মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-
وجاهدوا فى الله حق جهاده
অর্থ: “তোমরা আল্লাহ পাক-এর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত, সেভাবে জিহাদ করো।” (সূরাতুল হজ্জ-৭৮)
এ আয়াত শরীফ-এর ভিত্তিতে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জিহাদ করে গেছেন।
কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, ইহুদী, নাছারা তথা দ্বীন ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন:
غزوة গাযওয়াহ, سرية সারিয়াহ, جيش জাইশ ও بعث বা’ছ ইত্যাদি।
এগুলোর মধ্যে غزوة গাযওয়াহ এখানে আলোচ্য বিষয়।
غزوة গাযওয়াহ-এর সংজ্ঞা: “সাইয়্যিদুনা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমস্ত বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে পাঠিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন এবং যেগুলোতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে, সে সমস্ত জিহাদকে ‘গাযওয়াহ’ বলা হয়।”
গাযওয়াহ বা রক্তক্ষয়ী বড় যুদ্ধের সংখ্যা: গাযওয়াহ-এর সংখ্যা নিয়ে তারীখ বা ইতিহাস বিশারদগণের মধ্যে অনেক ইখতিলাফ দেখা যায়। গাযওয়া-এর সংখ্যার ব্যাপারে ২১টি/ ২৩টি/ ২৫টি/ ২৭টি/ ২৯টি পর্যন্ত মতামত রয়েছে। তবে জমহুর উলামায়ে কিরাম তথা অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আালাইহি-এর ছহীহ ও মশহুর মতে, গাযওয়ার সংখ্যা ২৭টি। যার একটি তালিকা নিম্নে পেশ করলাম:
২৭টি গাযওয়া তথা বড় জিহাদের তালিকা:
হযরত আল্লামা আলী ইবনে বুরহানুদ্দীন হালাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর লিখিত বিশ্ববিখ্যাত কিতাব “আস্ সীরাতুল হালাবীয়াহ ফী সীরাতি আমীনিল মা’মূন”-এর ‘বাবু যিকরি মাগাযীহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ পরিচ্ছেদে ২য় খণ্ড ৩৪২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
অর্থাৎ সাইয়্যিদুনা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানায় সংঘটিত গায্ওয়াহ-এর সংখ্যা ২৭টি। সমস্ত গাযওয়াহতেই মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেছিলেন। সেগুলো হচ্ছে:
১. غزوة العشيرة গাযওয়াতুল উশাইরাহ: যা সংঘটিত হয়েছিল ২য় হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে। কারো কারো মতে জুমাদাল উখরা মাসে। তবে প্রথম মতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। (সীরাতুদ দিমইয়াত্বী, আল ইমতা’)
২. سفوان غزوة গাযওয়াতু সাফওয়ান: এ গায্ওয়াহকে ‘গাযওয়াহতু বদরিল ঊলা’ও বলা হয়। গাযওয়াতুল উশাইরাহ-এর কয়েকদিন তথা প্রায় ১০ দিন পর এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। (সীরাতুশ্ শামী, সীরাতুদ দিমইয়াত্বী)
৩. غزوة بدر الكبرى গাযওয়াতু বদরিল কুবরা: এ গাযওয়াহকে ‘বদরুল উয্মা, বদরুল ক্বিতাল ও বদরুল ফুরকানও বলা হয়। কেননা , মহান আল্লাহ তায়ালা এ যুদ্ধের মাধ্যমে হক্ব ও বাত্বিলের পার্থক্য সৃষ্টি করে দেন। ২য় হিজরীর ১৭ই রমাদ্বান শরীফে মদীনা শরীফ থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে কুরাঈশ কাফিরদের বিরুদ্ধে এ জিহাদ সংঘটিত হয়। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ মতান্তরে ৩১৪ বা ৩১৫ জন। কাফিরদের সংখ্যা ছিল ১০০০ জন। তুমুল জিহাদের পর মুসলমানগণ জয়লাভ করেন আর কাফিররা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। জিহাদে মুসলমানগণের ১৪ জন শহীদ হন। আর কাফিরদের ১১ জন নেতাসহ ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্ধী হয়। (দিমইয়াত্বী, ইবনে আসাকির, ইবনে হিশাম)
৪. غزوة بنى سليم গাযওয়াতু বনী সালীম: গাযওয়াতুল্ বদর-এর ৭ দিন পর এ জিহাদ সংঘটিত হয়। (আবূ দাঊদ শরীফ)
৫. غزوة بنى قينقاع গাযওয়াতু বনী কাইনুক্বা: এ জিহাদ ইহুদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল।
৬. غزوة قرقرة القدر গাযওয়াতু ক্বরক্বরাতিল্ ক্বদর: এ গাযওয়াহকে ‘ক্বরীরাতুল ক্বদর ও ক্বরাক্বির’ও বলা হয়।
৭. غزوة ذى امر গাযওয়াহ যী আমার: এ গাযওয়াহকে ‘গাযওয়াহতু আনমার ও গাযাওয়াাতু গাত্ফান’ও বলা হয়। এ জিহাদ ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল শরীফ-এ সংঘটিত হয়।
৮. غزوة نجران بالحجاز গাযওয়াহতু নাজরান বিল হিজায: এ গাযওয়াহকে ‘গাযওয়াতু বাহরান’ও বলা হয়। ৩য় হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
৯. غزوة احد গাযওয়াহ উহুদ: উহুদ মদীনা শরীফ-এর একটি পাহাড়ের নাম। জমহুর উলামায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের মতে, ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসে এ জিহাদ সংঘটিত হয়। এতে মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেন। আর কাফিররা পরাজিত হয়। এ জিহাদেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একখানা দাঁত মুবারক শহীদ হয় এবং ৭০ জন ছাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। (দিমইয়াত্বী, ইবনে হিশাম, বুখারী শরীফ, তিরমিযী শরীফ)
১০. غزوة حمراء الأسد গাযওয়াতু হামরায়িল আসাদ।
১১. غزوة بنى النضير গাযওয়াহ বনী নদ্বীর: বনী নদ্বীর ছিল মদীনা শরীফ-এর ইহুদী সম্প্রদায়। এদের বিরুদ্ধে এ জিহাদ হয়েছিল। ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল শরীফ-এ এ জিহাদ সংঘটিত হয়। (বুখারী শরীফ, ইবনু কাছীর, ইবনু ইসহাক্ব)
১২. غزوة ذات الرقاع গাযওয়াহ যাতির রিক্বা: এ গাযওয়াহকে “গাযওয়াতু মাহারিব, গাযওয়াতুল্ আয়াজীব, গাযওয়াতু তাগলাবাহ, গাযওয়াতু ছা’লাবাহ ও গাযওয়াতু বনী আনমার”ও বলা হয়। এ যুদ্ধ ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল, মতান্তরে: রবীউছ্ ছানী, মতান্তরে: জুমাদাল উলা মাসে সংঘটিত হয়েছিল। (ইবনে ইসহাক, দিমইয়াত্বী, ইবনে কাছীর)
১৩. غزوة بدر الاخرى গাযওয়াতু বদরিল উখরা: এ গাযওয়াহকে ‘গাযওয়াহতু বদরিল মাওয়াদ’ ও বলা হয়। ৪র্থ হিজরীর শা’বান মাসে সংঘটিত হয়।
১৪. غزوة دومة الجندل গাযওয়াতু দূমাতিল জানদাল: ৪র্থ হিজরীর শেষের দিকে, আবার কারো মতে, ৫ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
১৫. غزوة بنى المصطلق গাযওয়াতু বনিল্ মুছতালিক: এ গাযওয়াহকে “গাযওয়াতুল মুরাইসী, গাযওয়াতু মহারিব ও গাযওয়াহতুল আয়াজীব’ ও বলা হয়।
১৬. غزوة الخندق গাযওয়াতুল্ খন্দক: যাকে ‘গাযওয়াতুল আহযাব’ও বলা হয়। ৫ম হিজরীতে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
১৭. غزوة بنى قريظة গাযওয়াহতু বনী কুরাইযাহঃ মদীনা শরীফ-এর ইহুদীদের সাথে এ যুদ্ধ হয়েছিল।
১৮. غزوة بنى لحيان গাযওয়াহ বনী লিহ্ইয়ান: এটি হুযাইল গোত্রের একটি ক্ববীলাহ। বনী কুরাইযাহ-এর ৬ মাস পর এ জিহাদ সংঘটিত হয়।
১৯. غزوة ذى قرد গাযওআতু যী ক্বারাদ: এ জিহাদকে ‘গাযওয়াতুল্ গাবাহ্’ও বলা হয়। ‘বনী লিহ্ইয়ান জিহাদের কয়েকদিন পর এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
২০. غزوة الحديبية গাযওয়াহতুল্ হুদাইবিয়াহ: ৬ষ্ঠ হিজরীতে যুল হিজ্জাহ মাসে সংঘটিত হয়।
২১. غزوة خيبر গাযওয়াহতু খাইবার: জমহুর উলামায়ে কিরামের মতে, ৭ম হিজরীর মুর্হরম মাসের শুরুর দিকে এ যুদ্ধ হয়। কারো মতে, ৬ষ্ঠ হিজরীতে। আবার কারো মতে, ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধের পর খাইবার যুদ্ধ হয়।
২২. غزوة وادى القرى গাযওয়াতু ওয়াদিল্ কুরা: এ জিহাদও ইহুদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। খাইবার থেকে ফিরার পর পরই এ জিহাদ হয়।
২৩. غزوة عمرة القاضى গাযওয়াতু উমরাতিল্ ক্বাদা: এ গাযওয়াহ-কে “উমরাতুল ক্বাদ্বিয়াহ, উমরাতুছ্ ছুল্হ, উমরাতুল্ ক্বছাছ”ও বলা হয়। ৭ম হিজরীর যুল কা’দাহ মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
২৪. غزوة فتح مكة গাযওয়াতু ফাত্হি মক্কাঃ যা ৮ম হিজরীতে সংঘটিত হয়।
২৫. غزوة حنين গাযওয়াতু হুসাইন।
২৬.غزوة الطائف গাযওয়াতুত ত্বায়িফ।
২৭. غزوة تبوك গায্ওয়াতু তাবূক।
উল্লিখিত ২৭টি গাযওয়াহ-এর মধ্যে ৯টি আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সরাসরি পরিচালনা করেছেন। সে ৯টি গাযওয়াহ হচ্ছেঃ ১. বদর ২. উহুদ ৩. আহযাব বা খন্দক ৪. বনী কুরাইযাহ ৫. বনী মুছ্তালিক ৬. খাইবার ৭. ফাত্হি মক্কাহ ৮. হুনাইন ৯. তাবুক (ফতহুল রাবী, উমদাতুল ক্বারী, হাশিয়ায়ে বুখারী ২য় খণ্ড ৫৬৩ পৃষ্ঠা)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে নিজেই সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন এবং উম্মতকে জিহাদ করতেও বলেছেন। সাধারণভাবে জিহাদ করা ফরযে কিফায়াহ। তেমনিভাবে দায়িমী জিহাদ তথা নফসের সাথে জিহাদ করতেও নির্দেশ করেছেন।
তাফসীরে বাগবীতে হাদীছ শরীফ উল্লেখ রয়েছে। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, তাবূকের জিহাদ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে লক্ষ্য করে বললেন,
رجعنا من الجهاد الاصغر الى الجهاد الاكبر
অর্থ: “আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম।”
জিজ্ঞাসা করা হলো, জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ কি? তিনি বললেন, নফ্স বা প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ করা। (বাইহাক্বী শরীফ)
অতএব, প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর উপর ফরয-ওয়াজিব হক্কানী-রব্বানী আউলিয়া কিরামের ছুহবত অর্জনের মাধ্যমে যিকির-ফিকির করে নফসকে ইছলাহ করে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি রিযামন্দী অর্জন করা। আল্লাহ পাক তাওফীক্ব দান করুন। কবূল করুন। (আমীন)
হাফিয সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ