রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফার্মাসি বিভাগের সাবেক শিক্ষক শামীম হোসেন। শিক্ষাছুটিতে জাপান যাওয়ার পর সে আর কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেনি। এ কারণে ২০১০ সালের ২৪ আগস্ট তাকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই অভিযোগে ১৯৭২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ জন শিক্ষককে এভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ১১৮ জন শিক্ষক উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেছে। এর মধ্যে ফিরে এসেছে ৩৮ জন। অন্যরা ফিরবে কিনা তা অনিশ্চিত। শুধু শিক্ষক নয়, মেধাবী তরুণদের একটি বড় অংশও প্রতি বছর উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে যায়। উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তদের এই ফিরে না আসাকে ‘মেধাপাচার’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১৫ জন শিক্ষক অনুমতি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলো। এর আগের বছরে এ সংখ্যা ছিল ১৪ জন। এসব শিক্ষক উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। অনুমতি ছাড়া দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করায় ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সিন্ডিকেট সভায় ৫২ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। নিয়মানুযায়ী কোনো শিক্ষক ৬ মাস বা ১ বছরের জন্য বিদেশে গেলে একাধিক কিস্তিতে সর্বাধিক ৪ বছরের জন্য ছুটিতে থাকতে পারবে। উচ্চশিক্ষা শেষে শুধু দেশে ফিরে কাজে যোগদানই নয়, ভোগকৃত ছুটির সমপরিমাণ সময়কাল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু চাকরিচ্যুত হওয়া ৫২ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটির চুক্তি ভঙ্গ করে ছুটি শেষে পুনরায় কাজে যোগ দেয়নি। এমনকি শিক্ষা ঋণের টাকা ও গৃহীত বেতন-ভাতাদিও ফেরত দেয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছুটি বিধির ৪(৭) ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো শিক্ষক শিক্ষা ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান না করলে ছুটিকালীন গৃহীত বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পাওনা এককালীন ফেরত দিতে হবে।’
উল্লেখ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে যখন প্রতিটি দেশই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিজ্ঞানীদের প্রণোদনা বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে নিত্য-নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিকাশে মনোযোগ দিয়েছে, তখন বাংলাদেশের সরকার বিজ্ঞানীদের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে পাচার হচেছ মেধা। দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। তাদের মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই আর ফিরে আসছে না। অথচ এই কৃতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর পিছনে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ টাকার অধিক, একজন বুয়েটের শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীতে ব্যয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকা। আর একজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর পিছনে ১৫ লাখ টাকার উপর। দেশের এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। অথচ মেধাপাচারের সুফল ভোগ করছে পশ্চিমা বিশ্ব।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল এই ৩০ বছরের মধ্যে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এক মিলিয়ন কারিগরি ও পেশাদার ব্যক্তি গ্রহণ করেছে। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীদের পশ্চিমা বিশ্বে অভিবাসন নিঃসন্দেহে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের এতে লাভ অনেক। প্রথমত, তারা বিনা খরচে রেডিমেড বিজ্ঞানী ও দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে, যা দিয়ে তাদের নিজস্ব ঘাটতি পূরণ করছে। দ্বিতীয়ত, অপেক্ষাকৃত কম বেতনে এদের উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করে অগ্রগতি ও আগ্রাসন আরো ত্বরান্বিত করা যাচ্ছে। অপরদিকে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশগুলো।
পশ্চিমা বিশ্বের একটি অদৃশ্য নীতি আছে, যাতে আমাদের দেশ থেকে প্রযুক্তিবিদদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের দেশে নেয়া আর আমাদের জন্মভূমিকে বঞ্চিত করা। ঠিক উপনিবেশের অবসানে পশ্চিমা দেশসমূহ যেমনি ঋণ আর সাহায্যের নামে নিজেদের বশংবদ সরকার প্রতিষ্ঠা করে পরোক্ষ উপনিবেশ জিইয়ে রেখেছে, যা ডিজিটাল উপনিবেশ নামে পরিচিতি পেয়েছে, তেমনি মেধাবীদের বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি অনুগত রাখছে।
জানা গেছে, যারা দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগেরই ইচ্ছা সংশ্লিষ্ট দেশে স্থায়ী হওয়া। কারণ হিসেবে গবেষণায় কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে, চাকরি ও উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা না থাকায় এসব মেধাবী দেশ ছাড়ছে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, দদলবাজি, দুর্নীতির ছড়াছড়ি ছাড়াও বাংলাদেশের ডিগ্রির মান কম। এখানে জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, চাকরি ও উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা নেই। সরকারি ও সম্ভাবনাময় চাকরির ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে রাজনৈতিক যোগাযোগ, দলীয় প্রভাব ও দুর্নীতির কার্যকারিতাও এখন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে উঠেছে।
অপরদিকে দেশ থেকে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী দেশ ছেড়ে যাচ্ছে তাদের পরিসংখ্যান নিয়েও চলছে দুর্নীতি। মেধাবীদের দেশত্যাগ করা নিয়ে উচ্চশিক্ষা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউজিসি উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ঠিক কতজন শিক্ষার্থী দেশ ছাড়ছে তার সঠিক হিসাব নেই শিক্ষামন্ত্রণালয় বা ইউজিসি’র কাছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানায়, আগে হিসাব রাখা হতো। এ নিয়ে অবৈধ ব্যবসা গড়ে তোলে একটি সিন্ডিকেট। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। ওই চক্রের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তাও জড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীদের হিসাব রাখে না শিক্ষামন্ত্রণালয়। এতে দেখা যায়, মেধাবীদের দেশ ত্যাগ রুখতে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে ভাটা পড়ে যায়।
বলতে হয়, মেধা পাচার দেশের জন্য সর্বনাশা হুমকি। এভাবে চলতে থাকলে দেশ এক সময় মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। আর এই সর্বনাশের শিকার যাতে বাংলাদেশ না হয়, সেজন্য মেধা পাচার রোধে সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধাবীদের ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি ডাক্তার ও প্রকৌশলীসহ প্রশিক্ষিত জনশক্তিকে যাতে দেশে ধরে রাখা যায় কিংবা সাময়িকভাবে আরো প্রশিক্ষণ লাভ কিংবা অন্য কারণে কেউ বিদেশ গেলেও পরবর্তী সময়ে যাতে দেশে ফিরে আসতে আগ্রহী হয়, সরকারি এবং বেসরকারি খাতে যথাযথ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে ¬¬¬হবে। খাতকে এমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
-আল্লামা মুহম্মদ আরিফুল্লাহ, ঢাকা
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০