একটা রাজনৈতিক দলের প্রাণ হলো তাদের গঠনতন্ত্র যা আসলে দলের সংবিধান। একবার গৃহীত হলে সেই অনুসারে কর্মী বাহিনী তৈরি করা এবং নেতৃত্ব গঠন করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করে সেই দলটি। কিন্তু জামাতের ক্ষেত্রে দেখা যায় উল্টো। সেখানে নেতৃত্ব থাকে অটুট কিন্তু দলের আদর্শ বদলায়। অনেকটা গোলপোস্ট বদলানোর মতো। অথবা বলতে পারি হুকুম নড়ে কিন্তু হাকিম নড়ে না। এদের ভণ্ডামী এবং মুনাফিকীর সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো এদের গঠনতন্ত্র সংশোধনের একটা রেকর্ড তৈরি করা।
উল্লেখ করা দরকার যে- গঠনতন্ত্র হলো দলের মূলমন্ত্র তথাপি এতে মোট ৪৬ বার সংশোধন আনা হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ৮টি ধারায় সংশোধন করতে জামাতকে বলা হয়, তখন তড়িঘড়ি করে সেই ধারাগুলো লালকালি দিয়ে কেটে দেয়। কোন একসময় তারা দলের ওয়েবসাইটে মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দিয়েছে। স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটি স্বাধীনতার পর প্রায় চারদশক তাদের গঠনতন্ত্রে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটা উচ্চারণ করেনি। অবশেষে নির্বাচন কমিশনের চাপে তা করতে বাধ্য হয়েছে।
ফাঁক-ফোকড় সহকারে জামাতের নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে স্বাধীনতা স্বপক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের সোচ্চারের মুখে “গণতান্ত্রিক পদ্ধতি” অনুসরণে গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন আনে। নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে দলটি গঠনতন্ত্র থেকে “আল্লাহ প্রদত্ত এবং রসূল প্রদর্শিত ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার” কথা বাদ দিয়ে “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার” কথা বলেছে। এছাড়া “আল্লাহ ব্যতীত কাহাকেও স্বয়ংম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তাহার দেওয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে” এ নীতিও বাদ দিয়েছে দলটি। কিন্তু এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ “আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইনপ্রণেতা মানিয়া লইবে না” কথা রেখেই ইসিতে গঠনতন্ত্র জমা দেয় দলটি।
নির্দেশিত যেসব ধারায় সংশোধনী আনা হয়নি, পরিবর্তন হয়নি এবং আংশিক পরিবর্তন হয়েছে তা পুরোপুরি সংশোধনের জন্য দলটিকে আবারো চিঠি দেবে বলে জানায় নির্বাচন কমিশন।
প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশের কথা উল্লেখ করে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দুই মাসের সময় চায় জামাত। তবে তাদেরকে সে সময় দেয়া হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই দলটি গঠনতন্ত্র সংশোধন করে তার মুদ্রিত কপি কমিশনে জমা দেয়।
এর আগে নির্বাচন কমিশন জামাতের গঠনতন্ত্রের ২ ধারার ৫ উপধারা, ধারা ৩, ৫ ধারার ৩ উপধারা, ৬ ধারার ৪ উপধারা, ৭ ধারার ১ থেকে ৪ উপধারা, ১১ ধারার ২ উপধারা ও ১৮ ধারার ৪ (চ) উপধারা সংশোধনের তাগিদ দেয়। দলটির নিবন্ধনের সময়ও এসব ধারা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং জামাতের কেন্দ্রীয নেতা ও কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট জসীম উদ্দিন সরকার তখন তাদের গঠনতন্ত্র থেকে কয়েকটি ধারা লাল কালি দিয়ে কেটে দিয়ে তা গঠনতন্ত্রের অংশ নয় মর্মে স্বাক্ষর করে।
৩ ধারায় দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভূমিকাসহ ৪টি উপধারাতে “আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত পথ থেকে দ্বীন (ইসলামী জীবন বিধান) কায়েমের প্রচেষ্টার” কথা বলা ছিল। সেগুলো বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি অর্জন’ বাক্যটি সংযোজন করা হয়েছে।
৫ ধারা ৩ উপধারায় বলা ছিল, ‘সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করিয়া সমাজ হইতে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটাইবার আহ্বান জানাইবে।’ এ অংশ থেকে ‘ইসলামের’ শব্দটি বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি’ কথাটি সংযোজন করা হয়েছে।
৬ ধারার ৪ উপধারায় বলা ছিল, ‘ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠাকল্পে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বাঞ্ছিত সংশোধন আনায়নের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা।’ এ কথাগুলো থেকে ‘খোদাভীরু’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘চরিত্রবান’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে।
৭ ধারার ১ থেকে ৪ উপধারায় জামায়াতের সদস্য হতে হলে ইসলামে বিশ্বাস ও শরীয়তের নির্ধারিত ফরজ ও ওয়াজিব আদায়ের শর্ত দেয়া ছিল। এগুলোও বিলুপ্ত করা হয়েছে।
১১ ধারার ২ উপ ধারায় যে কোনো অমুসলিম নাগরিক কয়েকটি শর্ত পূরণের মাধ্যমে জামাতের সদস্য হতে পারবে বলা ছিল। এ উপধারাটি দলের গঠনতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক ও স্ব-বিরোধী বলে জানায় নির্বাচন কমিশন। জামাত এ উপধারাটিও বিলুপ্ত করেছে।
জামাতের গঠনতন্ত্রের ১৮ ধারার ৪ (চ) উপধারায় বলা ছিল ‘আমীরে জামাত কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সহিত পরামর্শ করিয়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যকে (রুকনকে) কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য মনোনীত করিতে পারিবেন।’ এটি আরপিও পরিপন্থী মর্মে উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশন। সংশোধিত গঠনতন্ত্রে এ উপধারাটিও বিলুপ্ত করা হয়েছে।
জামাতকে তাদের গঠনতন্ত্রের ৬৪ পৃষ্ঠার বিশেষ নোটের দফা ৩-এ সংশোধনী আনারও তাগিদ দিয়েছিল ইসি। এতে দলের সব কমিটিতে আরপিও অনুসারে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ মহিলা সদস্যের স্থলে অধিকাংশ কমিটিতে ২৫ শতাংশ মহিলা সম্পৃক্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ৩৩ শতাংশ মহিলা সম্পৃক্ত করে ৬৯ ধারায় সন্নিবেশ করা হয়েছে।
এখন জামাতের নতুন গঠনতন্ত্রের চেহারাটা তাহলে কি দাঁড়ায় –
(১) শ্লোগান আকিম উদ দ্বীন (দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা) বাদ দেওয়া হয়েছে।
(২) মহান আল্লাহ পাক উনার ও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের প্রদর্শিত পথ থেকে দ্বীন (ইসলামী জীবন বিধান) কায়েমের প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি অর্জন’ সংযোজন করা হয়েছে।
(৩) সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করিয়া সমাজ হইতে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটাইবার আহ্বান জানাইবে। এই লাইন থেকে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতিষ্ঠার কথা বাদ দিয়ে “গণতান্ত্রিক” শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
(৪) সদস্য হওয়ার শর্ত হিসাবে “খোদাভীরু” বাদ দিয়ে “চরিত্রবান” করা হয়েছে।
(৫) নারী নেতৃত্ব হারাম প্রচার করলেও এখন ৩৩% নারী মজলিসে সূরায় নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
(৬) জামাতে সদস্য হওয়ার শর্ত হিসেবে- পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার বিশ্বাস ও শরীয়তের নির্ধারিত ফরজ ও ওয়াজিব আদায় বাধ্যতামূলক ছিল তা বাতিল করা হয়েছে।
(৭) নতুন সংযোজন হিসেবে কিছু শর্ত সাপেক্ষ অমুসলিমরাও জামাতে সদস্য হওয়ার সুযোগ পাবে বলে নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে তা হলো- “মহান আল্লাহ পাক উনাকে ব্যতীত কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং মহান আল্লাহ পাক উনার আনুগত্য ও উনার দেয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে।” এখন জামাত নামক দলটি মহান আল্লাহ পাক উনাকে ব্যতীত অন্য যে কাউকে বিধানদাতা মানিয়া লইবে যা মুনাফিকদের আসল চরিত্র প্রতিফলন করে।
যদি সারসংক্ষেপের দিকে তাকাই তা হলে দেখা যাবে- জন্মলগ্ন থেকে ১৯৭১ সালের গণহত্যার অংশীদার জামাত যে কথাগুলো জোর গলায় প্রচার করতো- তা তাদের গঠনতন্ত্র থেকে বাদ দিয়ে একটা সেক্যুলার দলে রূপান্তিত হয়েছে। এই দলে এখন নাস্তিক মুশরিক সবাই যোগদান করতে পারবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো- জামাতের নেতারা যখন কলমের খোঁচায় একের পর এক মূল আদর্শ কেঁটে ফেলে দিচ্ছিলো তখন তারা মহান আল্লাহ পাক উনার আইন কায়িমের জন্যে জানবাজ কর্মী নিয়ে পরিবেষ্টিত হয়ে নির্বাচন কমিশনে জমা দিচ্ছিলো। তখন তারা হরতাল করেনি, গাড়ী ভাঙ্গেনি। মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদর্শ বাদ দিতে তাদের মধ্যে সামান্য প্রতিবাদ করার মতো কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু দলের গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত নেতাদের বাঁচানোর জন্যে এরা রাস্তায় নেমে পুলিশ পেটাচ্ছে। মানুষকে হত্যা করছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে বিচার বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
এদের কার্যকলাপে স্পষ্টত এরা বুঝিয়ে দিচ্ছে- এদের কাছে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে সংগ্রম করা চেয়ে নেতাদের বাঁচানোটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এরা অবলীলায় দলের আদর্শ থেকে মহান আল্লাহ পাক উনার নাম কেঁটে ফেলতে পারে- কিন্তু গণহত্যার অপরাধের কথা স্বীকার করে তওবা করতে পারে না।
৯০-এর দশকে এরা সামরিক শাসক জিয়ার দল বিএনপির ছত্রচ্ছায়ায় সংসদে ঢুকে পড়ে একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সুবাদে আওয়ামী লীগের সাথেও ঘেষাঁঘেঁষি করে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো চেষ্টা করে। পরবর্তীতে জোট করে বিএনপির বদৌলতে মন্ত্রীসভায় আসনও পেয়ে যায় জামাতের নেতারা।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী জামাতের নেতাদের ক্ষমতারোহণ পরই মূলত আসল চেহারা বের হয়ে আসে। মুখে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার কথা বললেও ৫ বছরের সংসদের কোন আলোচনায় পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার আইনের কোন প্রসঙ্গকে সামনে আনেনি। এমনকি বিএনপির প্রবল দুর্নীতিকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সহায়তাই করেছে। সবচেয়ে লজ্জার কথা হলো জামাত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসাবে পাঁচ বছরে সরকারি কোষাগারের কোটি টাকা খরচ করে দলীয় ও সাংগঠনিক কাজে ব্যয় করলেও সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেজিস্টার্ড পতিতালয়ের ব্যবসা বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ নেয়নি। যথারীতি মদ ও পতিতার লাইসেন্স ইস্যু করেছে। কিন্তু তারপরেও তারা জামাতে ইসলামী নাম ধারণ অব্যাহত রেখেছে। মূলত এরাই পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের মাঝে বর্ণিত মুনাফিক। এদেরই স্থান জাহান্নামের অতল গহ্বরে। নাঊযুবিল্লাহ
-মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান
প্রসঙ্গঃ আমেরিকায় ইহুদী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ- ২
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩৪
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা- ১