‘ফোরাতের তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মরে তবে আমি হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে’- এই ছিলো আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার স্বগোক্তি।
আজকে শুধু তথাকথিত মানবাধিকার নিয়ে কথা হয়। কিন্তু ইসলামী মূল্যবোধ বলেছে প্রতিটি প্রাণিধিকারের কথা। এমনকি জড়বস্তরও অধিকারের কথা।
প্রসঙ্গত আজকের সামাজিক অবক্ষয় তথা ইসলামী মূল্যবোধের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও লালনের প্রতি বৈরী মানসিকতার প্রেক্ষিতে বহু মহিলাও কারণে-অকারণে কারাগারে যাচ্ছে।
অথচ দেশের কোনো কারাগারেই মহিলাদের জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থাটি নেই।
এমনকি কাগজ-কলমেই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে প্রায় চারগুণ অতিরিক্ত মহিলা বন্দি নিয়ে বিব্রতবোধ প্রকাশ করেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত শেডে জায়গা না হওয়ায় প্রায় ৩০০ মহিলা বন্দিকে থাকতে দেয়া হচ্ছে উন্মুক্ত বারান্দায়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, ১৩৪ বন্দির ধারণ ক্ষমতার কারাগারে বর্তমানে আছেন ৪৯১ জন মহিলা। এদের সঙ্গে রয়েছে ছয় মাস থেকে শুরু করে ছয় বছরের ৬৬ জন শিশু। এছাড়া রয়েছে ১০ ফাঁসির আসামি এবং ৯৭ জন সাজাপ্রাপ্ত মহিলা কয়েদি। স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় অতিরিক্ত এসব মহিলা বন্দিকে রাখা হচ্ছে গাদাগাদি করে। লঙ্ঘিত হচ্ছে কারা আইন ও মানবাধিকার। আইনগত নানা জটিলতায় কর্তৃপক্ষ তাদের অন্য কারাগারে স্থানান্তর করতে পারছে না।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মহিলা বন্দিদের জন্য যে শেড রয়েছে তাতে ১৫০ মহিলা বন্দিকে রাখা সম্ভব।
সম্প্রতি মহিলা বন্দিদের জন্য তৈরি করা নতুন শেডে গাদাগাদি করে অতিরিক্ত ২০০ মহিলা বন্দি রাখা সম্ভব। বাকি প্রায় ৩০০ মহিলা বন্দি ও তাদের সন্তানদের স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় অনেককেই শেডের বারান্দায় রাখা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এসংখ্যা আরো অনেক বেশি। বরং হাজারেরও ঊর্ধ্বে। তাদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ৩০।
কারা সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মায়েদের সঙ্গে থাকা ৬৬ জন শিশুকে দিনের বেলায় ডে কেয়ার সেন্টারে রাখা হয়। রাতে দেয়া হয় মায়ের কাছে থাকতে। বন্দিদের মধ্যে যাদের শিশুসন্তান রয়েছে তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখার বিধান থাকলেও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মহিলা বন্দিদের নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহিলা বন্দিদের দেখভালের জন্য সার্বক্ষণিক দায়িত্বে রয়েছে ছয় মহিলা কারারক্ষী। এর পাশাপাশি সাজাপ্রাপ্ত মহিলা বন্দিদের ভেতর থেকে বাছাই করে ২০ জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এসব মহিলা কারারক্ষী ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনেকেই কারাগারভুক্ত মহিলাদের অধিকার আদায়ে শুধু বঞ্চনা করেন তাই নয়; বরং তারা মহিলাদের বঞ্চনা, নির্যাতনসহ ইজ্জতও বিলিয়ে দিতে বাধ্য করে।
সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী নাজমুল হুদার স্ত্রী মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে স্বল্পকালীন কারাবাসের অভিজ্ঞতায় বর্ণনা করেছেন, কারাগারে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে কী করে মহিলাদের সম্ভ্রম লুন্ঠন করা হয়, গর্ভবতী হতে বাধ্য করা হয়- তা নিজের চোখে দেখে তিনি শিউরে উঠেছেন।
সিগমা হুদার প্রতিচিত্র স্বরূপ সে সময়ে দেখা গিয়েছিলো, আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার শামসুল, জেলার এবং সে সময়ের কুখ্যাত অপরাধী ডিপজল মহিলা ওয়ার্ডে পাশাপাশি বসে কারাবন্দী মহিলাদের নাচগান দেখেছে। (নাউযুবিল্লাহ)
বলাবাহুল্য, এটা কোন প্রথাগত অনুষ্ঠান ছিলো না। অর্থাৎ এটা ছিলো তাদের লালসার জন্য আরোপিত বা বাধ্য করা বিষয়। এভাবে রক্ষকই যদি ভক্ষক হয় তাহলে মহিলা বন্দিদের অবস্থা যে কত নিদারুণ ভয়াবহ ও নির্মম এবং নিষ্ঠুর ভয়াবহ অবস্থা সর্বত্র বিরাজমান তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
উল্লেখ্য, অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা জেলখানা থেকে বেরিয়ে সদ্য অভিজ্ঞতা থেকে ওই একবারই যা কিছু বলেছিলেন। এর সাথে মান্নান ভূঁইয়াও বলেছিলেন, কারাগারে মানুষের দুঃসহ কষ্টের কথা। লাঘবের জন্য তিনি প্রচেষ্টা নিবেন তাও বলেছিলেন।
মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মান্নান ভুঁইয়া আর কিছু বলেননি। অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা এখনও চুপচাপ। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
বলাবাহুল্য, কারাগারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছেঁড়া তোষক, স্যাঁতস্যাঁতে ঘর, স্লো পয়ঃজনিং ইত্যাদি দুরবস্থার কথা বলেছেন।
খালেদা জিয়াও দুরবস্থার কথা স্বীকার করেছেন।
এদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদও সবচেয়ে ভয় পান কারাগারকে।
দেখা যাচ্ছে, সমসাময়িককালে বাংলাদেশে সব সরকার প্রধানকেই কারাগারে যেতে হয়েছে এবং বাংলাদেশর প্রেক্ষাপটে মন্ত্রী-এমপি থেকে শুধু পাতি নেতাই নয় বরং হাজার হাজার উপ-পাতি নেতাদেরও কারাগারে যেতে হয়েছে, যেতে হচ্ছে এবং যেতে হবে। (নাউযুবিল্লাহ)
কারাগারে ঢোকানো বা না ঢোকানো সম্পর্কে দ্বিমত, বিতর্ক থাকলেও কারাগারে থাকা অবস্থায় একটা বিষয়ে কেউ বিতর্ক করে না, দ্বিমত পোষণ করে না যে, ‘কারাগারের পরিবেশ উন্নত করা দরকার।’
কিন্তু কারাগার থেকে বেরোনোর পর কারোই সেটা মনে থাকে না।
রাজনীতিবিদরাও মনে রাখে না।
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য, বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাড়ে ৮ হাজার বন্দির মধ্যে ৭ হাজারই বিনাবিচারে আটক হাজতি আসামি। সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের তুলনায় হাজতি আসামিদের বেশি কষ্টে থাকতে হয়। অপরাধ প্রমাণের আগেই হাজতি বন্দিদের কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। মনিহার, মেঘনা, পদ্মা ও সুরমার ওয়ার্ডে অবস্থানকারী হাজতি আসামিদের কষ্ট না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ঘুম, খাবার, গোসল, টয়লেট ব্যবহার থেকে শুরু করে সবকিছুতে পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে হাজতি বন্দিদের। হাজতি হিসেবে যারা জীবনে প্রথম কারাগারে প্রবেশ করেন, তারা নানা হয়রানির শিকার হন। বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাদের এই কষ্টের দায় কে নেবে এই প্রশ্ন হাজতি আসামিদের। সম্প্রতি জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম বন্দিদের এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, এখানে যারা আসেন তাদের প্রায় ৪০ শতাংশই নির্দোষ কিন্তু আইনগত নানা জটিলতার কারণে তাদের কারাগারে অবস্থান করতে হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় বা কারও রোষানলে পড়ে যারা কারাগারে যান এবং বিনাবিচারে আটক থাকেন তাদের জীবনের এই দিনগুলোর মূল্য দেবে কে? কারাগারে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, তাদের কোনো নিকট আত্মীয় বা বন্ধু একটি অপরাধ করেছেন। সেই অপরাধ সম্পর্কে কিছু জানা না থাকার পরও শুধু সম্পর্কের কারণে তাদের জেলে আসতে হয়েছে। বিচারেও একদিন হয়তো তারা নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। বিচারের আগেই এরকম লোককেও কারাগারে কঠিন কষ্টের বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে।
রাজধানীর জুরাইনে একটি হত্যা মামলার আসামি শহিদ নামের এক তরুণ। গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করত। একদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে জানতে পারে হত্যা মামলায় তাকে আটক করা হয়েছে। থানা পুলিশ তাকে রিমান্ডে নেয়। সেখান থেকে নেয়া হয় ডিবিতে। থানা ও ডিবিতে তার উপর নির্যাতনের কাহিনী শুনে গা শিউরে উঠছিল। চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে তাকে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে পুলিশের শিখিয়ে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়। রিমান্ডে শিখিয়ে দেয়া জবানবন্দি অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়ার পর পাঠানো হয় কারাগারে। এক বছর ধরে আছে। যারা অপরাধটির সঙ্গে জড়িত ছিল সেই আসামিরা জামিনে বের হয়ে গেছে। কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও যথাযথ তদবিরের অভাবে তার জামিন হচ্ছে না। কারাজীবনে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন।
এরকম অনেকে কারাগারে রয়েছেন যারা অপরাধ না করেও বিনাবিচারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। অতিকষ্টে রাত কাটছে ইলিশ ফাইল, কেচি ফাইলে। গত রোজার ঈদের দু’দিন পর অস্ত্র মামলায় আটক হয়ে একজন কারাগারে প্রবেশ করেন। তার এক প্রভাবশালী আত্মীয় কারাগারে বন্দি আছেন। তাকে খবর পাঠানো হলো। পরের দিন সকালেই আমদানি ওয়ার্ড থেকে তাকে প্রভাবশালী আত্মীয়ের রুমে একটি সেলে নেয়া হলো। সেলে থাকার জন্য ১০ হাজার টাকায় দফা-রফা হল। তার সঙ্গে আরও ৩ আসামি ছিল। একই ঘটনায় তারা একসঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন। তার সঙ্গেই ছিল বাকি ৩ জন। যার সঙ্গে গিয়েছিল সেই ব্যক্তিটি কারাগারের ভেতরে ভালো অবস্থান পেলেন। যারা বন্ধুর সহযোগিতায় গিয়েছিলেন তাদের স্থান হলো ওয়ার্ডের ইলিশ ফাইলে। সেলে স্থান পাওয়া লোকটি ৩ সহযোগীর খবরও নিতে যাননি কোনো দিন। অথচ তার সঙ্গে গিয়েই ধরা পড়েছে ওই ৩ জন। এ ধরনের ঘটনার শিকার অনেকেই রয়েছেন, যাদের কেউ নেই, জামিনে বের হতে পারছেন না।
এই হাজতি আসামিরাই থাকেন কারাগারের জঘন্যতম ঘনবসতি ঘরগুলোতে। যেখানে রাতে ৩০০ লোককে মাত্র ২টি টয়লেটে প্রাকৃতিক কাজ সারতে হয়। সকালে বা দুপুরে গোসল সারেন হিটিং করে। ময়লা কালো রুটি, গন্ধমাখা ভাত খেয়ে জীবন কাটান। এই মানবেতর জীবন কাটানোর পর একদিন বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বের হয়ে আসেন অনেকে; কিন্তু বছরের পর বছর মানবেতর জীবনযাপনের ক্ষতিপূরণ কেউ পেয়েছেন এমন নজির নেই। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা বা মিথ্যা অভিযোগ যিনি করেন তার কোনো রকমের শাস্তি বা জরিমানা এ দেশে হয় না। বিচার হয় না সেই পুলিশের যিনি ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলা দেন। নতুন হাজতি আসামিদের কারাগারে প্রবেশ গেটে আনুষ্ঠানিকতা শেষে নেয়া হয় আমদানি ওয়ার্ডে। গেট থেকেই শুরু হয় নানা হয়রানি। আমদানি ওয়ার্ডে রাত কাটাতে হয় কষ্টের মধ্যে। তুলনামূলক একটু ভালো জায়গায় থাকার জন্য আমদানি ওয়ার্ডেই দফারফা করে নিতে হয়। অন্যথায় কারাগারের নিকৃষ্টতম স্থানে জায়গা হয়। এতে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন জীবনে প্রথমবার কারাগারে প্রবেশ করা হাজতি আসামিরা। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
রাস্তাঘাট থেকে পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় কাউকে ধরে নিলে ম্যাজিস্ট্রেট অনেক সময় ২ দিন ৫ দিন বা ১০ দিনের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠান। প্রতিদিনই এরকম সাজাপ্রাপ্ত কিছু আসামি কারাগারে প্রবেশ করেন। তাদেরও কোনো অপরাধ থাকে না। এসব আসামিকে কারাগারের ভাষায় পাচানি বলা হয়। পাচানি বন্দিদের রাখা হয় একটি ওয়ার্ডে। (ইনশাআল্লাহ চলবে)
-মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০