অস্পৃশ্য, ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং কথিত মনুসংহিতা ও বিবিধ প্রসঙ্গ।
কথিত নারীবাদীরা নারী অধিকার বলতে যা বোঝায় তাতে তাদেরকে সর্বাগ্রে হিন্দুধর্ম উঠিয়ে দিতে হবে, মুনসংহিতা কেটে-ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
কিন্তু হিন্দু ধর্মের স্পষ্ট নারীর বেইজ্জতী বর্ণনার প্রতি কোনো অঙ্গুলী নির্দেশ না করে, অযথাই ইসলামের উপর একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা নেহায়েত তাদের দুরভিসন্ধি এবং নিখাদ ইসলাম বিদ্বেষী মনোবৃত্তি।
শতকরা ৯৭ ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠী তথা প্রায় ১৬ কোটি মুসলমানের উচিত- এসব ষড়যন্ত্র ও নারীবাদীদের কঠোর হস্তে দমন করা।
ইসলামই একমাত্র দ্বীন, যেখানে নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান ও অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তথাকথিত নারীবাদীরা নারী অধিকারের নামে যেন একের পর এক ইসলামী বিধি বিধানের উপর আঘাত হানতে উদ্যত।
মূলত এটা তাদের ইচ্ছাকৃত এবং দুরভিসন্ধিমূলক ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র।
ইসলাম নারীদের যে সম্মান, পবিত্রতা ও অধিকার দিয়েছে তা আদৌ তুলে ধরে না। অপরদিকে হিন্দু ধর্মে খোদ মনুসংহিতায় যেভাবে নারীদের অবমাননাকরভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা তারা আদৌ ব্যক্ত করেনা। এতে নারীরা যে চরম নিগৃহীত, লাঞ্ছিত অবস্থায় রয়েছে সেসব কথা তারা তুলে ধরে না।
অথচ কথিত নারী অধিকার রক্ষার্থে নারী আন্দোলন চালাতে কথিত নারীবাদীদের সর্বাগ্রে হিন্দু ধর্মের বিষয়ে তেতে উঠা উচিত
ক্ষেপে উঠা উচিত
ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত।
নারী অধিকার বলতে তারা যা ব্যক্ত করে সে অনুযায়ী
সর্বাগ্রে তাদেরকে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়। মুনসংহিতা ফেঁড়ে-ছিঁড়ে ফেলতে হয়।
মনুসংহিতায় স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে প্রসঙ্গত
তা তুলে ধরা হলো-
স্ত্রীণাং সুখোদ্যমক্রূরং বিস্পষ্টার্থং মনোহরম্।
মঙ্গল্যং দীর্ঘবর্ণান্তমাশীর্বাদাভিধানবৎ।। (২/৩৩)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোকদের পক্ষে এমন নাম রাখতে হবে- যে নাম সুখে উচ্চারণ করতে পারা যায় অর্থাৎ স্ত্রীলোক ও বালকেরাও যে নাম অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারে (যেমন যশোদাদেবী; এই নাম দুরুশ্চারণাক্ষরহীন হবে, যেমন ‘সুশ্লিষ্টাঙ্গী’ এই রকম নাম হবে না), সে নাম যেন ক্রূরার্থের প্রকাশক না হয় (অর্থাৎ ডাকিনী, পরুষা প্রভৃতি নাম হবে না), যে নাম বিস্পষ্টার্থ হবে (অর্থাৎ অনায়াসে যে নামের অর্থবোধ হয়; ‘কামনিধা’, ‘কারীষগন্ধী’ প্রভৃতি যে সব নামের অর্থ স্পষ্ট নয় এমন নাম হবে না), যে নাম হবে মনোহর অর্থাৎ চিত্তের আহ্লাদজনক (যেমন শ্রেয়সী; কিন্তু ‘কালাক্ষী’ জাতীয় নাম মনের সুখ উৎপাদন করে না), যে নাম মঙ্গলের বাচক হয় (যেমন চারুমতী, শর্মমতী; বিপরীত নাম যেমন ‘অভাগা’, ‘মন্দভাগ্যা’ প্রভৃতি হবে না), যে নামের শেষে দীর্ঘ স্বর থাকে
(যেমন ‘ঈ’কার, আ-কার যুক্ত নাম), যে নামের উচ্চারণে আশীর্বাদ বোঝায় (যেমন ‘সপুত্রা’, ‘বহুপুত্রা’ প্রভৃতি)।
যাই হোক, পুরুষের ভোগ্যসামগ্রি হিসেবে স্ত্রীলোকের একটি সুন্দর নাম যে তাকে ভোগের ক্ষেত্রেও মানসিক পরিতৃপ্তিজনক ক্ষেত্র বা আবহ তৈরি করে, বৈদিক ঈশ্বরের মনেও তা রেখাপাত
করতে পেরেছে বলে মনে হয়।
প্রশ্ন উঠে, ঈশ্বর কি তাহলে পুরুষ সম্প্রদায়ের কেউ? অবশ্য মনুসংহিতায় সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ব্রহ্মা তো পুরুষগুণবাচকই। সেভাবেই তাঁকে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
মনুসংহিতায় নারীকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে তা মনুর শ্লোক
থেকেই ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়-
ক্ষেত্রভূতা স্মৃতা নারী বীজভূতঃ স্মৃতঃ পুমান্।
ক্ষেত্রবীজসমাযোগাৎ সম্ভবঃ সর্বদেহিনাম্।। (৯/৩৩)
বঙ্গানুবাদ: নারী শস্যক্ষেত্রের মতো, আর পুরুষ শস্যের বীজস্বরূপ। এই ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগে সকল প্রাণীর উৎপত্তি।
বীজস্য চৈব যোন্যাশ্চ বীজমুৎকৃষ্টমুচ্যতে।
সর্বভূতপ্রসূতির্হি বীজলক্ষণলক্ষিতা।। (৯/৩৫)
বঙ্গানুবাদ: বীজ ও যোনি এই দুটির মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ বলে কথিত হয়। কারণ, সর্বত্র সন্তান বীজের লক্ষণযুক্ত হয়ে থাকে। শাস্ত্রীয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত মনুশাস্ত্রে শস্যক্ষেত্ররূপী নারীর চেয়ে বীজরূপ পুরুষেরই শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে তা কি আর বলতে হয় ! কথিত তবে শাস্ত্র এটা প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি। নারী যে একটা নিকৃষ্ট কামজ সত্তা তা প্রমাণেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে-
স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ্ দূষণম্।
অতোহর্থান্ন প্রমাদ্যন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ।। (২/২১৩)
বঙ্গানুবাদ: ইহলোকে (শৃঙ্গার চেষ্টার দ্বারা মোহিত করে) পুরুষদের দূষিত করাই নারীদের স্বভাব; এই কারণে প-িতেরা স্ত্রীলোকসম্বন্ধে কখনোই অনবধান হন না।
মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা না বিবিক্তাসনো ভবেৎ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি।। (২/২১৫)
বঙ্গানুবাদ: মাতা, ভগিনী বা কন্যার সাথে কোনও পুরুষ নির্জন গৃহাদিতে বাস করবে না, কারণ ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান্ (চঞ্চল) যে, এরা (শাস্ত্রালোচনার দ্বারা আত্মসংযম অভ্যাস করতে পেরেছেন এমন) বিদ্বান্ ব্যক্তিকেও আকর্ষণ করে (অর্থাৎ কামক্রোধাদির বশবর্তী করে তোলে)।
অর্থাৎ তথাকথিত শাস্ত্রজ্ঞ হয়েও আসলে পুরুষ অভব্যই হয়, এবং তার দুরাচারকে সুকৌশলে ব্রহ্মবাক্য দিয়ে শেষপর্যন্ত
নারীর উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
নারী যে আসলে মানুষ নয়, অন্যান্য ভোগ্যবস্তুর মতোই পুরুষের ব্যবহারযোগ্য উপভোগের সামগ্রী মাত্র তা নিচের শ্লোক থেকে বুঝতে কি কোন সমস্যা হয় ?
স্ত্রিয়ো রত্নান্যথো বিদ্যা ধর্মঃ শৌচং সুভাষিতম্।
বিবিধানি চ শিল্পানি সমাদেয়ানি সর্বতঃ।। (২/২৪০)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রী, রত্ন (মণি-মাণিক্য), বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতবাক্য এবং বিবিধ শিল্পকার্য সকলের কাছ থেকে সকলেই গ্রহণ করতে পারে।
মনুশাস্ত্রে আসলে নারীর স্বাধীনতা কখনোই স্বীকার করা হয়নি-
বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।
ন স্বাতস্ত্র্যেণ কর্তব্যং কিঞ্চিৎ কার্যং গৃহেষ্বপি।। (৫/১৪৭)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক বালিকাই হোক, যুবতীই হোক কিংবা বৃদ্ধাই হোক, সে গৃহমধ্যে থেকে কোনও কাজই স্বামী প্রভৃতির অনুমতি ছাড়া করতে পারবে না।
বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পানিগ্রাহস্য যৌবনে।
পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম্।। (৫/১৪৮)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক বাল্যাবস্থায় পিতার অধীনে থাকবে, যৌবনকালে পাণিগ্রহীতার অর্থাৎ স্বামীর অধীনে থাকবে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রদের অধীনে থাকবে। (পুত্র না থাকলে স্বামীর সপি-, স্বামীর সপি- না থাকলে পিতার সপি- এবং পিতার সপি- না থাকলে রাজার বশে থাকবে), কিন্তু কোনও অবস্থাতেই স্ত্রীলোক স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না।
উল্লেখ্য যে, সপি- মানে যিনি মৃতব্যক্তির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পি- দানের যোগ্য। হিন্দুশাস্ত্রে পি-দানের ক্রমাধিকারের সাথে সম্পত্তির অধিকার অর্জনের বিষয়ও জড়িত।
পিত্রা ভর্ত্রা সুতৈর্বাপি নেচ্ছেদ্বিরহমাত্মনঃ।
এষাং হি বিরহেণ স্ত্রী গর্হ্যে কুর্যাদুভে কুলে।। (৫/১৪৯)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক কখনো পিতা, স্বামী কিংবা পুত্রের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না; কারণ, স্ত্রীলোক এদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে পিতৃকূল ও পতিকূল- উভয় কূলকেই কলঙ্কিত করে তোলে।
বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈ র্বা পরিবর্জিতঃ।
উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ।। (৫/১৫৪)
বঙ্গানুবাদ: স্বামী বিশীল (অর্থাৎ জুয়াখেলা প্রভৃতিতে আসক্ত এবং সদাচারশূন্য), কামবৃত্ত (অর্থাৎ অন্য স্ত্রীতে অনুরক্ত) এবং শাস্ত্রাধ্যায়নাদি ও ধনদানাদি গুণবিহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রীর কর্তব্য হল স্বামীকে দেবতার মতো সেবা করা।
কামং তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুষ্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ।
ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু।। (৫/১৫৭)
বঙ্গানুবাদ: পতি মৃত হলে স্ত্রী বরং পবিত্র ফুল-ফল-মূলাদি অল্পাহারের দ্বারা জীবন ক্ষয় করবে, কিন্তু ব্যভিচারবুদ্ধিতে পরপুরুষের নামোচ্চারণও করবে না। অর্থাৎ নারীর কোন জৈবিক চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে না। এই চাওয়া-পাওয়াকে পবিত্র মনুশাস্ত্রে স্বীকার করা হয়নি। তবে নারীর ক্ষেত্রে জৈবনিক চাহিদাকে স্বীকার করা না হলেও শাস্ত্রে পুরুষের কামচরিতার্থতার প্রয়োজনকে কিন্তু অস্বীকার করা হয়নি, বরং তা পূরণের জন্য পবিত্র বিধানও তৈরি করে দেয়া হয়েছে-
ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি।
পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ।। (৫/১৬৮)
বঙ্গানুবাদ: (সুশীলা-) ভার্যা স্বামীর পূর্বে মারা গেলে তার দাহাদি অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে পুরুষ পুনরায় দারপরিগ্রহ ও অগ্ন্যাধ্যান করবে (যদি ধর্মানুষ্ঠান ও কামচরিতার্থতার প্রয়োজন থাকে, তবেই ওই স্বামীর পুনরায় দারপরিগ্রহ করা উচিত। তা না হলে পতœী নেই বলে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস অবলম্বন করতে পারে)।
যারা কথিত হিন্দু ধর্মগ্রন্থে নারী-পুরুষের সমতা খুঁজে বেড়ান, তারা আসলে কী যে খুঁজেন বুঝা দায়। তবে মনুশাস্ত্রে স্ত্রীর মর্যাদা কতটুকু তা এই শ্লোক থেকেও কিঞ্চিত অনুধাবন করা যেতে পারে-
ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ শিষ্যো ভ্রাতা চ সোদরঃ।
প্রাপ্তাপরাধাস্তাড্যাঃ স্যূ রজ্জ্বা বেণুলেন বা।। (৮/২৯৯)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রী, পুত্র, ভৃত্য, শিষ্য এবং কনিষ্ঠ সহোদরভ্রাতা অপরাধ করলে সূক্ষ্ম দড়ির দ্বারা কিংবা বেতের দ্বারা শাসনের জন্য প্রহার করবে। তারপরও এসব হচ্ছে হিন্দু শাস্ত্রবাক্য।
বলাবাহুল্য, কথিত নারীবাদীরা নারী অধিকার বলতে যা বোঝায় তাতে তাদেরকে সর্বাগ্রে হিন্দুধর্ম উঠিয়ে দিতে হবে, মুনসংহিতা কেটে-ছিঁড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের স্পষ্ট নারীর বেইজ্জতী বর্ণনার প্রতি
কোনো অঙ্গুলী নির্দেশ না করে,
অযথাই ইসলামের উপর একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা নেহায়েত তাদের দুরভিসন্ধি এবং নিখাদ ইসলাম বিদ্বেষী মনোবৃত্তি।
শতকরা ৯৭ ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠী তথা প্রায় ১৬ কোটি মুসলমানের উচিত- এসব ষড়যন্ত্র ও নারীবাদীদের কঠোর হস্তে দমন করা।
-মুহম্মদ আরিফুর রহমান
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০