পদার্থবিদ্যার বেশ কিছু জিনিস ক্ল্যাসিকাল মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। যেমন ইলেক্ট্রনের আচরণ। আর সেরকম এক সময়ই ম্যাক্সপ্ল্যাংক কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে এক বিদ্যা তৈরি করে ফেললো। এর মধ্যে হাইজেনবার্গ তার বিখ্যাত ‘অনিশ্চয়তার সূত্র’টি দিয়ে দিলো। সে বললো- ‘যে কোনো বস্তুর গতি ও অবস্থান কখনোই এক সাথে বের করা যাবে না, কিছু অনিশ্চয়তা থাকবেই।’ এই অনিশ্চয়তা কতটুকু তাও সে বের করে দিলো। আইনস্টাইন সে সময় খুব বিরক্ত হলো। সে বললো, ‘সব বস্তু যেহেতু প্রকৃতির মাঝে রয়েছে, তাই প্রকৃতি সব বস্তুর বেগ ও অবস্থান জানে, প্রকৃতিতে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। কাজেই আমাদের উপর কোনো অনিশ্চয়তা নেই।’
সে উঠেপড়ে লাগলো ‘অনিশ্চয়তার সূত্র’ ভুল প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু তা করতে গিয়ে সে থিওরিটিকে আরো পাকা পোক্ত করে ফেললো। নিলস বোর তাকে দেখিয়ে দেয় যে- কিভাবে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। আইনস্টাইন বাধ্য হয়ে সূত্রটির যথার্থতা স্বীকার করলেও সে কোয়ান্টাম থিওরি নিয়ে কখনোই পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে পারেনি।
আইনস্টাইনের মতো কোয়ান্টাম থিওরি বাতিল প্রমাণ করার জন্য কাজ করছিল বিজ্ঞানী শ্রোডিঙ্গার। সে নিজে যদিও কোয়ান্টাম ফিজিক্সের প্রবর্তকদের একজন (এবং তরঙ্গ সমীকরণ বা Wave Equation -এর আবিষ্কারক), তারপরও পদার্থবিদ্যায় সম্ভাবনা (probability) ও অনিশ্চয়তার ব্যাপার সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। সে এক কল্পিত এক্সপেরিমেন্টের কথা বললো। সেই এক্সপেরিমেন্টে একটি বিড়াল আছে একটি বাক্সের মধ্যে, যে বাক্সে রয়েছে এক বোতল বিষাক্ত গ্যাস, বোতলের উপর একটা হাতুড়ি, হাতুড়িটা আবার একটা গিগার কাউন্টারের (যা দিয়ে তেজষ্ক্রিয়তা মাপা হয়) সাথে যুক্ত, কাউন্টারটির পাশেই রয়েছে এক টুকরো তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়াম। ধরা যাক, ৫০% সম্ভাবনা যে- ইউরেনিয়াম অ্যাটম এক সেকেন্ড পর ভেঙ্গে যাবে। সাথে সাথেই গিগার কাউন্টারটি সচল হবে, ফলে হাতুড়ি আছড়ে পড়বে বোতলে, শুরু হবে বিষক্রিয়া। এখন এই ঘটনার ফলে বাক্সের ভেতর বিড়ালটি বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে- এ প্রশ্নের সাধারণ কোনো উত্তর নেই; বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিড়ালটি বেঁচেও আছে আবার মারাও গেছে- এই দুই অবস্থাতেই বিদ্যমান। অর্থাৎ একটি বিড়ালের দুটি wave function থাকবে। বাক্স না খোলা পর্যন্ত আমরা বলতে পারছি না যে- বিড়ালটি জীবিত, নাকি মৃত। বাক্স খুললেই কেবল তা জানা সম্ভব, আর তখনই বিড়ালের wave function collapse করবে। শ্রোডিঙ্গারের কাছে ব্যাপারটি খুবই হাস্যকর ছিল। সে বললো- আমরা যখন দেখবো, তখনই বিড়ালের ভাগ্য নির্ধারিত হবে, তার আগে না- এ কেমন কথা?
এইবার নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ ইউজিন উইগনার এগিয়ে এলো শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল সমস্যার সমাধানে। সে বললো যে, “চেতনাই বস্তুর অবস্থানের নিয়ন্তা (Consciosness determines the existense)”। কার চেতনা? যে ঘটনাটি দেখছে তার চেতনা, অর্থাৎ Observer -এর চেতনা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- যদি ঙনংবৎাবৎ-এর মধ্যে চেতনা থাকে তবেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের বিষয়টা চলে আসে। সমস্যা দেখা দিলো যখন চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করতে যাওয়া হলো তখন। কারণ পদার্থবিদ্যায় চেতনার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। পদার্থবিদ্যা চেতনা নিয়ে কাজ করে না, এটা মনোবিজ্ঞানের বিষয়।
চেতনাকে যখন সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না, তখন বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করলো যে- ‘চেতনা’ ব্যাপারটা নেই এমন থিওরি দিতে এবং তারা সমস্যার একাধিক সমাধানও করে ফেললো। এই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের বিষয়টা বেশ কিছু কোয়ান্টাম ইন্টারপ্রেটেশন থেকে এসেছে, এর মধ্যে কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রেটেশন খুব বিখ্যাত। কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রেটেশনে ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের কথা বলা আছে ঠিকই, কিন্তু ঠিক কী বা কে “অবজার্ভার” হিসেবে বিবেচিত হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা নেই। সুতরাং সে শুধুমাত্র “কনসাস অবজারভার” ইন্টারপ্রেটেশনটি বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে নীলস বোরসহ অনেকেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সকে শুধু প্রতীকী উপস্থাপনা বলে আখ্যায়িত করেছে। শেষমেশ ইউজিন উইগনার নিজেই চেতনার ব্যাপার-স্যাপার থেকে সরে দাঁড়ায়।
এদিকে জার্মান পদার্থবিদ ডিটিয়ার বেন বিড়াল সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে বলে যে- জীবিত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন আর মৃত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন আলাদা থাকবে, একটির সাথে অন্যটির কোনো যোগ থাকবে না। ফলে কোনো অবজার্ভারের দরকার পড়বে না। হিউ এভার্ট লিখলো যে- শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল একই সাথে জীবিত ও মৃত। কারণ জগৎ দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে- এক জগতে বিড়াল মৃত, অন্য জগতে বিড়াল জীবিত। জগৎ দুটি একই জায়গায় একই সময়ে হলেও তারা সম্পূর্ণ আলাদা। জগৎ যদি ভাগই হয়, তবে দুটো ভাগে কেন ভাগ হবে? আরো বেশি ভাগেই ভাগ হয়ে যাক! তৈরি হলো মাল্টিভার্স থিওরি, যেখানে একই সাথে একাধিক জগৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
প্রথমেই বেসিক প্রশ্ন- কোয়ান্টাম মেথড কি? তাদের দাবি মতে, “এক কথায় এটি- ঝপরবহপব ড়ভ খরারহম. খানকা শরীফের চৌহদ্দি থেকে বের করে ধ্যানকে গণমানুষের আত্মউন্নয়ন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে প্রয়োগ করাই তাদের উদ্দেশ্য। ধ্যানচর্চার মাধ্যমে প্রাচ্যের সাধনা আর আধুনিক বিজ্ঞানের নির্যাসে সঞ্জীবিত কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন প্রক্রিয়া। সাধকদের সাধনা ও মনোবিজ্ঞানের প্রক্রিয়ার সমন্বয়ের ফলে সহজে মেডিটেটিভ লেভেলে পৌঁছে আত্ম-নিমগ্ন হওয়া যায়। সোজা কথায় তথাকথিত ধ্যান চর্চার মাধ্যমে জীবনযাপনের বিজ্ঞান এটি।”
উল্লেখ্য, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এই ‘কোয়ান্টাম’ নামটি কিন্তু এসেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকেই। এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাবি হচ্ছে- “কোয়ান্টাম শব্দটি নেয়া হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আগে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত হতো নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিয়ে।”
পরমাণু পর্যন্ত নিউটনিয়ান মেকানিক্স ভালোভাবেই সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হচ্ছিলো। কিন্তু বিজ্ঞান যখন পরমাণুর গভীরে বা সাব-এটমিক লেভেলে ঢুকলো তখন দেখা গেলো, একটা সাব-এটমিক পার্টিকেল-পার্টিকেল ফর্মে আছে, নাকি এনার্জি ফর্মে আছে- তা হিসেব করে বলা যাচ্ছে না, দেখে বলতে হচ্ছে। যে কোনো সময় এটা পার্টিকেল ফর্মে থাকতে পারে, যে কোনো সময় এটা এনার্জি ফর্মে থাকতে পারে। এটাই হলো ওয়ার্নার হেইজেনবার্গের আনসারটেইনিটি প্রিন্সিপল। বিজ্ঞানে তখন আবার দর্শকের আগমন ঘটলো।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিংশ শতাব্দিতে এসে বিজ্ঞান থেকে নির্বাসিত মনকে আবার বিজ্ঞানে পুনর্বাসিত করে। যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিজ্ঞান থেকে নির্বাসিত মনকে বিজ্ঞানে পুনর্বাসিত করে, তাই চেতনার শক্তিকে, মনের বিশাল ক্ষমতাকে নিজের ও মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটির নামকরণ করা হয়েছে ‘কোয়ান্টাম মেথড’।
মন ও চেতনার ক্ষমতা সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির সার-সংক্ষেপ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার তার Remarks on the Mind-Body Question নিবন্ধে বর্ণনা করেছে। সে লিখেছে যে, “অধিকাংশ পদার্থ বিজ্ঞানীই এই সত্যকে মেনে নিয়েছে যে, চিন্তা অর্থাৎ মনই হচ্ছে মূল। চেতনার উল্লেখ ছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর নিয়মকে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণভাবে গঠন করা সম্ভব নয়।” নিবন্ধের উপসংহারে বিজ্ঞানী উইগনার বলেছে, “বিশ্বের বৈজ্ঞানিক গবেষণা শেষ পর্যন্ত চেতনাকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।”
যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্স কি বা এটা কি ধরনের থিওরির কথা বলে- এসব ব্যাপারে কোনো আলোচনা করেনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। তবে দেখা যাচ্ছে যে- কোয়ান্টাম মেকানিক্সে যেহেতু চেতনার বা মনের একটা কনসেপ্ট ঢুকেছিল, সেজন্য কোয়ান্টাম মেডিটেশনকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। এবং এ কারণেই এই ধ্যানচর্চার নামকরণ করা হয়েছে- কোয়ান্টাম মেডিটেশন। এটা ছাড়া কেয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই, অর্থাৎ অনিশ্চয়তার সূত্র বা মাল্টিভার্স থিওরি বা অন্য কোনো কিছুর সাথে এর কোনোই যোগাযোগ নেই!
তাছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটি বহুল পরিচিত ইন্টারপ্রেটেশন হচ্ছে- মেনি-ওয়ার্ল্ড ইন্টারপ্রেটেশন বা মাল্টিভার্স ইন্টারপ্রেটেশন। এর অর্থ হলো- বিড়াল একটা নিশ্বাস নিলো, অতিক্ষুদ্র হলেও তার ভর বাড়লো সুতরাং ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স। নিঃশ্বাস ছাড়লো? সাথে সাথে ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স। তাপমাত্রা পরিবর্তন হলো? সাথে সাথে কলাপ্স! অর্থাৎ কোনো মন বা চেতনা সম্পন্ন দর্শকের বাক্স খুলে বিড়াল দেখার আগেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স হয়ে বসে আছে!
তো আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন যে দাবি করছে- চেতনাই কোয়ান্টাম থিওরির সবকিছু, আসলে ব্যাপার সেটা নয়। উপরন্তু এই ‘চেতনা’ জিনিসটা ভৌতবিজ্ঞানের কিছু না হওয়াতে এবং একে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না দেখেই কোয়ান্টাম বিশ্বে চেতনাকে বাদ দেবার জন্য অনেক থিওরি তৈরি ও প্রমাণিত হয়। ‘চেতনা’ নামের জিনিসটা ছাড়াই বেশ ভালোভাবেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সবকিছু চলছে।
-আল্লামা মুহম্মদ তা’রীফুর রহমান।
ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো এখন বিদ্যমান ধর্মীয় আইন উৎখাতের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে
আল বাইয়্যিনাত-এর দেয়াল লেখনীর কারণে এখন উহাদের অবস্থা হইয়াছে ‘গোস্বায়, ক্ষোভে আঙ্গুল কামরাইবার মত’