যখন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কেনা নিয়ে কৃষকদের নাভিশ্বাস উঠেছে, ঠিক তখন রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়াই ফসল উৎপাদন করছে মাগুরা ও দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা। দৈনিক আল ইহসান শরীফ-এ প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, মাগুরা জেলা ও দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কৃষকেরা এবার ধানক্ষেতে পার্চিং পদ্ধতির মাধ্যমে কীটনাশক ছাড়াই ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনে কাজ করছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, পার্চিং পদ্ধতিতে ধানক্ষেতের পোকামাকড় দমনে একদিকে ফসলের উৎপাদন খরচ কম হয়, অন্যদিকে ফলনও বাড়ে। প্রায় দিন দিন এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কৃষিবিভাগ জানায়, ধানের জমিতে ডেথ পার্চিং অর্থাৎ বাঁশ বা ডাল-পালা পুঁতে এবং লাইফ পার্চিং অর্থাৎ জমিতে বিশেষ দূরত্বে ধইঞ্চা গাছ লাগিয়ে পাখি বসার ব্যবস্থা করলে কীটনাশক ছাড়াই ফসলের ৮০ ভাগ পোকামাকড় দমন করা যায়। এবার কাহরোল উপজেলায় ৭০ ভাগ জমিতে কৃষকেরা এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে পোকামাকড় দমন করছে। ধানক্ষেতে ডেথ বা লাইফ পার্চিং পদ্ধতিতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা হলে পাখিরা সহজেই ধানের মাজরা ফুতি’সহ ক্ষতিকারক পোকাগুলো খেয়ে পোকার বংশবিস্তার রোধ করবে। এটি জৈবিক বালাই দমন পদ্ধতি হওয়ায় কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক এই পদ্ধতি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
লেখাবাহুল্য, বর্তমানে রাসায়নিক সার আর কীটনাশক ছাড়া ফসল উৎপাদনের কথা ভাবতে পারে না কৃষক। অথচ ষাট দশকের আগে ফসলের ক্ষেতে কোনোপ্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হতো না। জমির খাদ্য বলতে তখন ছিল শুধু জৈব সার। পোকামাকড় দমন করা হতো প্রাকৃতিকভাবে। সত্তর দশকের দিকে উচ্চ ফলনশীল জাত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ায় জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আশির দশকে আমাদের দেশে উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার পুরোদস্তুর শুরু হয়।
আপাতদৃষ্টিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমাদের আদরীয় বস্তু হলেও দিন দিন রাসায়নিক সার জমির উর্বরতা শক্তি কেড়ে নিচ্ছে এবং কীটনাশক ক্ষতি করছে আমাদের পরিবেশের। দেশের অধিকাংশ কৃষক এ সম্পর্কে অজ্ঞ। বর্তমানে দেশে ৯২টি রাসায়নিক গ্রুপের ৩৭৭টি বালাইনাশক বাজারজাতকরণের জন্য নিবন্ধীকৃত আছে। অনেক বালাইনাশক নিষিদ্ধ হলেও তা বাজারে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮০০০ মে.টন কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে অধিক ফলনের জন্য। কৃষি জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের আনুমানিক শতকরা ২৫ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ২০০০ মে.টন বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিকটবর্তী উন্মুক্ত নীরাশয়ে মিশছে।
প্রসঙ্গত, কৃষি জমিতে এত ব্যাপক পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানীজ জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের হুমকি সৃষ্টিসহ পরিবেশের উপর নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। শুধু যে পানীজ প্রাণী কীটনাশকের শিকার হচ্ছে তা নয়। পরিবেশ হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন। কৃষকরা শিকার হচ্ছে নানা রকমের দুরারোগ্য ব্যাধিতে। কৃষকরা মুখে মাস্ক না পড়ে দমকা বাতাসের ভেতরে কীটনাশক স্প্রে করে যাচ্ছে ফসলের ক্ষেতে। যার কারণে কীটনাশক তার নাক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। আবার দেখা যাচ্ছে, জমিতে কীটনাশক স্প্রে করার নির্দিষ্ট দিন পরে বাজারজাত করার নিয়ম। কিন্তু কৃষকের অজ্ঞতার কারণে কীটনাশক প্রয়োগের দিনই বা পরের দিনই তা বাজারজাত করার কারণে সেই বিষক্রিয়ার শিকার হয় ক্রেতা সাধারণ। এর ফলে শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি ক্যান্সারের মতো যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত।
দেশের কোটি কোটি মানুষ ইতোমধ্যেই নানা রকম স্বাস্থ্য জটিলতার শিকার হয়ে পড়েছে। মাটি দূষণের ফলে আমাদের খাদ্যচক্রে মারাত্মক বিষ ঢুকে পড়েছে। এছাড়া দেশে খাদ্য নিরাপত্তা আইন বলবৎ বা কার্যকর না থাকা এবং নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দফতরের প্রয়োজনীয় তদারকি না থাকায় কীটনাশক প্রতিটি খাদ্যপণ্যে মিশ্রিত হচ্ছে বিষ। এর ফলে কোটি মানুষ কিডনী সমস্যা, নানা ধরনের ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, পরিপাকতন্ত্রের নানা জটিলতার শিকার হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সামনেই প্রকাশ্যে এসব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলেও সেদিকে ওই কর্মকর্তাদের কোনো নজরদারি নেই। বর্তমানে দেশে ৯২টি রাসায়নিক গ্রুপের ২ হাজারের অধিক নামে কীটনাশক বাজারে রয়েছে। দেশে গত ১০ বছরে যেভাবে কীটনাশকের ব্যবহারের বেড়েছে, তাতে গভীর উদ্বেগের বিষয়। ১৯৯৯ সালে দেশে ১৪ হাজার ৩৪০ টন পেস্টিসাইড ব্যবহার হতো। ২০১৪ সালে সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে পেস্টিসাইডের ব্যবহার বেড়েছে ৫গুণ বেড়ে ৬০ হাজার টনের উপরে।
প্রসঙ্গত আমরা মনে করি, কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করা, না করার প্রশ্নটা আসে- যদি কীটনাশক আসলে প্রয়োজন থাকতো তাহলে এর ব্যবহার হতো। কিন্তু আসলে যারা কীটনাশক ব্যবহার করছে তারা কীটনাশক প্রয়োজনের জন্য করছে না, তারা করছে কীটনাশক ব্যবসার জন্য। কীটনাশক কোম্পানীগুলো কৃষি কাজের ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো যারা উন্নত প্রযুক্তির নিয়ে আসছে তারা কখনই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। তারা ছিল মূলত কীটনাশক কোম্পানী। ফলে তারা তাদের ব্যবসার প্রয়োজনে এই কাজটা করছে। আমরা কীট দমন বা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে পারি এবং সেটার জন্য কৃষকদেরকে কৃষিতে জ্ঞানসমৃদ্ধ, অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ করার অনেক পদ্ধতি আছে। কীট দমনের জন্য যে কীটনাশকই ব্যবহার করতে হবে এমন না।
প্রশ্ন হচ্ছে- কীটনাশক ব্যবহার করে উৎপাদন বেশি করে মানুষকে কী রক্ষা করা যাচ্ছে? ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে এখন যে পরিমাণ রোগ বাড়ছে; যেমন- ক্যান্সার থেকে শুরু করে, নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এখন সংখ্যাটা যদি সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে কী বিষ দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলতে চাওয়া হচ্ছে? অথচ বাংলাদেশে যে জনসংখ্যা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ফসল হয়। কাজেই জনসংখ্যা বেশি সেটা সমস্যা না। আসলে আমাদের দেশে যে কৃষি নীতি আছে সেটা বহুজাতিক কোম্পানীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই করা হচ্ছে। এখানে মানুষের সংখ্যাটা অজুহাত মাত্র।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বিশ্বের ২৬টি দেশের ২ কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে জৈবিক উপায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই; কারণ সেখানেও কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার বাদ দিয়ে শুধুমাত্র জৈবিক পদ্ধতির চাষাবাদের আওতায় এসেছে প্রায় ২ কোটি হেক্টর কৃষি জমি।
আমরা মনে করি, আমাদের দেশেও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে এনে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি ও পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। আর সেজন্য সারাদেশে মাগুরা ও দিনাজপুরের কৃষকদের মতো পার্চিং প্রক্রিয়াসহ আরো যত প্রাকৃতিক ও পরিবেশের জন্য সহায়ক পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলো সরকারিভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
-আল্লামা মুহম্মদ আশরাফুল মাহবূবে রব্বানী, ঢাকা
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি ও ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৫০