মহান আল্লাহ পাক তিনি সমস্ত কিছুর খলিক্ব-মালিক, রব। তিনি একক, তিনি অনন্য, তিনি নিরপেক্ষ, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সকলেই উনার মুখাপেক্ষী। তিনি চিরজাগরূগ, চির বিদ্যমান। তিনি কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেননি এবং কাউকে জন্মও দেননি। উনার কেউ সমকক্ষ ও শরীক নেই। তিনি অনাদি, অনন্ত। তিনি চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। তিনি কালের গ-িভুক্ত নন। তিনি সর্বশক্তিমান ও পরাক্রমশালী। তিনি দয়াশীল ও করুণাময়। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই করেন। জগতের সবকিছুই উনার ইচ্ছা মুবারকেই হচ্ছে। তিনি সবকিছুই জানেন, শুনেন ও দেখেন।
ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর পরমাণু, গুপ্ত হতে গুপ্ততর কল্পনা এবং ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর শব্দ কিছুই উনার দেখা, শুনা ও জানার বাইরে নয়। তিনি কথা বলেন, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার বাণী বা কালাম। কিন্তু এ সকল গুণ প্রকাশের জন্য তিনি আমাদের ন্যায় দেহ বা কোন ইন্দ্রিয়ের মুখাপেক্ষী নন। তিনি এ সকল গুণ কিভাবে প্রকাশ করেন তা তিনি নিজেই জানেন। তা আমাদের জ্ঞান সীমার বাইরে। তিনি সমস্ত সৎ গুণাবলীতে গুণান্বিত এবং যাবতীয় অসৎ গুণাবলী হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। তিনিই সমস্ত জগতকে, মানুষ ও মানুষের কার্যাবলীকে, বস্তু ও বস্তুর গুণাবলীকে সৃষ্টি করেছেন। আমরা উনার সৃষ্ট বান্দা। আমাদের উপর উনার পুরোপুরি হুকুম জারি করার অধিকার রয়েছে এবং এই অধিকার বলেই তিনি আমাদের জীবন-যাপনের জন্য যাবতীয় আবশ্যক নিয়ম পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
আমরা উনার সকল নিয়ম বা পদ্ধতির অনুসরণ করে চলতে বাধ্য। উনার কোন হুকুম বা কার্যই অন্যায়-অবিচার প্রকৃতির নয়। তিনি যা করেন সবই ন্যায়। সবই সৃষ্টির কল্যাণের জন্য করেন। অন্যায়-অবিচার তখনই হয় যখন কেউ উনার কর্তৃত্বের মধ্যে হস্তক্ষেপ করে। আর তিনি যা করেন তা উনার নিজের ক্ষমতায়ই করেন। তিনি উনার সৃষ্ট যে বস্তু বা যাকে যেরূপ সৃষ্টি করেছেন, তা তারই উপযোগী, তাই তার জন্য কল্যাণজনক। তিনি যাকে যা করেন, আপন অনুগ্রহেই করে থাকেন। কিছুই উনার উপর অপরিহার্য বা অবশ্য কর্তব্য নয়। তিনি পাপের শাস্তি এবং পুণ্যের পুরস্কার দেন, কিন্তু কোনটিতেই তিনি বাধ্য নন।
এ সমুদয় গুণ-বৈশিষ্ট্যসমূহ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে। পবিত্র কুরআন শরীফ উনার প্রথম সূরা পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ থেকে শুরু করে সর্বশেষ সূরা পবিত্র সূরা নাস শরীফ পর্যন্ত প্রতিটি সূরা শরীফ উনাদের মধ্যেই মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র যাত-ছিফত মুবারক উনার বর্ণনা বা আলোচনা রয়েছে। সুবহানাল্লাহ!
যেমন পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
اَلْـحَمْدُ لِلّٰهِ رَبّ الْعَالَمِيْنَ . اَلرَّحْـمٰنِ الرَّحِيْمِ . مَالِكِ يَوْمِ الدّيْنِ .
অর্থ : æসমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য, যিনি সকল সৃষ্টি জগতের রব বা পালনকর্তা, যিনি পরম দয়ালু, অতিশয় করুণাময়, যিনি ক্বিয়ামত দিবসের মহান মালিক।” (পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১-৩)
পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
اللهُ لَا الٰهَ الَّا هُوَ الْـحَيُّ الْقَيُّوْمُ ۚ لَا تَاْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْاَرْضِ ۗ مَنْ ذَا الَّذِيْ يَشْفَعُ عِنْدَهُ الَّا بِاذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ اَيْدِيْهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُـحِيْطُوْنَ بِشَيْءٍ مّنْ عِلْمِهِ الَّا بِـمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضَ ۖ وَلَا يَئُوْدُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
অর্থ : æমহান আল্লাহ পাক তিনি এমন যে, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি চিরস্থায়ী, সংরক্ষণকারী। উনাকে তন্দ্রা ও নিদ্রা কোনটাই স্পর্শ করতে পারে না। উনারই অধিকারে রয়েছে যা কিছু আসমানসমূহ এবং যমীনে রয়েছে। এমন কে আছে, যে সুপারিশ করবে উনার কাছে উনার অনুমতি ব্যতীত। দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সবই তিনি জানেন। উনার ইলমের কোন কিছুকেই তারা (সৃষ্টি) পরিবেষ্টিত বা আয়ত্ব করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন তা ব্যতিত। উনার ক্ষমতা সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে রয়েছে। আর উনার পক্ষে এতদুভয়ের সংরক্ষণ করা কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৫৫)
পবিত্র সূরা ইখলাছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ . اللهُ الصَّمَدُ . لَـمْ يَلِدْ وَلَـمْ يُوْلَدْ . وَلَـمْ يَكُنْ لَّهُ كُفُوًا اَحَدٌ .
অর্থ : (হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি বলে দিন, তিনিই মহান আল্লাহ পাক এক। মহান আল্লাহ পাক তিনি বেনিয়াজ বা অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি অর্থাৎ উনার কোন সন্তান-সন্তুতি নেই। উনাকেও কেউ জন্ম দেয়নি অর্থাৎ তিনি কারো সন্তান নন। আর উনার সমতুল্য বা সমকক্ষ কেউ নেই।
পবিত্র সূরা নাস শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
قُلْ اَعُوْذُ بِرَبّ النَّاسِ . مَلِكِ النَّاسِ . الٰهِ النَّاسِ .
অর্থ : æ(হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি বলুন, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানবকুলের রব বা প্রতিপালক উনার কাছে, মানবকুলের মালিক বা অধিপতি উনার কাছে এবং মানবকুলের ইলাহ বা মা’বুদ উনার কাছে।” (পবিত্র সূরা নাস শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১-৩)
এমনিভাবে অসংখ্য পবিত্র আয়াতে কারীমাসমূহ উনাদের মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র যাত মুবারক ও ছিফাত মুবারক সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।
পবিত্র সূরা হাশর শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
هُوَ اللهُ الَّذِيْ لَا الٰهَ الَّا هُوَ ۖ عَالِـمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ ۖ هُوَ الرَّحْـمٰنُ الرَّحِيمُ . هُوَ اللهُ الَّذِيْ لَا الٰهَ الَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوْسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيْزُ الْـجَبَّارُ الْمُتَكَبّرُ ۚ سُبْحَانَ اللهِ عَمَّا يُشْرِكُوْنَ . هُوَ اللهُ الْـخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوّرُ ۖ لَهُ الْاَسْـمَاءُ الْـحُسْنٰى ۚ
অর্থ : æতিনিই মহান আল্লাহ পাক তিনি এমন যে, তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ বা মা’বূদ নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, পরাক্রান্ত, প্রতাপান্বিত, মাহাতœশীল। তারা যাকে অংশীদার সাব্যস্ত করে মহান আল্লাহ পাক তিনি তা থেকে পবিত্র। তিনিই মহান আল্লাহ পাক যিনি সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবক, আকৃতিদাতা। উনার অনেক সুন্দর সুন্দর নাম মুবারক রয়েছে।” (পবিত্র সূরা হাশর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২২, ২৩, ২৪)
পবিত্র সূরা শূরা শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ .
অর্থ : æমহান আল্লাহ পাক উনার অনুরূপ কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (পবিত্র সূরা শূরা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১)
মহান আল্লাহ পাক তিনি অপার অশেষ ছানা-ছিফত মুবারক উনার অধিকারী। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-
لَوْ اَنَّـمَا فِي الْاَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ اَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَـمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ اَبْـحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللهِ ۗ اِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ
অর্থ : æপৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং সমুদ্রের সাথে আরো সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয় তবুও মহান আল্লাহ পাক উনার ছানা-ছিফত বা প্রশংসাবলী লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (পবিত্র সূরা লুক্বমান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
لا احى ثناء عليك ولو حرصت ولكن انت كما اثنيت على نفسك
অর্থ : æ(হে বারে ইলাহী!) আমার পক্ষে আপনার ছানা-ছিফত মুবারক বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়, যদিও আমার ছানা-ছিফত মুবারক করতে ইচ্ছে হয়। আপনিতো ওই রকম যেরকম নিজেই নিজের ছানা-ছিফত মুবারক করেছেন।” (জামউল ওসায়িল শরীফ)
স্মরণীয় যে, মহান আল্লাহ পাক উনার যাতী বা সত্ত্বাগত একমাত্র নাম মুবারক হচ্ছে اَللهُ (আল্লাহ)। আর বাকী সব হচ্ছে উনার ছিফতী বা গুণ বাচক নাম মুবারক।
মহান আল্লাহ পাক উনার যাত পাক ওয়াজিবুল ওজূদ। তিনি হাদেছ বা সৃষ্ট নন। মহান আল্লাহ পাক তিনি জিসিম বা দেহ, ছূরত বা আকার-আকৃতি এবং দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, ভেদ ও সাদৃশ্য ইত্যাদি হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র।
আর তাই আক্বাইদের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে-
الله منـزه عن جسم وعرض وجوهر وتصوير وتعديد وتبعيض وتجزيئ وتركيب وتناهى
অর্থ : æমহান আল্লাহ পাক তিনি দেহ, চওড়া বা প্রশস্ততা, পরিধি বা ব্যাস বা বস্তু, ছূরত বা আকার-আকৃতি, সংখ্যা, টুকরা, অংশ সম্মিলিত রূপ, শেষ হওয়া, সীমা ইত্যাদি থেকে পবিত্র।” (আক্বাইদে নাসাফী শরীফ)
অনুরূপভাবে আকাইদের বিখ্যাত কিতাব আক্বায়িদুত তহাবী শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে যে, æনিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি এক। উনার কোন শরীক নেই। উনার মতো কিছুই নেই অর্থাৎ উনার সমতুল্য কেউ নেই। কোন কিছুই উনাকে অক্ষম করতে পারে না। তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি অনাদি, উনার কোন আদি নেই। তিনি অনন্ত, উনার কোন অন্ত নেই। উনার ক্ষয় নেই এবং ধ্বংস নেই। উনার ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই সংঘটিত হয় না। কল্পনা উনার ধারে কাছেও পৌছেনা। জ্ঞান উনাকে উপলব্ধি করতে পারে না। কোন সৃষ্ট বস্তুই উনার সাদৃশ্য হতে পারে না। তিনি চিরজীবি। উনার মৃত্যু বা ইনতিকাল নেই। তিনি চিরজাগ্রত। উনার নিদ্রার প্রয়োজন নেই। তিনি সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ কোন কিছুর সাহায্য ব্যতীতই তিনি সবকিছু সৃষ্টি করতে পারেন। তিনি নির্ভয়ে প্রাণ সংহারকারী এবং নির্বিবাদে পুনরূত্থানকারী। তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। তিনি কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন এবং উনার মতো কোন কিছুই নেই। তিনি কারো প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমকক্ষ হওয়ার উর্ধ্বে। সীমা-পরিধির উর্ধ্বে। তিনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সাজ-সরঞ্জামের উর্ধ্বে।”
অতএব মনে রাখতে হবে, যে সকল পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ দ্বারা মহান আল্লাহ পাক উনার দেহ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আকার-আকৃতি থাকার ধারণা সৃষ্টি হয় সে সকল পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত। এ সকল পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের যাহিরী বা আভিধানিক অর্থ গ্রহণ না করে তা’বীলী বা ব্যাখ্যামূলক অর্থ গ্রহণ করতে হবে।
অতএব, মহান আল্লাহ পাক তিনি নূর বা আলো কিংবা তিনি নূর বা আলোর সৃষ্টি আক্বীদা পোষণ করা ঐরূপ কুফরী যেরূপ কুফরী মহান আল্লাহ পাক উনার আকার-আকৃতি রয়েছে বলে স্বীকার করা ও বিশ্বাস করা।
-আল্লামা মুফতী শুয়াইব আহমদ