-আল্লামা আবুল বাশার মুহম্মদ রুহুল হাসান
(বর্তমান সংখ্যার আলোচনা: অমাবস্যা শেষে চাঁদ প্রায় ৯ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই সারা পৃথিবীকে দেখা দিয়ে যায় বা প্রদক্ষিণ করে এটি একটি যুক্তিহীন ও অবাস্তব ধারণা)
জনৈক অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস আদিল “বিশ্বজুড়ে একই দিনে রোজা ও ঈদ” শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেই গ্রন্থের ৪৩ পৃষ্ঠায় অধ্যাপক সাহেব লিখেছেন, “অমাবস্যা শেষে চাঁদ যখন স্বীয় কক্ষপথে পরিভ্রমণ শুরু করে তখন থেকে প্রায় ৯ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই সে সারা পৃথিবীকে দেখা দিয়ে যায় বা প্রদক্ষিণ করে। এই ৯ ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীর কোন না কোন এলাকায় সে দেখা দেবেই আর এই দেখাই সারা পৃথিবীর জন্য কার্যকর হবে। তবে বাংলাদেশ থেকে চাঁদ দেখার খবর সংগ্রহের জন্য ৯ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না বরং দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ভেতরেই চাঁদ দেখার খবর সংগ্রহ করা যাবে।”
তথাকথিত অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস আদিল সাহেব তার লেখায় অনেক ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন।
১। ৯ ঘণ্টার মধ্যে কখনই চাঁদ সমস্ত পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে না।
২। অমাবস্যার ৯ ঘণ্টা পরেই পৃথিবীর কোন না কোন স্থানে চাঁদ দৃশ্যমান হবে এটিও সঠিক তথ্য নয়।
৩। পৃথিবীর কোনস্থানে চাঁদ দেখা গেলেই তা সারা পৃথিবীর জন্য কার্যকর হবে- এ কথাটি যেমন কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ সমর্থিত কথা নয় তেমনি একই দিনে সারা পৃথিবীতে ঈদ ও রোযা পালন শুরু করা বাস্তবে অসম্ভব।
বাংলাদেশ থেকে চাঁদ দেখার খবর সংগ্রহের জন্য ৯ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না বরং দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ভেতরেই চাঁদ দেখার খবর সংগ্রহ করা যাবে এটি একটি অবান্তর ও অযৌক্তিক কথা।
১ এর ব্যাখ্যা:
আমরা সবাই জানি যে, অমাবস্যার পর চাঁদ যে দিন দৃশ্যমান হয় সেদিন থেকে ঠিক ২৯ দিন পর আমরা আবার দিগন্ত রেখায় চাঁদ তালাশ করি। অর্থাৎ এই ২৯ দিনে কখনও ৩০ দিনে চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একবার তার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে (চাঁদের অসমগতির জন্য চন্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট না হয়ে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কম বা বেশী হতে পারে) পৃথিবীর কোন স্থানে চাঁদ প্রথম দৃশ্যমান হলে তার পূর্ববর্তী স্থান অর্থাৎ যেখানে অল্পের জন্য চাঁদ দৃশ্যমান হয়নি সেখানে পুনরায় চাঁদ দৃশ্যমান হবার জন্য পরবর্তী সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেখানে অমাবস্যার ৯ ঘণ্টা পর পৃথিবীর সমস্ত স্থানে চাঁদ দেখা দিয়ে যায় বা প্রদক্ষিণ করে তথ্যটি একেবারেই মনগড়া এবং কল্পনাপ্রসূত।
উদাহরণ হিসেবে ১৪২৮ হিজরীর রজব মাসের চাঁদের রিপোর্ট ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ১৪ জুলাই, শনিবার সন্ধ্যায় হাওয়াই এবং কিরিবাতি দ্বীপগুলোতে চাঁদ প্রথম দৃশ্যমান হতে পারে এবং সেদিন পৃথিবীর আর কোথাও চাঁদ দেখা যাবে না। ১৫ জুলাই, রবিবার পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চল চাঁদ দেখতে পেলেও নিউজিল্যান্ড, নর্থ ইউরোপ এবং নর্থ এশিয়ার কিছু অংশ চাঁদ দেখতে পেতে পারে ১৬ই জুলাই সন্ধ্যায়। একটি বিষয় বলে রাখা ভাল, যেসব দেশগুলোতে ১৬ই জুলাই চাঁদ দেখতে পাবে তারাও কিন্তু চন্দ্রমাস ২৯ বা ৩০ দিনেই পূর্ণ করবে।
২ এর ব্যাখ্যা:
অমাবস্যার পর, চাঁদের বয়স নির্ধারণ করে কখনই চাঁদ দেখা সম্ভব নয়। কেননা চাঁদ দেখতে পাবার জন্য শুধু চাঁদের বয়স শর্ত নয়। এ ছাড়াও আরো অনেক বিষয় জড়িত। চঁদ একটি উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘুরে। চাঁদ কখন পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে প্রদক্ষিণ করে, তখন তার গতি বৃদ্ধি পায় আবার কখনও দূর দিয়ে প্রদক্ষিণ করে, তখন গতি থাকে মন্থর। যখন পৃথিবীর নিকট দিয়ে প্রদক্ষিণ করে তখন সর্বনিম্ন ১৫ ঘণ্টা চাঁদের বয়স না হলে (তবে চাঁদের বয়স ১৫ ঘণ্টার সাথে চাঁদ, পৃথিবী, সূর্যের কৌণিক দূরত্ব এবং আরও অনেক বিষয় অনুকূলে থাকতে হবে) চাঁদ দেখা সম্ভব নয়। আর চাঁদ যখন পৃথিবীর দূর দিয়ে প্রদক্ষিণ করে তখন ২৩ ঘণ্টার পুরনো চাঁদও অনেক সময় দেখতে পাওয়া যায় না। সুতরাং অমাবস্যার ৯ ঘণ্টা পরেই পৃথিবীর কোন না কোন স্থানে চাঁদ দৃশ্যমান হবে এ তথ্যটি সঠিক নয়।
৩ এর ব্যাখ্যা:
পৃথিবীর কোন স্থানে চাঁদ দেখা পেলেই রোযা বা ঈদ পালন করার ক্ষেত্রে সেই দেখা কার্যকর হবে কিনা এ সকল বিষয় নিয়ে সারা পৃথিবীতে কয়েকটি মত প্রচলিত আছে।
ক. একদল পৃথিবীর কোন স্থানে প্রথম চাঁদ দেখা গেলেই সমস্ত পৃথিবীতে একদিনে ঈদ বা রোযা পালন করার পক্ষে। (তথাকথিত অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস আদিল সাহেব এই মতের সমর্থক)
খ. একদল সমস্ত পৃথিবীকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। একটি ভাগ নর্থ আমেরিকা, কানাডা এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। আরেকটি ভাগ আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার কিছু অংশ। অপর ভাগটি পূর্ব প্রান্ত। তাদের মতে প্রত্যেকটি ভাগের জন্য আলাদা করে চাঁদ দেখতে পাওয়া শর্ত। শুধু তাই নয় এ দলটি এই তিনটি ভাগ সমন্বয়ে একটি ট্রাই-জোনাল ক্যালে-ার রচনায় আগ্রহী।
গ. আর শেষ দলের অভিমত পৃথিবীর প্রতিটি দেশ একটি মাত্্লা বা উদয়স্থল। সুতরাং প্রতিটি দেশ আলাদাভাবে চাঁদ দেখে ঈদ বা রোযা করবে । প্রতিটি মতই বিস্তারিত ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যা এ সংখ্যার আলোচনায় বলা সম্ভব নয়। তবে আবারও বলতে হয় পৃথিবীর কোন স্থানে চাঁদ দেখা গেলেই তা সারা পৃথিবীর জন্য কার্যকর হবে এ কথাটি যেমন কুরআন, হাদীছ সমর্থিত কথা নয় তেমনি একই দিনে সারা পৃথিবীতে রোযা ও ঈদ পালন করা বাস্তবে অসম্ভব।
৪ এর ব্যাখ্যা:
বাংলাদেশ থেকে চাঁদ দেখার খবর সংগ্রহের জন্য ৯ ঘণ্টার পরিবর্তে কেন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি না দিলেও এটা সহজেই অনুমেয় যে তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা নিম্নরূপ।
ক. তিনি মক্কা শরীফের অবস্থানকে ভৌগলিকভাবে কেন্দ্রে ধরে সেখানেই প্রথম চাঁদ দৃশ্যমান হবে বলে ভাবছেন।
খ. বাংলাদেশের প্রায় তিন ঘণ্টার পর মক্কা শরীফে সন্ধ্যা আসে তাই তিনি বলতে চেয়েছেন বাংলাদেশে বসে চাঁদ দেখার খবর সংগ্রহের জন্য ৯ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। বরং দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করলেই হবে।
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর কেন্দ্রে কা’বা শরীফের অবস্থান এর সাথে সেখানে চাঁদ প্রথম দৃশ্যমান হবার বিষয়টি জড়িত নয়। চাঁদ কখনও দেখা যেতে পারে পূর্বে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এ আবার কখনও পশ্চিমে পলিনেশিয়ান দ্বীপপূঞ্জে।
সুতরাং সৌদি আরবের মক্কা শরীফে চাঁদ প্রথম দেখা যাবে আর দুই-আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাংলাদেশ তা জানতে পারবে এসব যুক্তিহীন, অর্থহীন প্রলাপ মাত্র। পরবর্তীতে প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রায়াস চালাবো ইনশাআল্লাহ।
১৪২৮ হিজরীর পবিত্র রজব মাসের চাঁদের রিপোর্ট:
নিউমুন সংঘটিত হবে ১৪ই জুলাই, শনিবার ১২.০৩ (আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী)। পৃথিবীতে চাঁদ প্রথম দেখা যাবে হাওয়াই এবং কিরিবাতি দ্বীপগুলোতে, পরে সমস্ত পৃথিবীতে। তবে ১৫ই জুলাই, রবিবারেও নিউজিল্যান্ড, নর্থ ইউরোপ এবং নর্থ এশিয়াতে চাঁদ দেখা যাবার সম্ভাবনা কম। সৌদি আরবে চাঁদ প্রথম দৃশ্যমান হতে পারে ১৫ই জুলাই, রবিবার।
বাংলাদেশে ১৪২৮ হিজরীর পবিত্র রজব মাসের চাঁদ দেখার রিপোর্ট:
বাংলাদেশে পবিত্র রজব মাসের চাঁদ দৃশ্যমান হতে পারে ১৫ই জুলাই, রবিবার। সেদিন ঢাকায় সূর্যাস্ত হবে ৬টা ৫৪ মিনিটে এবং চন্দ্র অস্ত যাবে ৭টা ৪২ মিনিটে। অর্থাৎ মোট ৫৩ মিনিট চাঁদ আকাশে অবস্থান করবে। সূর্যাস্তের সময় দিগন্ত রেখার চাঁদের উচ্চতা থাকবে ১০.৪ ডিগ্রী এবং চাঁদের বয়স হবে ২৫ ঘণ্টা। আকাশ মেঘলা না থাকলে চাঁদ দেখতে পাবার সম্ভাবনাই বেশি।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২