স্বাধীনতার সুফল তখনই প্রকৃত অর্থে দেশবাসী লাভ করবে যখন দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে। সম্পূর্ণভাবে এবং সব বিভাগ থেকে দুর্নীতি উঠে যাবে। কমপক্ষে নিয়ন্ত্রিত হবে। দুর্নীতিবাজদের যথাযথ বিচার হবে। স্বাধীনতার জন্মলগ্ন হতেই একথা সব মহল থেকেই ক্রমশ উচ্চারণে উচ্চারিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন মহল, ফোরামে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। জোরদার দাবী উঠেছে। দাবী জানিয়েছিলো খোদ বিচারকরাও। তাদের মুখ থেকেই বিচার বিভাগ স্বাধীন করার কথা এসেছে। এবং অবশেষে তা হয়েছেও। কিন্তু তাতে করে কোন বিভাগেও দুর্নীতি দূর হয়নি। বরং খোদ বিচার বিভাগেই দুর্নীতি চরমভাবে জেঁকে বসেছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন মহলে এ বিষয়টি খোলামেলা আলোচিত হচ্ছে। পাশাপাশি সার্টিফেকেট জালিয়াতিসহ বিচারকদের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগও উঠেছে। টিআইবি বিচার বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ চলেছে। মানবাধিকার কমিশনারের পক্ষ থেকে এক সেমিনারে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অনেক বিচারক ক্ষমতার অপপ্রোয়গ করেছে।
বলাবাহুল্য, বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন দিয়ে সব সময় সবকন্ঠ চুপিয়ে রাখা যায় না। কাজেই কথিত বিচারকরা যতই হুম্বি-তম্বি করে; বিচার বিভাগ দুর্নীতিমুক্ত নয় বরং বেশই দুর্নীতিযুক্ত- এটা স্পষ্টভাবেই বলা যায়।
প্রসঙ্গতঃ বিচারকরাই রাজনীতিবিদ-এমপিদের দুর্নীতির বিচার করে থাকে। সেক্ষেত্রে বিচারকরাই যদি দুর্নীতিগ্রস্থ থাকে তবে রাজনীতিবিদ তথা মন্ত্রী ও এমপিরা যে আরো বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ তা বলাইবাহুল্য।
প্রসঙ্গতঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এদেশের সর্বসাধারণ তার তথ্য-প্রমাণ জেনেছে এবং কোন্ মন্ত্রী-এমপি কত বড় দুর্নীতি এবং কত ধরনের দুর্নীতি করেছে বা করতে পারে- তাও আগের তুলনায় ব্যাপকভাবে জেনেছে। ত্রাণের টিন, বিস্কুটসহ দুর্নীতির টাকায় মন্ত্রী-এমপিদের বাড়ীতে যে মিনি চিড়িয়াখানাও হয়েছে- তাও দেশবাসী জেনেছে। দেশে দুই কোটিরও ঊর্ধ্ব বিপন্ন আর্তপীড়িত শিশু থাকার পরও এক নেত্রীর একান্ত সচিবের এক শিশু মেয়ের পেছনেই গোটা ১-৩ তলা বিভিন্ন বিদেশী ও দামী খেলনা দ্বারা সজ্জ্বিত ছিলো- তাও দেশবাসী জেনেছে।
কিন্তু দেশবাসী এখনও উপলব্ধি করতে পারেনি যে, শুধু বর্তমান মন্ত্রী-এমপিরাই নন, অতীতের মন্ত্রী-এমপিরাও এর চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ বড় দুর্নীতি করেছে।
প্রসঙ্গতঃ স্বাধীনতা উত্তর গণপরিষদে ৩৪ জন সদস্য যারা এদেশের সংবিধান রচনা করেছে তাদের উপর এ অভিযোগ অনেক বেশি বর্তায়।
উল্লেখ্য, এমপিরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে এবং জনগণের অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। কিন্তু যে এমপি-মন্ত্রী জনগণের ত্রাণের টাকা খেয়ে ফেলতে পারে, গৃহহারা লোকের টিন দিয়ে নিজ বাড়ি করতে পারে, সেরূপ দুর্নীতিগ্রস্থ এমপিরা যে জনমত সংবিধানে প্রতিফলিত করতে ও সততার এবং সঠিকতার বিপরীতে যেতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বলাবাহুল্য, এ অসৎ আচরণই ৭২-এর সংবিধান হয়েছে। যে কারণে এদেশবাসী ৯৮ ভাগ মুসলমান হলেও ৭২-এর সংবিধানে মুসলমান বলে কোনো শব্দ সংযোজিত হয়নি। এবং ৯৮ ভাগ মুসলমানের আশা-আকাঙ্খা, অনুভূতি ও আবেগের কোনো প্রতিফলন হয়নি।
কিন্তু তারপরেও সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা হয়েছে, “আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া [জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের] মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। …… এতদ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তের শত উনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ, মোতাবেক উনিশ শত বাহাত্তর সালের নভেম্বর মাসের চার তারিখে, আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।”
বলাবাহুল্য, সংবিধানের প্রস্তাবনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের অংশগ্রহণ যেমন স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো, সংবিধান রচনায় জনগণের অংশগ্রহণ কী সেরূপ প্রাণবন্ত অথবা সম্পৃক্ত ছিলো?
সংবিধান রচয়িতা গণপরিষদ সদস্য সারা বাংলাদেশ ঘুরে গোটা দেশের জনগণের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তাদের আবেগ-অনুভূতি অথবা আশা-আকাঙ্খার কথা আদৌ অবগত হয়েছিলো কী?
খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭২। আর খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি কর্তৃক খসড়াটি অনুমোদিত হয় ১০ই জুন, ১৯৭২।
তাহলে মাত্র এই ৫৪ দিনে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি, সে ৭২-এ যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক ছিলো তারা যে গোটা বাংলাদেশ দূরের কথা যার যার নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারেনি এবং মূলত আদৌ যায়নি তা সহজ এবং স্পষ্ট কথা। কথা হলো, এরপরও খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি কী করে ‘বাংলাদেশের জনগণের’ নামে বলতে পারলো- “আমরা এ সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।”
বলাবাহুল্য, তারা ঘরে বসে বসে, যে আমেরিকা এদেশের স্বাধীনতা বিরোধীতা করেছিলো; সে আমেরিকার সংবিধান এমনকি যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, তাদেরই অনুকরণে সংবিধান রচনা করে; বাংলাদেশের জনগণের উপর সম্পূর্ণ মিথ্যা চাপিয়ে দিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ জনগণ মুসলমান। মুসলমান কখনও মনে করেন না সংবিধানের ৭(১) ধারায় বর্ণিত “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।” আর একথা আদৌ ঠিক নয়।
বলাবাহুল্য, সাধারন জনগণ তো দূরের কথা এ সেদিন খোদ প্রধানমন্ত্রীও তার লেখায়, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার এই পবিত্র আয়াত শরীফ সংযুক্ত করেছেন, “বলুন, সকল রাজত্বের, সার্বভৌমত্বের মালিক- মহান আল্লাহ পাক। তিনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দেন, আর যার থেকে ইচ্ছা কেড়ে নেন।”
বলাবাহুল্য, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে শত শত পবিত্র আয়াত শরীফে আছে, “সব সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মহান আল্লাহ পাক।” যা এদেশের জনগণ প্রতিটি মুসলমান মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। মুসলমানের কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’, কথার শেষে ‘ইনশাআল্লাহ’ উচ্চারিত হয়। সে মুসলমান কী করে নিজেরা সার্বভৌম ক্ষমতার দাবী করতে পারে? মূলতঃ এটা খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি এদেশের ৯৮ ভাগ মুসলমান জনগণের নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছেন। যে অপবাদের ফলে এদেশের মুসলমান নিজেদের ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে আজ অপকর্মে জর্জরিত হচ্ছে।
সঙ্গতকারণেই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির এ অন্যায়ের এ অপবাদ নিয়ে আজ গোটা দেশবাসীকে সচেতন হতে হবে। তাদের নামে মিথ্যাচারীতার বিচার চাইতে হবে। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি তথা চুড়ান্তকারী কর্তৃপক্ষ যে ভুল-অন্যায় করেছে সে সম্পর্কে গণ জাগরণ ঘটাতে হবে এবং এরই দূরবর্তী ক্ষতি হিসেবে দেশে যে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ ও আমল নেই তথা মুসলমান আজ দুর্নীতিতে বিপর্যস্থ হচ্ছে খোদ বিচারকরাও বাদ যাচ্ছেনা সে কথা আমলে নিতে হবে।
-মুহম্মদ আরিফুল্লাহ, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০