৪) বিকায়া, (৫) নিহায়া, (৬) ইনায়া, (৭) বিনায়া, (৮) কিফায়া, (৯) কাফী, (১০) কুনিয়া, (১১) বুগীয়া, (১২) হিলইয়া, (১৩) হালবী, (১৪) শরহে ত্বহাবী (১৫) আততুহফা, (১৬) আল মুজতাবা, (১৭) আল কুহিস্তানী, (১৮) মুহীতে সারাখসী, (১৯) দিরায়া, (২০) খুলাছাতুল ফতওয়া, (২১) ফতওয়ায়ে কাজীখান, (২২) ফতওয়ায়ে বাযযাযিয়া, (২৩) ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, (২৪) তানবীরুল আবছার, (২৫) শরহে বিকায়া, (২৬) শরহে নিকায়া, (২৭) ফতহুল ক্বাদীর, (২৮) কানযুদ দাক্বায়িক, (২৯) আল লুবাব লিল মায়দানী, (৩০) বাহরুর রায়িক, (৩১) জাওহারাতুন নাইয়্যিরাহ, (৩২) শরহুল মাজমা, (৩৩) শরহে ইনায়া, (৩৪) শরহে দুরার, (৩৫) শরহে লুবাব, (৩৬) শরহে কানযুদ দাক্বায়িক্ব, (৩৭) শরহে মুনিয়াতুল মুছূল্লী, (৩৮) শরহে ইলইয়াস, (৩৯) আল খাব্বাযিয়া, (৪০) মিনহাতুল খালিক, (৪১) নূরুল হিদায়া, (৪২) নূরুদ দিরায়া, (৪৩) নূরুল ইজাহ, (৪৪) উমদাতুর রিয়াআ, (৪৫) আলমগীরী, (৪৬) দুররুল মুখতার, (৪৭) আইনুল হিদায়া, (৪৮) গায়াতুল আওতার, (৪৯) হাশিয়ায়ে তাহতাবী, (৫০) হাশিয়ায়ে মারাকিউল ফালাহ, (৫১) হাশিয়ায়ে চলপী, (৫২) নাহরুল ফায়িক, (৫৩) সিরাজীয়া, (৫৪) ফতওয়ায়ে ইতাবিয়া, (৫৫) তুহফাতুল ফিক্বাহ, (৫৬) আইনী, (৫৭) মা’য়াদানুল হাক্বায়িক্ব, (৫৮) ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া, (৫৯) শামী, (৬০) কিতাবুল ফিক্বাহ আ’লাল মাযাহিবিল আরবায়া, (৬১) আরকানে আরবায়া, (৬২) আহসানুল মাসায়িল ইত্যাদি। }
[ বিঃ দ্রঃ ইনশাআল্লাহ পরবর্তীতে বিস্তারিত জাওয়াব প্রদান করা হবে। অপেক্ষায় থাকুন। ]
মুহম্মদ তাজুল ইসলাম
সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত চান্দামারী শাখা, রাজারহাঁ, কুড়িগ্রাম
সুওয়ালঃ মাসিক রাহমানী পয়গাম আগস্ট/২০০২ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসার জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১০৪৩ নং জিজ্ঞাসার জবাব ছাপা হয়- জিজ্ঞাসাঃ টোাটের নিচে দাড়ীর যে অংশটুকু আছে সে অংশটুকু কাাঁ যাবে কিনা? অনেকে তা কেটে ছোঁ করে রাখে। এ ব্যাপারে সঠিক উত্তর জানালে সকলেই উপকৃত হব। জবাবঃ প্রশ্নে উল্লেখিত অংশটুকু যেহেতু দাড়ীর পরিমাণের সীমানায় পড়েনা তাই এই অংশটুকু কাাঁ যাবে। তবে একেবারে মুন্ডিয়ে ফেলা অনুচিত। এখন আমার সুওয়াল হলো- নিচের টোাটের লোম বা কেশ সম্পর্কে মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকার উক্ত জিজ্ঞাসার-জবাব সঠিক হয়েছে কি? দলীলসহ সঠিক জাওয়াব জানাবেন। জাওয়াবঃ নিচের টোাটের লোম বা কেশসমূহ কাাঁ ও মুন্ডন সম্পর্কে মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকার উক্ত জিজ্ঞাসার-জবাব সঠিক হয়নি। বরং ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে।
নিমদাড়ির পরিচয় ও তার আহকাম
উল্লেখ্য, নিচের ঠোঁট ও থুতনির মধ্যবর্তী এবং নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তীর ডান ও বাম উভয় পার্শ্বের ছোঁ ছোঁ লোম বা কেশসমূহকে বা ছোঁ ছোঁ দাড়িকে নিমদাড়ি বা বাচ্চা দাড়ি বলা হয়। আর নিমদাড়ি এটা আলাদা কোন দাড়ি নয় বরং এটা মূল দাড়িরই অন্তর্ভুক্ত। তার শরয়ী আহকাম হলো এই যে, নিমদাড়ি কাাঁ, ছাাঁ, মুন্ডন করা বা চেঁেছ ফেলা সম্পূর্ণই বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ ও মাকরূহ তাহরীমী। মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকায় বলা হয়েছে, “প্রশ্নে উল্লেখিত অংশটুকু যেহেতু দাড়ীর পরিমাণের সীমানায় পড়েনা তাই এই অংশটুকু কাাঁ যাবে। …..” এর জবাবে বলতে হয় যে, নিমদাড়ি আলাদা কোন দাড়ি নয়। বরং মূল দাড়িরই অন্তর্ভুক্ত। অথচ মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকার কর্তৃপক্ষ এবং তাদের সমজাতীয়রা জিহালতির কারণে উক্ত নিমদাড়িকে দাড়ি হিসেবে গণ্য না করে এবং তা কেটে ফেলে, মুন্ডন করে বা চেছে ফেলে নিজেরা যেমন বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ ও মাকরূহ তাহরীমী কাজে লিপ্ত হয়েছে তেমন এ ধরণের ভুল বক্তব্য পেশ করে সাধারণ মানুষকেও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ ও মাকরূহ তাহরীমী কাজে উদ্বুদ্ধ করছে।
এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফের বিখ্যাত শরাহ “ফয়জুল বারী” কিতাবের ৪র্থ খন্ডের ৩৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
فان قطع الاشعار التى على وسط الشفة السفلى أى العنغقة بدعة ويقال لها (ريش بچہ)
অর্থঃ- “নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তী লোম বা কেশসমূহ কাাঁ বা ছাাঁ বিদয়াত অর্থাৎ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। আর নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তী লোম বা কেশসমূহকে বলা হয় বাচ্চা দাড়ি বা নিমদাড়ি।” “ফতওয়ায়ে আলমগীরী” কিতাবের ৫ম খন্ডের ৩৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ونتف القنيكين بدعة وهما جانبا العنفقة وهى شعر السفة السفلى كذا فى الغرائب.
অর্থঃ- “নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তী এবং নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তীর উভয় পার্শ্বের ছোঁ ছোঁ লোম বা কেশসমূহ উপড়ানো বা মুন্ডন করা বিদয়াত অর্থাৎ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। আর এটা হলো নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তী এবং তার ডান, বাম উভয় পার্শ্বের ছোঁ ছোঁ লোম বা কেশসমূহ। অর্থাৎ নিচের টোাটের নিম্নবর্তী সমস্ত ছোঁ ছোঁ লোম বা কেশ যাকে নিমদাড়ি বলা হয় তা উপড়ানো বা মুন্ডন করা বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। অনুরূপ ‘গারায়িব’ কিতাবেও উল্লেখ আছে।” “ফওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের ৯ম খন্ডের ৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
اور فنیلتین کا نوچنا بدعت ھی اور واضح ھو کہ نیچے کے ھونٹہ کے بیچ مین ڈاڑھی تک جوبال ھین اسکے دونون طرف اگر بال جمے ھون تووہ فنیلتین ھین.
অর্থঃ- “নিচের টোাঁ এবং থুতনির মধ্যবর্তী এবং নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তীর উভয় পার্শ্বের চুলসমূহ চেছে ফেলা বা মুন্ডন করা বিদয়াত। অর্থাৎ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। প্রকাশ থাকে যে, নিচের টোাঁ এবং থুতনির (দাড়ির) মধ্যবর্তী স্থানে যে সমস্ত চুল রয়েছে তার দুই পার্শ্বে যদি চুল জমা বা একত্রিত থাকে তাকেই (فنيلتين) বলা হয়।”
উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তী এবং নিচের টোাঁ ও থুতনির মধ্যবর্তীর ডান ও বাম উভয় পার্শ্বের ছোঁ ছোঁ লোম বা কেশসমূহকে নিমদাড়ি বা বাচ্চা দাড়ি বলা হয়। আর সেই সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, নিমদাড়ি বা বাচ্চা দাড়ি কাাঁ, ছাাঁ, মুন্ডন করা বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ ও মাকরূহ তাহরীমী।
আরো উল্লেখ্য যে, নিমদাড়ি যেহেতু মূল দাড়িরই অংশ। সেহেতু এটাকে নিমদাড়ি বা বাচ্চা দাড়ি বলা হয়। সুতরাং নিমদাড়ি বা বাচ্চা দাড়ি কাাঁ, ছাাঁ, মুন্ডন করা থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্যেই দায়িত্ব ও কর্তব্য।
অতএব, মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকার উক্ত বক্তব্য ভুল বলেই প্রমাণিত হলো। {দলীলসমূহঃ (১) ফয়জুল বারী, (২) আল গারায়িব, (৩) ফতওয়ায়ে আলমগীরী, (৪) শামী, (৫) আল মানহাল, (৬) ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া ইত্যাদি।
[ বিঃ দ্রঃ ইনশাআল্লাহ পরবর্তীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত ফতওয়া দেয়া হবে। অপেক্ষায় থাকুন। ]
মুহম্মদ শহীদুল ইসলাম (শামীম)
সভাপতি- আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত হাঁহাজারী, চট্টগ্রাম
সুওয়ালঃ হাঁহাজারী মাদরাসা থেকে প্রকাশিত মাসিক মুঈনুল ইসলাম আগষ্ট/২০০২ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে পাগড়ী পরিধান করা সম্পর্কে নিম্নোক্ত জিজ্ঞাসা সমাধান ছাপা হয়। জিজ্ঞাসাঃ পাগড়ী পরে নামায পড়লে প্রতি রাকআতে কি পরিমাণ সাওয়াব পাওয়া যায়? পাগড়ীর দৈর্ঘ এবং তার শিমলার দৈর্ঘ কতটুকু হবে? তাছাড়া জায়নামাযে দাঁড়ানোর পর আমরা যে দোয়া পড়ি এটা পড়া কি ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত বা মুস্তাহাব? সমাধানঃ পাগড়ী পরা সুন্নাত ও মুস্তাহাব। তবে পাগড়ী পরে নামায পড়লে প্রতি রাকআতে কি পরিমাণ সাওয়াব হবে তা কোন সহীহ হাদীসে উল্লেখ নেই। বিভিন্ন কিতাবে পাগড়ী পরে নামায পড়লে প্রতি রাকআতে সত্তর রাকআতের সাওয়াব পাওয়ার কথা যে বলা হয়েছে, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ এ মর্মের হাদীসটি সহীহ নয়, বরং মওজু তথা মনগড়া। …….. এখন আমার সুওয়াল হলো- পাগড়ী পরিধান করা সম্পর্কে মাসিক মুঈনুল ইসলাম পত্রিকার উক্ত জিজ্ঞাসার-সমাধান সঠিক হয়েছে কি? দলীলসহ সঠিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন। জাওয়াবঃ না, পাগড়ী পরিধান করে নামায পড়া সম্পর্কে হাঁহাজারীর অখ্যাত পত্রিকার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়নি। কারণ পাগড়ী পরিধান শুধু সুন্নতই নয়; বরং দায়িমী সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। হাঁহাজারীর অখ্যাত পত্রিকায় বলা হয়েছে, “পাগড়ী পড়া … মুস্তাহাব।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, পাগড়ী পরিধান করা মুস্তাহাব নয়। বরং পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত। যেমন, বুখারী শরীফের বিখ্যাত শরাহ “উমদাতুল ক্বারী” কিতাবের ২১তম খন্ডের ৩০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
جاء رجل الى ابن عمر رضى الله عنه فقال يا ابا عبد الرحمن العمامة سنة؟ فقال نعم.
অথঃ- “একদা এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে এসে জিজ্ঞাসা করল, হে আবু আব্দুর রহমান (যা ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর অপর নাম) পাগড়ী পরা কি সুন্নত? তিনি উত্তরে বললেন, হাঁ পাগড়ী পরা সুন্নত।” অনুরূপ ‘খছাইলে নববী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ কিতাবের ৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। “আরিদ্বাতুল আহওয়াযী” কিতাবের ৭ম খন্ডের ২৪৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
العمامة سنة الرأس وعادة الانبياء والسادة
অর্থঃ- “পাগড়ী মাথায় পরিধান করা সুন্নত এবং সমস্ত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ও সর্দারগণের অভ্যাসগত আমল।” “তিরমিযী শরীফের” ১ম খন্ডের ২০৭ পৃষ্ঠার হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,
عمامة سنت ست.
অর্থঃ- “পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত।” “শামাইলুত তিরমিযী” কিতাবের ৮ম পৃষ্ঠার হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,
ان لبس العمامة سنة.
অর্থঃ- “ নিশ্চয়ই পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত।” “আরিদ্বাতুল আহওয়াযী” ৭ম খন্ডের ২৪৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
السنة ان تلبس القلنسوة والعمامة.
অর্থঃ- “টুপি এবং পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত।” “জামউল ওয়াসাইল” কিতাবের ১ম খন্ডের ২০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
قال ابن الجوزى قال بعض العلماء السنة ان يلبس القلنسوة والعمائم.
অর্থঃ- “হযরত ইবনে জাওযী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অধিকাংশ উলামা-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের মতে, টুপি এবং পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত।”
“মিরকাত শরীফের” ৮ম খন্ডের ২৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
السنة ان يلبس القلنسوة والعمامة.
অর্থঃ- “টুপি ও পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত।” “শামাইলু বি শরহিল মানাবী” কিতাবের ১ম খন্ডের ২০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
والسنة ان يلبس القلنسوة والعمامة.
অর্থঃ- “টুপি এবং পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত।”
উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত হলো যে, পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত এবং একইভাবে এটাও প্রমাণিত হলো যে, টুপি পরিধান করা যেমন সুন্নত অনুরূপভাবে পাগড়ী পরিধান করাও সুন্নত। সুতরাং টুপি পরিধান করাকে যেমন মুস্তাহাব বলা হয় না অনুরূপভাবে পাগড়ী পরিধান করাকেও মুস্তাহাব বলা যাবেনা।
আরো উল্লেখ্য যে, পাগড়ী পরিধান করা শুধু সুন্নতই নয় বরং দায়িমী সুন্নত। যেমন, “মিশকাত শরীফ” কিতাবের ৩৭৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن عبادة رضى الله عنه قال قال رسول اله صلى الله عليه وسلم عليكم بالعمائم فانها سيماء الملائكة وارخوها خلف ظهوركم.
অর্থঃ- “হযরত উবাদা ইবনে সামিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের জন্য পাগড়ী পরিধান করা জরুরী বা অবধারিত। কেননা তা ফেরশতাগণের নিদর্শণ স্বরূপ। আর এর (পাগড়ীর) শামলা তোমাদের পিছনে পিঠের উপর ছেড়ে দাও।”
উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় পাগড়ী পরিধান করা দায়িমী সুন্নত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, “ফাইদুল ক্বাদীর শরহে জামিউছ ছগীর লিল মানাবী” ৪র্থ খন্ডের ৪৫৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
(عليكم بالعمائم) اى داوموا لبسها.
অর্থঃ- “(عليكم بالعمائم ‘তোমাদের উপর পাগড়ী পরিধান অবধারিত) অর্থাৎ তোমরা তা(পাগড়ী) দায়িমী বা সার্বক্ষণিকভাবে পরিধান কর।” “আশয়াতুল লুময়াত” কিতাবের ৩য় খন্ডের ৫৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
(عليكم بالعمائم) برشماباد ..وشيدن دستارها.
অর্থঃ- “(ম্ল“ৈরূহৃঞ্জব্দব্জম্লৈহৃব্জুহৃ ‘তোমাদের উপর পাগড়ী পরিধান অবধারিত) অর্থাৎ তোমাদের মাথার উপর দায়িমী বা সার্বক্ষণিকভাবে পাগড়ী বেঁধে রাখ।” “মিরয়াতুল মানাজীহ” কিতাবের ৬ষ্ঠ খন্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
(عليكم بالعمائم) هميشه يأ نما ز ك .. وقت عمامه باندها كره.
অর্থঃ- “(عليكم بالعمائم তোমাদের উপর পাগড়ী পরিধান অবধারিত) অর্থাৎ হামেশা বা দায়িমীভাবে পাগড়ী পরিধান কর। এমনকি নামাযের সময়ও পাগড়ী বাঁধ।” “ফতহুল বারী” কিতাবে উল্লেখ আছে,
عمامہ کا باند ھنا سنت مستمرہ ھے نبی اکرم صلی اللہ علیہ وسلم سے عما مہ باندھنے کا حکم بھی نقل کیا گیا ھے چنا نچہ ارشاد ھے کہ عمامہ باندھا کرو اس سے حلم میں بڑہ جاوگے (فتح الباری)
অর্থঃ- “ইমামাহ বা পাগড়ী পরিধান করা সুন্নতে মুস্তামেররা তথা দায়িমী সুন্নত। হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে পাগড়ী বাঁধার হুকুম (নির্দেশ) এভাবে এসেছে যে, তোমরা পাগড়ী বাঁধ। এতে গাম্ভীর্যতা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।” (অনুরূপ ‘খছাইলে নববী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ কিতাবের ৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে)
অতএব, প্রমাণিত হলো পাগড়ী পরিধান করা সুন্নত তো বটেই বরং দায়িমী সুন্নত।
অতএব, যেটা সুন্নত সেটাকে সুন্নতই বলতে হবে। ইহানত করে, অবজ্ঞা করে বা তুচ্ছ-তাছিল্য করে সুন্নতকে হালকা করার ও আমলে গুরুত্ব না দেয়ার লক্ষ্যে কখনও মুস্তাহাব বলা যাবেনা। কারণ সুন্নতকে ইহানত করা কুফরী। যেমন, এ প্রসঙ্গে আক্বাঈদের কিতাবে উল্লেখ আছে,
اهانة السنة كفر.
অর্থঃ- “সুন্নতের অবজ্ঞা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।” দ্বিতীয়তঃ হাঁহাজারীর জাহিল মৌলভীরা বলেছে, “….. তবে পাগড়ী পরে নামায পড়লে প্রতি রাকআতে কি পরমাণ সাওয়াব হবে তা কোন সহীহ হাদীসে উল্লেখ নেই। বিভিন্ন কিতাবে পাগড়ী পরে নামায পড়লে প্রতি রাকআতে সত্তর রাকআতের সাওয়াব পাওয়ার কথা যে বলা হয়েছে, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ এ মর্মের হাদীসটি সহীহ নয়, বরং মওজু তথা মনগড়া। ……”
এর জবাবে বলতে হয় যে, হাঁহাজারীর জাহিল মৌলভীদের উক্ত বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, তারা হাদীস শরীফ ও তার উছূল সম্পর্কে নেহায়েতই অজ্ঞ। কারণ ছওয়াব বা ফযীলতের ক্ষেত্রে ছহীহ হাদীস শরীফ থাকা শর্ত নয়। বরং ছওয়াব ও ফযীলতের ক্ষেত্রে জঈফ হাদীস শরীফই যথেষ্ট।
যেমন, “তাফসীরে জালালাইন শরীফের” ৩৫৭ পৃষ্ঠার ১৩ নং হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,
قد صح من العلماء تجويز الاخذ بالحديث الضعيف فى العمليات.
অর্থাৎ- “আমলের ক্ষেত্রে জঈফ হাদীস শরীফকে গ্রহণ করা জায়িয। এ মতটিকে অধিকাংশ উলামা-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ ছহীহ বা বিশুদ্ধ বলেছেন। কিন্তু এরপরেও কিছু কিছু লোক তাদের কিল্লতে ইলমের কারণে, স্বল্পজ্ঞানের কারণে, বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।”
এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহের বিশ্ব বিখ্যাত কিতাব “ফতহুল ক্বাদীর” কিতাবে উল্লেখ আছে,
الاستحباب يثبت بالضعيف.
অর্থঃ- “জঈফ হাদীস শরীফ দ্বারা মুস্তাহাব (ফযীলত) প্রমাণিত হয়।” বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ হযরত ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “মওজুআতুল কবীর” কিতাবের ১০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
الضعيف يعمل به فى فضائل الا عمال اتفاقا.
অর্থঃ- “সকলেই একমত যে জঈফ হাদীস শরীফ ফযীলত হাছিল করার জন্য আমল করা জায়িয।” অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ছওয়াব বা ফযীলতপূর্ণ আমলের ক্ষেত্রে জঈফ হাদীস শরীফই যথেষ্ট। আর পাগড়ী পরিধান করে নামায আদায় করার ফযীলতপূর্ণ হাদীস শরীফখানা সম্পর্কে সব ধরণের বর্ণনা রয়েছে।
অথচ হাঁহাজারীর মৌলভীরা অন্যান্য বর্ণনাগুলো এড়িয়ে তাদের হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শুধুমাত্র ছহীহ নয় বরং মওজু তথা মনগড়া বলে উল্লেখ করেছে।
যেমন, মিশকাত শরীফের বিখ্যাত ও মশহুর শরাহ “মিরকাত শরীফের” ২য় খন্ডের ২৩৯ পৃষ্ঠায় হাদীস শরীফের কিতাব “দাইলামী শরীফের” বরাত দিয়ে উক্ত হাদীস শরীফখানা মরফু হিসেবে উল্লেখ করেছে।
اورده الديلمى من حديث ابن عمر م فوعا صلاة بعمامة تعدل بخمس وعشرين صلاة وجمعة بعمامة تعدل سبعين جمعة.
অর্থঃ- “হযরত দাইলামী রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে মারফু হাদীস বর্ণনা করেন যে, পাগড়ীসহ এক ওয়াক্ত নামায পাগড়ী ছাড়া পঁচিশ ওয়াক্ত নামাযের থেকে উত্তম। আর পাগড়ীসহ একটি জুমুয়া আদায় করলে পাগড়ী ছাড়া সত্তরটি জুমুয়া আদায়ের সমপরিমাণ ছওয়াব পাওয়া যায়।” উক্ত কিতাবে আরো উল্লেখ আছে,
ومن حديث أنس مرفوعا الصلاة فى العمامة بعشر.
অর্থঃ- “হযরত আনাছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে মারফু হাদীস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, পাগড়ীসহ নামায আদায় করলে দশগুণ ছওয়াব লাভ হয়।” “মিরকাত শরীফের” ৮ম খন্ডের ২৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
وروى ابن عساكر عن ابن عمر مرفوعا صلاة تطوع او فريضة بعمامة تعدل خمسا وعشرين صلاة بلاعمامة وجمعة بعمامة تعدل سبعين جمعة بلاعمامة فهذا كله يدل على فضيلة العمامة مطلقا.
অর্থঃ- “হযরত ইবনে আসাকির রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে মারফু হাদীস বর্ণনা করেন যে, পাগড়ীসহ একটি ফরয অথবা নফল নামাযে পাগড়ী ছাড়া পঁচিশটি ফরয অথবা নফল নামাযের সমান ছওয়াব পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে পাগড়ীসহ একটি জুমুয়া আদায় করলে পাগড়ী ছাড়া সত্তরটি জুমুয়া আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। সাধারণতঃ এটা দ্বারা পাগড়ী পরিধানের ফযীলতের দলীল সাব্যস্ত হয়।”
“তুহফাতুল আহওয়াযী” কিতাবের ৫ম খন্ডের ৪১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
رواه ابن عساكر والديلمى عن ابن عمر مرفوعا: صلاة تطوع او فريضة بعمامة تعد خمسا وعشرين صلاة بلا عمامة وجمعة ببعمامة تعدل سبعين جمعة بلاعمامة.
অর্থঃ- “হযরত ইবনে আসাকির ও দাইলামী রহমতুল্লাহি আলাইহিমা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে মারফু হাদীস বর্ণনা করেন যে, পাগড়ীসহ একটি ফরয অথবা নফল নামাযে পাগড়ী ছাড়া পঁচিশটি ফরয অথবা নফল নামাযের সমান ছওয়াব পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে পাগড়ীসহ একটি জুমুয়া আদায় করলে পাগড়ী ছাড়া সত্তরটি জুমুয়া আদায়ের সমপরিমাণ ছওয়াব পাওয়া যায়।” “মিরকাত শরীফের” ২য় খন্ডের ২৩৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
وروى انه عليه السلام قال صلاة بعمامة افضل من سبعين صلاة ببغير عمامة كذا نقله ابن حجر.
অর্থঃ- বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, পাগড়ীসহ এক ওয়াক্ত নামায পাগড়ী ছাড়া সত্তর ওয়াক্ত নামাযের থেকে উত্তম। অনুরূপ বর্ণনা হযরত ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহিও বর্ণনা করেছেন।”
এছাড়াও হাদীস শরীফের বিখ্যাত শরাহ গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ আছে যে, পাগড়ী পরিধান করে এক রাকায়াত নামায আদায় করলে সত্তর রাকায়াত ফযীলতের কথা উল্লেখ আছে। যেমন, “শামাইলুত তিরমিযী” কিতাবের ৮ পৃষ্ঠার হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,
ان ركعتين مع العمامة افضل من سبعين ركعة بدونها.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই পাগড়ী পরিধান করে দু’রাকায়াত নামায আদায় করা, পাগড়ী ছাড়া সত্তর রাকায়াত নামায আদায় করার চেয়ে অধিক ফযীলতপূর্ণ।” “মিরয়াতুল মানাজীহ” কিতাবের ৬ষ্ঠ খন্ডের ১০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
بغیر عمامہ کی 70 نمازیں اور عمامہ سے ایک نماز برابر ھے.
অর্থঃ- “পাগড়ী ছাড়া সত্তর রাকায়াত নামাযের ছওয়াব পাগড়ীসহ এক রাকায়াত নামাযের সমপরিমাণ ছওয়াবতুল্য।”
“তিরমিযী শরীফের” ১ম খন্ডের ২০৭ পৃষ্ঠার হাশিয়ায় উল্লেখ আছে,
بداں کہ پوشیدن عما مہ سنت ست واحادیث بسیار در فضل ان وارد شدہ وامدہ است کہ دو رکعت بعمامہ بھترست از ھفتاد رکعت بے عمامہ.
অর্থঃ- “পাগড়ী মাথায় বেঁধে রাখা সুন্নত। অসংখ্য হাদীস শরীফে এর ফযীলত আলোচিত হয়েছে। যেমন, পাগড়ীসহ দু’রাকায়াত নামায পাগড়ী ছাড়া সত্তর রাকায়াত নামাযের চেয়ে উত্তম।” (অনুরূপ আশয়াতুল লুময়াত ৩য় খন্ডের, ৫৮৩ পৃষ্ঠায়, তরজমাতুল মিশকাত, উরফুশ শাজী কিতাবে উল্লেখ আছে) “হিদায়াতুল ইবাদ” কিতাবের ৬৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
فى الحديث جمعة بعمامة افضل من سبعين صلاة بلا عمامة.
অর্থঃ- “হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, পাগড়ীসহ এক জুমুয়ার নামায পাগড়ী ছাড়া সত্তর জুমুয়ার নামায অপেক্ষা উত্তম।” “কাশফুল খফা ওয়া মুযীলুল ইলবাস” ২য় খন্ডের ৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن جار رضى الله عنه ركعتان بعمامة افضل من سبعين من غيرها.
অর্থঃ- “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, পাগড়ীসহ দু’রাকায়াত নামায পাগড়ী ছাড়া সত্তর রাকায়াত নামায থেকে উত্তম।” বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পাগড়ী পরিধান করে নামায আদায় করার যে ফযীলত সম্পন্ন কিতাব রয়েছে সেগুলো অনুসরণীয় ইমাম মুজতাহিদ, সলফে ছলিহীন রহমতুল্লাহি আইহিমগণেরই নিজস্ব লিখিত কিতাব।
যেমন, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম দায়লামী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার লিখিত ‘আল ফিরদাউস’ কিতাবে, বিখ্যাত মুহাদ্দিস, হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মিশকাত শরীফের বিশ্বখ্যাত শরাহ ‘মিরকাত শরীফে,’ জগতখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ হযরত আব্দুল হক মুহাদ্দিস রহমতুল্লাহি আলাইহি তার ‘আশয়াতুল লুমআত’ কিতাবে পাগড়ী পরিধান করে নামায আদায়ে উক্ত ফযীলত-এর কথা বর্ণনা করেছেন। কাজেই পাগড়ী পরিধান করে নামায আদায় করার ফযীলত সম্পর্কিত বর্ণনাটি যদি মনগড়া হয়, তাহলে হাঁহাজারীর জাহিল মৌলভীদের দলীলবিহীন মনগড়া বক্তব্য মুতাবিক উপরোক্ত ইমাম-মুজতাহিদ সলফে ছলিহীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ কি উনাদের জগতখ্যাত নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলোতে মনগড়া হাদীস বর্ণনা করেছেন? (নাউযুবিল্লাহ) কখনোই নয়। অতএব, হাঁহাজারী মাদরাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত পত্রিকার বক্তব্য ভুল বলে প্রমাণিত হলো।
[ বিঃ দ্রঃ পাগড়ী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর ৮৩তম সংখ্যা থেকে ৯৬তম সংখ্যার ফতওয়া বিভাগ পাঠ করুন। সেখানে প্রায় ১৫০০ দলীল-আদিল্লাহ দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, পাগড়ী পরিধান করা দায়িমী সুন্নত। ]