আসামে ফের মুসলমানদের উপর নির্যাতন।
কথিত বৃহৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতে অব্যাহত মুসলমান নিপীড়ন,
হত্যা, গুম, বঞ্চনা এটাই প্রমাণ করে-
কোন কথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেই মুসলমানরা শান্তিতে থাকতে পারে না,
সেখানে ইসলামের অনুশীলন হতে পারে না।
আসামে ‘বাংলাদেশী খেদাও আন্দোলন’ একটি সুবিধাবাদী সাম্প্রদায়িক প্রপাগান্ডা। সাময়িক বিরতির পর নানা ছুতো-নাতায় এটি সক্রিয় হয়ে উঠে। কখনো অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আসু), কখনো রাজনৈতিক দল আসাম গণপরিষদ, কখনো অন্য রাজনৈতিক দল মহন্তর আসাম গণপরিষদ (প্রগতিশীল)-এর নেতৃত্বে থাকে।
এদিকে আসাম পাবলিক ওয়ার্কার্স নামে একটি সংগঠন প্রদেশের ভোটার তালিকা থেকে ৪১ লাখ ‘অবৈধ বাংলাদেশীর’ নাম বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে ‘জনস্বার্থে’ যে আবেদন করেছিল ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তা গ্রহণ করেছে। বাদিপক্ষের অভিযোগ হচ্ছে আসামের ভোটার তালিকায় কমপক্ষে ৪১ লাখ বাংলাদেশীর নাম রয়েছে।
মূলত প্রত্যেকটি নির্বাচনের আগেই আসামের মুসলিমদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে উল্লিখিত কোনো না কোনো দল। ফলে কিছুদিন পরপরই মুসলমানদের জীবন ও জীবিকা দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পড়ে ম্যাসাকার হয়। ‘বাংলাদেশী বা বিদেশী’ বলতে মুসলমানদেরই উদ্দেশ্য করা হয়। বাংলাদেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক হিন্দু আসামে ও পশ্চিম বাংলায় বসবাস করলেও তাদের বিদেশী না বলে ‘শরণার্থী’ বলা হয়।
আসামে ৪১ লাখ বাংলাদেশী রয়েছে। এ সংখ্যা কিভাবে নিরূপণ হলো? মূলত নিরপরাধ মুসলমানদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে তাদের এ অপচেষ্টা। নিরপরাধ মুসলমান অনেকেই বাংলাদেশে বিতাড়িত হওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, আসামের কিছু লোকের মধ্যে একটা কথা বা
ধারণা আছে যে, এখানে বাংলাদেশীরা বসবাস করছে। আর বাংলাদেশী অর্থই হচ্ছে মুসলমান। আসামে শীর্ষ পর্যায়ে প্রায়শই বলা হয়, বাংলাদেশী মুসলমান বা হিন্দু বলে কোন কথা নয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর আসামে যারা এসেছেন তাদেরকে আসাম ত্যাগ করতে হবে কারণ তারা বিদেশী। কিন্তু বাস্তবে যা দেখা যায়, সেটি হচ্ছে- এখানে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ মুসলমানদেরকে যাদের মুখে দাড়ি আছে, যাদের মাথায় টুপি আছে তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদেরকে থানায় নিয়ে আটক করে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশী বলে এবং নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে । অথচ পরে দেখা যাচ্ছে তারা ভারতের নাগরিক।
সামপ্রতিক সময়ে আসামে বিদেশী বিতাড়নের নামে হামলায় কমপক্ষে ১০ জন মুসলমান নিহত হয়েছে এমন খবর মিডিয়াতে এসেছে। ভারতের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমাদের বিরুদ্ধে আসু, অসম ছাত্র যুব পরিষদ, এজিপিসহ ৬টি ছাত্র সংগঠন অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে।
মূলত মিডিয়ার এ খবর প্রকৃত সত্যের ক্ষুদ্রতম খণ্ডাংশ মাত্র। ২০ জন লোক এখনও নিখোঁজ রয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ১১টা মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আসামে অব্যাহত ও পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আর মুসলমানদেরকে শহীদ করা হলে দুষ্কৃতিকারীদের বা চিহ্নিত হত্যাকারীদের কাউকেও গ্রেফতার করা হয় না। পুলিশ বা প্রশাসন এদেরকে জানে চেনে তারপরও নীরব ভূমিকা পালন করে তারা। তাদের ধারণা একটা বিশেষ
সমপ্রদায়ের লোক অর্থাৎ মুসলিম সমপ্রদায়ের লোক মারা গেছে বা নিখোঁজ রয়েছে; এ ব্যাপারে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই ।
ভারত সেক্যুলার দেশ হিসেবে খুব প্রপাগান্ডা চালায়। কিন্তু তারমধ্যে মুসলমানদের উপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। আর এ বিষয়ে পুলিশ এবং ব্যুরোক্রেসী- এদের মধ্যে একটা চক্র আছে যারা ভীষণভাবে কমিউনাল। আর তারাই এ ধরনের ঘটনা বারে বারে ঘটাচ্ছে অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ।
মুসলমানদেরকে এ দেশের হিন্দু সমপ্রদায় কখনো বিশ্বাস করতে পারেনি। এখনও পর্যন্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে যা কিছু ঘটনা ঘটছে তার মূল কিন্তু এখানেই যে হিন্দু সমপ্রদায় তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারে না। ফলে যখনই কোন সন্ত্রাসী ঘটনা বা যে কোন অঘটন ঘটে যায় তখনই সন্দেহ করা হয় বোধহয় মুসলিম সমপ্রদায়ের মানুষ কাজটা করেছে! এ ব্যাপারে বিজেপি ছাড়া যেসব রাজনৈতিক দলগুলো যারা নিজেদেরকে অসামপ্রদায়িক বলে দাবি করে তাদের এ বিষয়ে বড় ভূমিকা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু কথিত এসব অসামপ্রদায়িক দল রাজনৈতিকভাবে বিজেপির যতটা বিরোধিতা করে সামাজিকভাবে কিন্তু তারা ততটা সক্রিয় নয়। এটা কী মুসলমানদের প্রতি তাদেরও বিদ্বেষ প্রমাণিত করে না?
ভারতে এ বৈষম্যের চিত্র শুধু মুসলমানদের প্রতি করা হচ্ছে তাও নয়! কয়েকদিন আগে দেখা গেছে, দলিতদের একটি কমিউনিটি সেন্টার উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা দখল করে নিয়ে দলিতদের প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। দলিতরা এর প্রতিকারের জন্যে আইনি সাহায্য চেয়ে পায়নি। আদালতের কাছে মামলা করেও তেমন কোন সুফল না পেয়ে অবশেষে তারা এই অন্যায়ের প্রতিবাদে গণ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল ।
এদিকে সিপিএমের নেতাকর্মীদের ‘মুসলিম জাতির প্রতি এত অবিচার কেন করছেন?’ একথা জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, ‘আমাদের আগে তো কংগ্রেস ও বিজেপি এভাবে মুসলমানদের উপর অত্যাচার করেছিল। তো আগে কংগ্রেস আর বিজেপিকে জিজ্ঞেস করুন তারপর আমাদের কাছে জানতে চাইবেন।’
কংগ্রেসীদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যখন ভারতে ছিল তখন মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও অবিচারের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল আর আমরা সেই পথে চলি। এই হলো আসামসহ গোটা ভারতে মুসলমানদের নির্যাতনের মূলতত্ত্ব।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের যেখানেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আছে সেখানে সংখ্যালঘুদের প্রবেশ এবং তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্পণ্যতা
আছে। কেউ মুসলমানকে তার অধিকার ছাড়তে চায়না এটি একটি বড় কারণ।
অপরদিকে গভীর পরিতাপের বিষয় হলো, এসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মুসলমান যারা যুক্ত আছেন তারা ভাবেন এই সম্পৃক্ত হয়ে থাকাটাই বোধহয় তাদের শেষ পথ। অন্য কোন বিকল্প পথ তাদের নেই। আর এই হীনমন্যতাই তাদের আরো বেশি দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছে।
চাকরির ক্ষেত্রে যেখানে প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষা রয়েছে সেখানে মেধার ভিত্তিতে মুসলমানরা ভালো নম্বর পেয়ে যোগ্যতার বলে চাকরি পেয়েছেন। আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে এ ধরনের চাকরির হার বেশি। অন্যদিকে যে চাকরি নেতা বা দল কেন্দ্রীক সেখানেই মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম প্রভাবিত প্রতিটি এলাকায় তারা জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে যেখানে তাদের সুবিধা আছে সেখানেই তারা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তাদের সমর্থক কর্মী ও অংশের মানুষদের চাকুরি দিয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে তারা ইচ্ছাকৃত মুসলমানদের বঞ্চিত করেন।
সাচ্চার কমিটির রিপোর্টেও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে যে, এ ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ৩ বা ৪ এর বেশি নয় । তবে মেধা, যোগ্যতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে উত্তীর্ণ মুসলমানদের চাকরি পাওয়ার সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগেরও বেশি। মূলত একথা আজ স্পষ্ট যে, শাসকগোষ্ঠী সিপিএমসহ গোটা ভারতে কেউই চায়না মুসলিম জাতি একটি জায়গায় উঠে আসুক ।
চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৯৭ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন গঠন করেছিলো। গত ১০ বছরে প্রায় ৫০ হাজার চাকরি দেয়া হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশনে ১২ জন স্থায়ী বা অস্থায়ী সদস্য রয়েছে তার মধ্যে একজনও মুসলমান নেই।
বলাবাহুল্য, আসাম, হায়দরাবাদ, অযোধ্যা, কাশ্মীরসহ গোটা ভারতে মুসলমানদের উপর এরূপ অব্যাহত হত্যা, গুম, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়নের পরও ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার।
পাশাপাশি বোরকা পরা নিষিদ্ধ করলেও ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, ইতালি ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার। এমনকি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকার পরও ৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার সুবাদে বাংলাদেশেও ঘোষণা করা হলো, পর্দার জন্য বাধ্য করা যাবে না।
প্রতিভাত হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা যেখানেই ঘোষিত হয়েছে সেখানেই মুসলমানরা বঞ্চিত, নির্যাতিত হয়েছে।
কাজেই, এদেশের ৯৭ ভাগ জনগোষ্ঠী মুসলমান এদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন কোনক্রমেই বরদাশত করতে পারছে না। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া এখনও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে পৌঁছাতে পারছে না। তারা জনগণের এ অনুভূতি অনুভব করতে পারছেন না। সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারছেন না।
-মুহম্মদ আরিফুর রহমান।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০